মাে. আমিনউদ্দিন
মাে. আমিনউদ্দিনের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউড়িতে, ১৯৩৬ সালের ৯ জুলাই। তাঁর বাবার নাম মাে. কাইয়ুম, মায়ের নাম মােসলেমা খাতুন। দেশ বিভাগের সময় তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তিনি তার চাচার সাথে পাবনায় চলে আসেন। তাদের পরিবার পাবনার কালাচাদ পাড়ায় স্থায়ী বাস গড়ে তােলে। মো. আমিনউদ্দিন ১৯৫৪ সালে তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল সেকেন্ডারি বাের্ড থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই, এসসি, পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে রসায়নশাস্ত্রে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বি. এসসি, ও ১৯৬০ সালে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম. এসসি. পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি প্রথম কিছুদিন পাবনার এডরুক ঔষধ কোম্পানিতে রসায়নবিদ হিসাবে চাকরি করেন। পরে ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে গবেষক হিসাবে যােগ দেন। ১৯৬৪ সালে বিভাগীয় বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যান। এরপর ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি পান। ওই বছরই তিনি দেশে ফিরে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে উচ্চতর গবেষণা কর্মকর্তা হিসাবে যােগ দেন। সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রাকৃতিক গবেষণা বিভাগে কাজের সূত্রে ড. আমিনউদ্দিন বেশ কিছু মূল্যবান সন্দর্ভ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযােগ্য দুটি প্রবন্ধ পলিমার বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও অগ্রগতি ও সময় সংক্রাম এবং ষাট দশকের বিবর্তন’। ড. মাে, আমিনউদ্দিন সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে প্রত্যয়’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন।
তরুণ বিজ্ঞানী আমিনউদ্দিন ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি ও বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে বরাবরই তিনি ছিলেন সােচ্চার। ১৯৭১ সালে মার্চের অসহযােগ আন্দোলনে সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করায় তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধ। চলাকালে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযােদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। কিন্তু তার কর্মস্থলে ছিল স্বাধীনতাবিরােধী জামায়াতের দাপট। জামায়াতিদের কাছে তার কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে। এ খবর তারা পৌছে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে। ড. আমিনউদ্দিন থাকতেন সায়েন্স ল্যাবরেটরি স্টাফ কোয়ার্টার্সের বি-১৯ নম্বর ভবনে। ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টায় কারফিউয়ের মধ্যে তার বাসভবনে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী হানা দেয়। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হােসেন ১৪ ডিসেম্বর সকালে নিজেদের বাসার বারান্দায় দাড়িয়ে দেখেছেন, ইপিআরটিসির লাল রঙের কোচ নিয়ে আলবদর সদস্যরা ঢুকেছে সায়েন্স ল্যাবরেটরির কলােনির ভেতরে । এই দলটাই তুলে নিয়ে যায় ড. আমিনউদ্দিন ও ড. সিদ্দিক আহমদকে।
সে সময়ের ঘটনার বিবরণ জানা যায় তার স্ত্রী সুরাইয়া আমিনের ‘আমার স্বামী রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন : ১১ ডিসেম্বর কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করলে তার তিন তরুণ বন্ধু বাসায় এসে কলােনি ছেড়ে অন্য কোথাও কিছুদিনের জন্য চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি বলেছিলেন, “পরাজিত সৈন্যরা কখনও শহরের ভিতরে অত্যাচার করার সময় পাবে না।” স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা-সংক্ষুব্ধ অনিশ্চয়তার নয় মাসের সম্ভাব্য পরিস্থিতি অগ্রবীক্ষণে তিনি অসাধারণ দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন; কিন্তু ভুল তার হয়েছিল একটাই- ধর্মোন্মাদ আলবদরদের তৎপরতা সম্পর্কে তিনি সঠিক আঁচ করতে পারেননি।… ১৪ ডিসেম্বর ভাের থেকেই আমি জরুরি প্রয়ােজনীয় টুকিটাকি জিনিস একটি বাক্সে ভরে বার বার তাকে বাসা ছেড়ে সপরিবারে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছিলাম, কিন্তু আমার ভাই মঞ্জু তাকে বাধা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমাদের আর সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলােনি ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। আমার স্বামীরও অবশ্য বাসা ছেড়ে পালানাের ব্যাপারে দোদুল্যমানতা ছিল। সেই দুর্যোগের মধ্যে সকাল সােয়া ৮টার দিকে।
আততায়ীরা কলােনিতে এলাে। হাতে তাদের নামের তালিকা। পাশবিক উল্লাসে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নেকড়ের ক্ষিপ্রতায় খুঁজতে লাগলাে ড. আমিনউদ্দিন, ড. সিদ্দিক আহমদ ও শামসুল আলমকে। কেউ যে আর একজনকে সতর্ক করে দেবে, কারফিউয়ের জন্য সে সুযােগ ছিল না। সেই সময় আমার স্বামী আমাদের। আড়াই মাসের একমাত্র পুত্রসন্তান আয়নের মুখে দুধের ফিডার ধরে রেখেছিলেন; আমি ছিলাম রান্নাঘরে। সাড়ে আটটার সময় নরপিশাচরা আঘাত করল বাসার। প্রবেশ দ্বারে। তিনি নিজেই দরজা খুললেন। কালাে মুখােশধারী চারজন যুবক রাইফেল হাতে ড. আমিনউদ্দিনের পরিচয় জেনেই ঝাপিয়ে পড়ল তার উপর। আমি স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চিকার করে কেঁদে উঠলাম। মঞ্জুর সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হতেই তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে কাধে আঘাত করল এক মুখােশধারী। তারপর রাইফেলের নলের মুখে আমার স্বামীকে তাঁরই গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে টেনে বের করে নিয়ে গেল নরপিশাচরা। আমি স্বামীকে আর ফিরে পাইনি।” (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) ড. মাে. আমিনউদ্দিনের মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা যায়নি, তাঁর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৬৯ সালের ১২ অক্টোবরে আমিনউদ্দিন বিয়ে করেন। শহীদ হওয়ার সময় স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে যান। তার একমাত্র ছেলে গাফফার আমিন আয়ন পেশায় চিকিৎসক।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা