মাে. ইসমাইল হােসেন
ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার ভবানীপুর গ্রামে ১৯২৪ সালে মাে. ইসমাইল হােসেনের জন্ম। তার বাবার নাম মানিক সরকার এবং মায়ের নাম আয়েশা খাতুন। ইসমাইল হােসেন ছিলেন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। মানিক সরকার ছিলেন মুক্তমনা ও আধুনিক চিন্তাধারার একজন মানুষ। সবসময় তিনি শােষিত মানুষের পাশে থেকেছেন এবং শাসকদের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় জমিদারবিরােধী আন্দোলনে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দেন এবং তাঁর ‘তালুকদার খেতাব বর্জন করেন। স্থানীয় হােরবাড়ী স্কুলে ইসমাইলের লেখাপড়া শুরু হয়। পরে ত্রিশালের দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ইসমাইল তাদের পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ভবানীপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি ইসমাইল মাস্টার নামে পরিচিত হন। মাে. ইসমাইল হােসেন মাস্টার আওয়ামী লীগে যােগ দেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আওয়ামী লীগের একজন শক্তিশালী নেতায় পরিণত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ভবানীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৭ । তাঁর নেতৃত্বে ভবানীপুর সিনিয়র মাদ্রাসার আটজন শিক্ষক ও ছয়জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন।
এ সময় ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার মৌলভী শাহাবুদ্দিন ও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এম. পি. এ, মােছলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের তালিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী তাদের বাড়িঘরে লুটপাট চালানাে হয় এবং লুটপাটের পর বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ওই সময় শহীদ ইসমাইল হােসেনের বাড়ি-ঘর, গরু-ছাগল, জিনিসপত্র রাজাকার-আলবদর বাহিনী লুট করে নিয়ে যায়।। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার আছিম বাজারে পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের ঘাটি দখল করার লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা হামলা চালায়। কাদেরিয়া বাহিনীর ১৭ নম্বর কোম্পানির কমান্ডার ইদ্রিছ আলীর নেতৃত্বে অন্যান্যদের সাথে ইসমাইল হােসেন মাস্টারও এ যুদ্ধে অংশ নেন। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর সদস্য ও রাজাকারের দল পালিয়ে যায়, আছিম বাজার দখলদার মুক্ত হয়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযােদ্ধারা যখন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন, তখন পালিয়ে যাওয়া রাজাকার-আলবদররা মুক্তিযােদ্ধাদেরকে পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ সময় ইসমাইল হােসেনের পায়ে গুলি লাগে।
তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আছিম বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিমে জমির উদ্দিন বেপারীর বাড়িতে আত্মগােপন করেন। রাজাকার বাহিনী নতুন করে সংগঠিত হয়ে জমির উদ্দিন বেপারীর বাড়ি আক্রমণ করে। তারা ইসমাইল হােসেন মাস্টারকে আহত অবস্থায় আটক করে। রাজাকার বাহিনী ইসমাইল মাস্টারের পেটে গুলি করে এবং তাঁকে অর্ধমৃত অবস্থায় পায়ে রশি লাগিয়ে টেনে-হিচড়ে আছিম বাজারের জামতলায় নিয়ে আসে। তারা ইসমাইল মাস্টারকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তার হাড়গােড় ভেঙে দেয়। এত নির্যাতনের পরও ইসমাইল মাস্টার বেঁচে ছিলেন। এরপর রাজাকার-আলবদর বাহিনী আশেপাশের এলাকার প্রায় ১৩টি লাশ সেখানে এনে জড়াে করে। তারা কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকেও ধরে নিয়ে আসে। এরপর একটি ট্রাকে মৃতদেহগুলাের সাথে জীবিতদের তুলে নিয়ে ফুলবাড়িয়া। বাজারের কাছে আখিলা নদীর তীরে নেওয়া হয়। জানা যায়, আখিলা নদীর তীরে ইসমাইল হােসেন মাস্টারসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে জবাই করে হত্যা করে রাজাকার বাহিনী। পরে তাঁদের সবার লাশ ভালুকজান বধ্যভূমিতে ফেলে দেওয়া হয়। শহীদ মাে. ইসমাইল হােসেন মাস্টার বিবাহিত ছিলেন। তার চার ছেলে ও এক মেয়ে ছিল।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা