মাে. আবদুল মুকতাদির
ড. মাে. আবদুল মুকতাদির জন্মেছিলেন সিলেট সদর থানার সিলাম পশ্চিম পাড়া গ্রামে, ১৯৪০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। তার বাবার নাম মৌলভী আব্দুল জব্বার (এফ. এম.) এবং মায়ের নাম বেগম মসাহেদা খানম। মৌলভী আব্দুল জব্বার ছিলেন সিলাম জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও সম্পাদক। তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার বিনিময়ে কোনাে বেতন নিতেন না। এছাড়া সিলেট সদর থানার জালালপুর আলীয়া মাদ্রাসায়ও তিনি অবৈতনিক শিক্ষক হিসাবে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। তিন ভাই ও চার বােনের মধ্যে ড. মুকতাদির ছিলেন তৃতীয়। সিলাম চকবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মুকতাদির ১৯৪৮ সালে সিলাম জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি রাজা জি. সি. উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে আই. এসসি, এবং ১৯৬০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি, এসসি. পাস করেন। এরপর ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূ-তত্ত্বে এম, এসসি, পাস করেন মুকতাদির।
শিক্ষাজীবন শেষ করে মুকতাদির ১৯৬২ সালে সহকারী ভূ-তত্ত্ববিদ হিসাবে বিদ্যুৎ ও পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (ওয়াপদা) চাকরি নেন। তিনি বেশিদিন সেখানে চাকরি করেননি। ১৯৬৪ সালের ১৯ অক্টোবর মুকতাদির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। তিনি ১৯৬৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইড্রোলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা লাভ করেন। ডিপ্লোমা করাকালে ব্রিটিশ সরকারের কারিগরি সহায়তা কর্মসূচির আওতায় হাইড্রোলজির ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্সও করেন। ভূ-তত্ত্বে আরও উচ্চতর গবেষণার জন্য মুকতাদিরের আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল। তিনি থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার ১২ নম্বর ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে। তাঁর স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালালে মুকতাদির তার স্ত্রীকে নিয়ে ওই ভবনের তিনতলায় ড. সৈয়দ আলী নকীর বাসায় আশ্রয় নেন। পরদিন ভােরে পাকিবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন।
এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন ড. মুকতাদিরের একমাত্র মেয়ে ইলােরা মুকতাদির। মায়ের কাছে শােনা ঘটনা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন : বাবাকে আমি দেখিনি, বাবা বলে কখনও কাউকে সম্বােধন করা হয়নি। বাবা কী? বাবার ভালােবাসা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করিনি। … ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় হল ও এলাকায় হামলা চালায়। … আমার বাবা নিচতলায় থাকতেন। অত্যন্ত ভয় পাচ্ছিলেন মা। তাই বাবা তাকে নিয়ে সেই ভবনের তিনতলায় ড. সৈয়দ আলী নকী সাহেবের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সারারাত তারা ভয়াবহ গর্জন ও ভীতির মাঝে জেগে ছিলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে, সৈন্যদের গাড়ির আওয়াজ, মানুষের চিঙ্কার শােনা যাচ্ছিল। এভাবে ভাের হয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল ১০/১৫ জন সিপাই, হাতে একটি কাগজ, এলাকার ভিতরে ঢুকে এই ভবনের দিকেই আসছে। সৈন্যরা নিচে তাদের ডাকছেন। আলী নকী সাহেব নিচে গেলেন- উনার সাথে উপরে উঠে এল ৪/৫ জন সৈন্য। বারান্দায় দাড়িয়েছিলেন বাবা মা। ভিতরে ঢুকেই বাবাকে নির্দেশ করে বলেছিল “তুম জয় বাংলা বলতা, পাকিস্তান নেহি চাহতা।” … সঙ্গে সঙ্গে গুলির পর গুলিতে বাবার বুক ও পেট ঝাঁঝরা হয়ে গেল। মা তখন চিৎকার করে প্রাণভিক্ষা চাইলে তাকে তিরস্কার করে ফেলে দিয়ে সে বাড়িতে আর একজনকে হত্যা করে। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড)।
মুকতাদিরের স্ত্রী সে সময় সন্তানসম্ভবা ছিলেন। ওই অবস্থাতেও তিনি স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা চালান। দুইবার তিনি তাক করা বন্দুকের সামনে দাঁড়ান। প্রতিবারই পাকসেনারা তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তৃতীয়বারের সময় তিনি মাটি থেকে ওঠার আগেই পাকসেনারা গুলি চালায় ড. মুকতাদিরের বুকে। মুকতাদির মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পাক হানাদাররা ড. মুকতাদিরের লাশ টেনে নিয়ে সূর্যসেন হলে রাখে। পরের দিন মুকতাদিরের আত্মীয়রা বহু কষ্টে তার লাশ সংগ্রহ করেন। এরপর ড. মুকতাদিরের পুরানা পল্টনের ৭৮/এ লাইনের বাসভবনের পাশের মসজিদের কাছে তাকে কবর দেওয়া হয়। ড. মুকতাদির শহীদ হওয়ার পরে তাঁর একমাত্র মেয়ে ইলােরা মুকতাদিরের জন্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভূ-তত্ত্ব বিভাগের একটি কক্ষে ‘শহীদ ড. মুকতাদির জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা