You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রসঙ্গ- পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক বাঙ্গালি অফিসার টর্চার | মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা
::::::::::::::::::::::::::
অসংখ্য সিএসপি-ইপিসিএস অফিসার পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যার শিকার হয়েছিল, অথচ কিছুদিন আগেও যারা ছিল তাদেরই সিভিল সহকর্মী। নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে, চরম বিপর্যয়কর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মােকাবিলায় একযােগে কাজ করেছে। আজ শুধু মারণাস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে ক্ষুব্ধ পশুর আসরিক শক্তিতে একপক্ষ অবদমিত করছে অপেক্ষাকৃত উন্নত, শিক্ষিত ও প্রতিভাবান পক্ষকে। তাদের হাতে শহিদ দু-একজন ছাড়া অধিকাংশের লাশও পাওয়া যায়নি। আর যাদেরকে শেষপর্যন্ত ফেরত দিয়েছিল এবং স্বাধীনতা লাভের পরে যারা মুক্তি লাভ করেছিলেন, বন্দি-অবস্থায় অমানসিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে তাদের যে হাল করেছিল, তা শুধু অবর্ণনীয়ই নয, বরং ছিল মৃত্যুরই শামিল। বিচ্ছিন্নভাবে এখন জানা যাক এরকম কিছু মৃত্যু, লাশ গুম, সামরিক টর্চার সেলে বন্দিদের দুর্বিষহ অত্যাচারের কাহিনি।
বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান স্বীয় অবরুদ্ধ নয় মাস গ্রন্থে লিখেছেন: “আমাদের ব্লকের পুব দিকের কামরার অনেককেই এফআইসি (ফিল্ড ইন্টারোগেশন সেন্টার)-তে নিতে দেখিয়াছি। ফরিদপুরের ভিসি ইউসুফ আলী, বরিশালের৩৩ ডিসি আয়ুবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের এসডিও হাবিবুর রহমান সবাইকে ভীষণ নির্যাতন করিয়াছে। পাশের কামরায় গােপালগঞ্জের সেকেন্ড অফিসার নুর মহম্মদ পেটের ব্যথায় দিনরাত চিৎকার করে। ঐ অবস্থায়ও তাকে এফআইসিতে নিয়া যায়।”৩৪
অন্যত্র লিখেছেন: “শাহ্ মহম্মদ ফরিদ-রাজবাড়ীর এসডিও।… / পাশের কামরায় নারায়ণগঞ্জের এসডিও হাবিবুর রহমান, মাদারীপুরের রেজাউল হায়াত, ফরিদপুরের ডিসি ইউসুফ, উইং কমান্ডার বাকী, গােপালগঞ্জের সেকেণ্ড অফিসার নুর মহম্মদ।../ শাহ মহম্মদ ফরিদ-রাজবাড়ীর এসডিও। তাহার দুঃখও কম নয়। তাই একদিন সে বলিল যে, নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া রাজবাড়ীতে প্রায় চার হাজার লােকের প্রাণ বাঁচাইয়াছে। তাহার মহকুমার পুলিশ অফিসার পঁচিশে মার্চের কয়েকদিন আগে ছুটি নিয়া সরিয়া পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার একমাত্র শক্তি ছিল থানার ওসি। গােয়ালন্দ ঘাটের কাছে হঠাৎ কিছু অবাঙ্গালী মারা যায়। নিকটে আনসার বাহিনীর বাৎসরিক ক্যাম্প স্থাপিত হইয়াছিল। তাহারাই নাকি অবাঙ্গালীদের আক্রমণ করে। শাহ্ ফরিদ খবর পাইয়া ওসি ও দুইজন পুলিশসহ সেইদিকে রওনা দেয়। কিন্তু স্থানীয় লােকজন আসিয়া বাধা দেয়। শক্তিশালী ফোর্স ছাড়া ঐ দিকে যাওয়া উচিত হইবে না। তাহারা ফিরিয়া আসে। তাহার সহকর্মী বন্ধুরা নিকটবর্তী মহকুমার এসডিও এবং এসডিপিওরা সীমান্ত পার হইয়া চলিয়া গিয়াছে। ইচ্ছা করিলে সেও চলিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু তাহা হইলে চার হাজার অবাঙ্গালী শেষ হইয়া যাইত। পাক-বাহিনী রাজবাড়ী তাহার বাসায় যাইয়া তাহাকে গুলির নিশানা করে। ক্যাপ্টেন তানুস নামক একজন সৈনিক তাহাকে নিয়া বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফিরা করে। পরে লিখিয়া দেয়, শাহ ফরিদকে যেন নির্যাতন করা না হয়। তা সত্তেও তাকে বন্দী করা হয়।”৩৫
