You dont have javascript enabled! Please enable it!
মাে. আরজ আলী
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় নােয়াপাড়া গ্রামে ১৯৪৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক মাে. আরজ আলীর জন্ম। তার বাবার নাম নবী হােসেন। আরজ আলী ১৯৬১ সালে এন. জারিয়া ঝাঞ্চাইল হাই স্কুল থেকে এস. এস. সি. পাস করে নেত্রকোনা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৩ সালে এইচ. এস. সি. এবং ১৯৬৫ সালে বি. এ. পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে দর্শনশাস্ত্রে এম. এ. পাস করেন। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ডাকসু নির্বাচনে তখনকার ইকবাল হল শাখায় একটি সম্পাদকীয় পদেও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ময়মনসিংহের ইশ্বরগঞ্জ কলেজে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে ওই এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বর্তমান নেত্রকোনা সরকারি মহাবিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসাবে যােগ দেন। অধ্যাপক আরজ আলী খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন।
শিক্ষক হিসাবে আরজ আলী ছাত্রপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা করার কারণে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শুরুতে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁর বাড়িঘর লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর ১৩ আগস্ট (কারও মতে, ১২ আগস্ট) নেত্রকোনা কলেজের শিক্ষক হােস্টেল থেকে পাকবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। দুদিন পর আরজ আলীকে তার নিজ এলাকা বিরিশিরির সেনা ঘাটিতে স্থানান্তরিত করা হয়। বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানের প্রতি বশ্যতা স্বীকারের জন্য তাঁর ওপর চালানাে হয় অকথ্য নির্যাতন। পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার জন্য জোর করলেও আরজ আলী ঘৃণার সাথে তা প্রত্যখ্যান করেন। ১৬ আগস্ট সকাল বেলা সােমেশ্বরী নদীর তীরে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শােনা যায়, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন। এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তার বােন আরশেদা বেগম রিনার রচনায়। তিনি লিখেছেন : ভয়াবহ একাত্তরের ১৩ আগস্ট। সন্ধ্যাবেলা।
আরজ ভাইকে প্রফেসর হােস্টেল। থেকে ধরে মিলিটারি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। আমার এক মামা, নাম ময়না। তিনি মিলিটারি ক্যাম্পের পাশে প্রাইমারি টিচার্স টেনিং কলেজের হােস্টেলে থাকতেন। তার ঘর থেকে হায়েনাদের তাণ্ডব দেখা ও কথা শােনা যেত। মামা আমাকে। বলেন, “নিস্তব্ধ রাত। আকাশে বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কী এক বীভৎস। মর্মান্তিক দৃশ্য। আরজের পা দুটো বেঁধে ওপরে ছাদের রিংয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। পরনে আন্ডারওয়ার ভিন্ন আর কিছুই নেই। হানাদার বাহিনীর এক জল্লাদ আরজের গায়ে বেতের আঘাত করছে আর বলছে, শালা বল, মুক্তিদের কেন জায়গা দিয়েছিস, কেন ওদের খাবার দিয়েছিস, শুয়ােরকা বাচ্চা। বেতের আঘাতে। শরীর থেকে দরদর রক্ত ঝরছে। আর জল্লাদরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। আরজ। ভাই বলেছে, সত্যি বলছি আমি কিছুই জানি না। আরজের কথায় হায়নার দল। কর্ণপাত করছে না। ক্রমাগত অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে আরজের আর্তচিঙ্কার শুনতে না পেয়ে তাকিয়ে দেখি ওর অবশ দেহটা স্থির হয়ে। ঝুলে আছে। এক পর্যায়ে আরজ ভাই সংজ্ঞা ফিরে পেল। আবার বুটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল তার সারা শরীর।
আগস্টের ১৬ তারিখ সকাল দশটায় মিলিটারি ক্যাম্প থেকে চোখ বেঁধে আরজ ভাইকে কয়েকজন পাক মিলিশিয়া নিয়ে যায় সােমেশ্বরী নদীর তীরে। পাকিস্তানি কর্নেল তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখনাে বলুন, মুক্তিরা আপনার বাড়িতে ছিল কি না? আরজ ভাই দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, “জানি না। আমি দার্শনিক জি. সি. দেবের ছাত্র। মিথ্যা বলতে শিখিনি।” মুহূর্তে কঠিন হয়ে যায় কর্নেলের মুখ। এরপর গর্জে ওঠে অস্ত্র । দুজন সৈনিক এসে আরজ ভাইয়ের লাশটি সােমেশ্বরীর। খরস্রোতে ফেলে দেয়। তলিয়ে যায় আরজ ভাই। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলােতে অধ্যাপক আরজ আলী তাঁর ভাইয়ের শিশু সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘মুজিব’ এবং প্রতিবেশী বন্ধুর মেয়ের নাম রেখেছিলেন ‘রাষ্ট্রন্নেসা’। নেত্রকোনা জেলার বহু মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন তার প্রত্যক্ষ। ছাত্র। কোনাে এক বাউলের রচনা কই গেলা ভাই আরজ আলী, তােমার জন্য কাঁদিতেছে শত শত বাঙালি’ গানটি এখনও তার স্মৃতি বহন করে চলেছে। দুর্গাপুরে সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৭৩ সালে মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সুধী সমাজ কলেজের সামনের সড়কটি তার নামে নামকরণ করে। কিন্তু সেই সড়কের নামফলক এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অধ্যাপক আরজ আলী স্মরণে ২০১৭ সালে নেত্রকোনা কলেজের গ্রন্থাগারের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী আরজ আলী গ্রন্থাগার”। এছাড়া কলেজের দর্শন বিভাগের সেমিনারে নামও তাঁর নামেই রাখা হয়েছে। শহীদ আরজ আলী অবিবাহিত ছিলেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!