১৯৬৭ সাল-ব্যাচের সিএসপি শাহ মােহাম্মদ ফরিদ সম্বন্ধে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন (তাঁরা তখন দেশত্যাগ করে ভারতের পথে ছিলেন): “স্থানীয় নেতা কর্মীদের সাথে আলােচনা শেষে আমরা ফরিদপুর ত্যাগ করি। রাস্তার বিভিন্ন অংশ কেটে দেয়া হয়েছে পাক সৈন্যের গতি রােধ করার জন্য। একটা রিক্সা-যােগে আমরা কামারখালীর পথে চলেছি। কোথাও নিজেরা রিক্সা পার করেছি। এমন সময় ফরিদপুরের দিকে একটি জীপ আসতে দেখি। জীপটি কার তা দেখার জন্য আমরা রাস্তার আড়ালে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম জীপটিতে অসামরিক লােক রয়েছেন। জীপে চালকের পক্ষে সাদা পােশাক পরিহিত একজন ভদ্রলােক বসা। রাস্তায় এসে জীপটি থামাবার ইঙ্গিত দেই। পরিচয় নিয়ে জানলাম তিনি রাজবাড়ীর মহকুমা প্রশাসক। নাম শাহ ফরিদ। তাঁর কাছে টুকরাে টুকরাে খবর পেলাম।/ শাহ ফরিদ গিয়েছিলেন) সেখান থেকে তিনি চুয়াডাঙ্গার সাথে যােগাযােগ করেছেন। তিনি জানান মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক এলাহী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও বি ডি আর এর সাথে যােগাযােগ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে। ঝিনাইদহ, যশাের, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার জনগণ পাক সৈন্যের বিরুদ্ধে অবরােধ সৃষ্টি করেছে। সেখানে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি।../ শাহ ফরিদ আমাকে চিনল কিনা বুঝলামনা। ঢাকার পরিস্থিতি তাকে জানাই। আমি বললাম, আমরা আওয়ামী লীগ হাই কম্যান্ডের পক্ষ থেকে এই এলাকার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে এসেছি। পরে শাহ ফরিদ পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।”৩৬
স্বয়ং শাহ মােহাম্মদ ফরিদ, পরবর্তীকালে তিনি যখন টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক তখনকার (২৫/৭/১৯৭৩) এক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেন: “গােয়ালন্দের এস, ডি, ও, থাকাকালে পাকবাহিনী আমাকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখে। তারপর আমাকে ৩রা জুন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজার বাড়ীতে বন্দী রাখে। এই সময় নানা প্রকার শারীরিক অত্যাচারও করা হয়। জুনের ৪ তারিখে আবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একদিনের জন্য রাখে। সেই রাতে আমার উপর অনেক অত্যাচার করা হয়। পরদিন আমাকে সেকেণ্ড ক্যাপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২১শে সেপ্টেম্বর অবধি বন্দী রাখা হয়। এই সময় আমাকে নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং প্রশ্নোত্তর করা হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে বিভিন্ন অভিযােগ সম্বলিত চার্জশিট দেওয়া হয়। ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান হয়। কারাগারের বাঙ্গালী কর্মচারীরা সকল প্রকার আমাকে সাহায্য করে এবং যথাসাধ্য আরাম আয়াসে রাখার চেষ্টা করে। আমার সাথে অনেক সরকারী কর্মচারীর মধ্যে ফরিদপুরের তদানিন্তন (তদানীন্তন) জেলা প্রশাসক (বর্তমানে রেজিষ্ট্রার, কো-অপারেটিভ সােসাইটি) জনাব আ, ন, ম, ইউসুফ, মাদারীপুরের মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত (বর্তমানে ঢাকার ডি সি) বন্দী ছিলেন। আমরা সবাই বিচারাধীন আসামী ছিলাম। ১৭ই ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসি। গোয়ালন্দে আমার হুকুমে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে কুষ্টিয়ায় ৩০-৩১শে মার্চ ১৯৭১ আছমত ও কুদ্দুস নামে গােয়ালন্দ মহকুমার দু’জন আনছার শহীদ হয়। গোয়ালন্দ ঘাটে ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ফকির মহীউদ্দিন নামে আর একজন আনছার শহীদ হয়। এ ছাড়াও তিনজন আনছার কুষ্টিয়ার যুদ্ধে আহত হয় । তাদের নাম আতিউর, রব ও জিয়াউদ্দিন। গোয়ালন্দ মহকুমার আর একজন আনছার নুরুল ইসলাম আমার সাথে বন্দী হয় এবং দীর্ঘ যন্ত্রণাভােগের পর ১৭ই ডিসেম্বর মুক্তি পায়। আমি গ্রেফতার হবার পূর্ব পর্যন্ত গােয়ালন্দ মহাকুমার দলমত নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের এবং সর্বস্তরের সরকারীর (সরকারী) কর্মচারীদের পূর্ণ সহযােগিতা লাভ করেছিলাম।”৩৭
এপর্যায়ে সিভিল সার্ভিস অফিসারদের অনুরূপ আরও কিছু নিপীড়ন-নির্যাতন ভােগ, মৃত্যু ইত্যাদির সংবাদ তুলে ধরা হলাে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ অষ্টম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত পিরােজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া থানার (বর্তমানে উপজেলা) বাশিন্দা আফতাব উদ্দীন আহমদের আত্মজবানি (১৯/৮/১৯৭৩) থেকে অবগত হওয়া যায়: “৪ঠা মে পিরােজপুর শহরে পাক বাহিনী প্রবেশ করে। পাক বাহিনী বরিশাল থেকে হুলার হাট হয়ে পিরােজপুর প্রবেশ করে। মিলিটারী তিন দিক থেকে পিরােজপুর শহর আক্রমণ করে।/ ৫ই মে পাক বাহিনী আমার বাড়ী ধ্বংস করে। প্রথমে লুটতরাজ চালায় তারপর অগ্নি সংযােগে বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এই দিনই পাক বাহিনী পিরােজপুর সেকেণ্ড অফিসার, এস,ডি,পি,ও, ট্রেজারী অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে।”৩৮ উদ্ধৃত খণ্ডেই গ্রন্থিত চট্টগ্রামের সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আলী হায়দার খান তাঁর আত্মকথনে (১৬/৮/১৯৭৩) উপরের ঘটনাটি আরও সবিস্তার বর্ণনা করেছেন। (তার কথায়): “কর্ণেল আতিকের নেতৃত্বে পাকসেনারা হুলার হাট আসে। ঢুকেই ঘর বাড়ী জ্বালাতে থাকে। মুসলিম লীগাররা তাদেরকে স্বাগত জানায়। পাক সেনারা বলে হিন্দু বাড়ী কোথায়? এরপর থেকে হিন্দু ঘর বাড়ী জ্বালাতে থাকে।লুঠপাট হত্যা অনবরত করতে থাকে। পিরােজপুর মহকুমা প্রশাসক মহিবুল্লাহ শাহ্ (সিন্ধী, পাকিস্তানের বিশিষ্ট ন্যাপনেতা বাকের শাহর ভাইপাে) আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন দোস্ত তােমরা তাে স্বাধীনতা পেয়েই যাচ্ছ, আমরা পেলাম না। ৫ই মে ষড়যন্ত্র করে ও, সি, ভারপ্রাপ্ত এস, ডি, ও, আব্দুর রাজ্জাক, (২) এস, ডি, পি, ও, ফয়জুর রহমান আহমেদ (৩) ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানকে ডেকে আনিয়ে মিটিং শেষ করে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। বাড়ী ঘর লুঠ করে।”৩৯
পাকবাহিনীর হাতে এরকম আরও বহু সিভিল প্রশাসক নানা অজুহাতে এবং কোনাে কারণ ছাড়াই আটক হয়ে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন। যেমন, স্বাধীনতা- উত্তরকালে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার বদিউজ্জামান তার আত্মজবানিতে উল্লেখ করেছেন, ১৪/৭/১৯৭৩ তারিখে পাক সেনাবাহিনী বিনা কারণে তাকে আটক করে অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের পর তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। জেলখানায় অনুরূপ মিথ্যা অভিযােগে আরও যাদের তিনি বন্দিরূপে দেখতে পান তাদের মধ্যে সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ছিলেন। তাঁর ভাষায়: “সেপ্টেম্বরের শেষ অথবা অক্টোবর মাসের প্রথমে আমার বিরুদ্ধে সামরিক কেসের চার্জ নিয়ে একটি কপি দেয় এবং তার পরপরই জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া ঢাকা থেকে আরও অতিরিক্ত কেস আমার বিরুদ্ধে আসে। আমার সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সানাউল হক, ইনসপেক্টর আক্তার হােসেন চৌধুরী, নুর মােহাম্মদ, ডাঃ আনিসুজ্জামান এম, বি, বি, এস, আনিসুর রহমান ইত্যাদি লােকের বিরুদ্ধে মামলা ওঠে।/ অক্টোবর মাস থেকেই ম্যাজিস্ট্রেট সানাউল হক সাহেবের কেস ওঠে। দুটো হিয়ারিং হবার পর কেস বন্ধ হয়ে যায়।”৪০ বােঝাই যাচ্ছে, বিনা বিচারে জেলে পচিয়ে মারতে এই কেস বন্ধের প্রহসন।
প্রসঙ্গত কাজী ফজলুর রহমানের দিনলিপি একাত্তর সূত্রে এরূপ বহু ব্যক্তিনাম এবং তাদের করুণ পরিণতির কথা জানা যায়। তিনি লিখেছেন: “২১ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১, ঢাকা/.. সেদিন আমাদের প্রতিবেশী পুলিশ প্রধান বলছিলেন এমনি নানা ঘটনার কথা।/ ২৬শে মার্চ রাতে সি.এস,পি সামশুল আলমের বেইলী রােডের বাসার দরজা ভেঙ্গে সৈন্যরা ঢুকেই গুলি করে মারে তার বাসার চাকরকে আর সেখানে তার অতিথি ছিল তাকে। এরপর সামশুল আলমের ঘরে ঢুকে তাকে তাক করে ট্রিগার টিপে দেখে ম্যাগাজিনে আর গুলি নেই। নতুন করে ম্যাগাজিন লাগাতে যাচ্ছে ঐ সময়টুকুতেই আলম, তার স্ত্রী আর মা নাকি এই বীরপুরুষদের পায়ে পড়ে আল্লাহর নামে জীবন ভিক্ষা চায় । লাথি মেরে তাদের হটিয়ে দিচ্ছিল এমন সময় এক কর্ণেল এসে হাজির। আলমের পাশের ঘরেই বসত ইডেন বিন্ডিংয়ে। সে বাঁচাল তাদের।../ শুনলাম খুলনার ডি.সি এখন ঢাকায়। তার মৃত্যুর কথাটা গুজবই ছিল।../ আজ শুনলাম রাজশাহীর ডি.সি রশিদুল হাসান এর নাকি কোন খবর নাই। কেউ কেউ বলছিল যে সে নাকি গিয়েছিল ই.পি.আর’দের কাছে। তারা তাকে আটকিয়ে রেখেছিল। পরে যখন ই.পি.আর’রা রাজশাহী ছেড়ে যায় তখন তাকে সঙ্গে করে নাকি নিয়ে যায়।”৪১
তিনি অন্যত্র লিখেছেন৪২ (প্রাসঙ্গিকাংশ ইতস্তত উৎকলিত): “২৪/ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১, ঢাকা/..আহমদ ফজলুর রহমানকে (ভূতপূর্ব সিএসপি ও আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি) গত পরশু রাতে তার বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে গেছে।”../ “২৬ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১, ঢাকা/.রাজশাহীর ডি.সি এখনও নিখোজ। বােধহয় নিহত। কমিশনারকে নাকি গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে।”../ “৪/ মে মঙ্গলবার ১৯৭১, ঢাকা/..টুকু বলল পরশুদিন খুলনা থেকে যশােরে আসার পথে একজন তরুণ সহকারী কনজারভেটার অফ ফরেষ্টকে হত্যা করা হয়েছে। সে বেচারা যাচ্ছিল তার বউ ও বাচ্চাকে আনতে।/ আরও কত সরকারী অফিসারে এখনও কোন খোজ নেই। রাজশাহীর ডি.সি, কমিশনার, কুড়িগ্রামের এসডিও এবং কুমিল্লার ডি সি-ইত্যাদি। বেশীর ভাগই নিশ্চয়ই এদের হাতে নিহত হয়েছে, যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও কি রকম কে জানে।”
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ৭১এর দশমাসশীর্ষক গ্রন্থসূত্রেও এরকম অসংখ্য ঘটনর কথা জানা যায়। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলাে।
“২১ বৈশাখ ১৩৭৮ বুধবার ৫ মে ১৯৭১/..পিরােজপুর হুলারহাটে পাকসেনারা এসেই ঘরবাড়ি জ্বালাতে থাকে..পিরােজপুর মহকুমা প্রশাসক মুহিবুল্লাহ শাহ ছিলেন উদারপন্থী তবু পাকবাহিনী শঠতার আশ্রয় নিয়ে ওসি আব্দর রাজ্জাক, এস ডি পি ও ফয়জুর রহমান আহমেদ (উপন্যাসিক ও প্রখ্যাত নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের পিতা) ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানকে ডেকে এনে মিটিং শেষ করে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পিরােজপুরের চৌদ্দআনা ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে পাকবাহিনী ও তাদের কুখ্যাত ধর্মব্যবসায়ী দোশররা।”../ ২৩ বৈশাখ ১৩৭৮ শুক্রবার ৭ মে ১৯৭১/-ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক আ ন ম ইউসুফকে পাকবাহিনী অমানুষিক অত্যাচার করে গ্রেফতার করে। ফরিদপুরের পুলিশ সুপার নুরুল মােমেন খান (মিহির)কেও গ্রেফতার করে ঢাকাস্থ এম পি এ হোস্টেলে রাখা হয়। ফিল্ড ইন্টেরােগেশন সেন্টার নং ৭৩৪ এ তাদের নিয়ে যায় মেজর ফারুকী। বন্দীদশায় অমানবিক অত্যাচার সহ্য করেন তারা।” ৪৩
“২২ আষাঢ় ১৩৭৮, বুধবার, ৭ জুলাই ১৯৭১/..মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, খবর পৌঁছে যে, পাক বাহিনী নির্মমভাবে বহু সরকারী কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। শহীদদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লার ডিসি শামসুল হক খান, সিএসপি, রাজশাহীর এডিসি কুদরত এলাহী চৌধুরী, নুরুল আমিন খান সিএসপি, কাজী আজিজুল ইসলাম (ইপিসিএস), সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ..আরও বহু কর্মকর্তা পাকবাহিনীর হতে বন্দী জীবনে দুবিসহ (দুর্বিষহ) জীবন কাটাচ্ছেন এঁরা হলেনঃ ফরিদপুরের ডিসি আনম ইউসুফ, বরিশাল ডি সি আইয়বুর রহমান, গােয়ালন্দ এসডিও শাহ মােঃ ফরিদ, সৈয়দ রেজাউল হায়াৎ সিএসপি..।”৪৪
_ “২৮ কার্তিক, ১৩৭৮ সােমবার, ১৫ নভেম্বর ১৯৭৯(১)/..পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়, গত ২৫ মার্চের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রদেশের বিভিন্নস্থানে নিয়ােজিত চারজন সিএসপি ও একজন ইপিসিএস অফিসারের মৃত্য (মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে কুষ্টিয়ার এডিসি নাসিম ওয়াকার আহমেদ ৩১ মার্চ(,) চুয়াডাঙ্গার এসডিও মােহাম্মদ ইকবাল ১৫ এপ্রিল, নওগাঁর এসডিও মােহম্মদ নিসারুল হামিদ ১৬ এপ্রিল, সিরাজগঞ্জের এসডিও এ, কে, শামসুদ্দিন ২০মে এবং যশােরের সাব জজ মােজাফফর হােসেন (ইপিসিএস) ৩ সেপ্টেম্বর মারা যান।”৪৫
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক মফিজুল্লাহ কবির ও সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এ, কে, শামসুদ্দিনের নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাথা Experiences of An Exile At Home : Life in Occupied Bangladesh-এ বন্দিশিবিরে নির্যাতিত ও অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া জনৈক আতাউর রহমানের প্রত্যক্ষদর্শনসূত্রে লিখেছেন: “In that helpless and desperate situation Mr. Rahman was waiting for death when he witnessed the pathetic death of Mr. A. K. Shamsuddin, Subdivisional Officer of Serajganj. It was on May 19 that the executioners battered and bruised the body of Mr. Shamsuddin and brought him in the room of Mr. Ataur Rahman. Mr. Rahman raised his head on to his lap but failed to give him a drop of water at the time when he breathed his last.” ৪৬
কী নিষ্ঠুর পৈশাচিক বর্বরতা! মৃত্যুপথযাত্রীর তৃষ্ণা মেটাতে এক ফোঁটা পানিপর্যন্ত খেতে দেয়নি পাকিস্তানি পাষণ্ডগুলাে।
রেফারেন্স – মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা