You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুহাম্মদ শফী
মুহাম্মদ শফীর জন্ম ৫ এপ্রিল ১৯১৫, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দিঘড়ে গ্রামে। তার বাবার নাম সুফি আবদুল লতিফ এবং মায়ের নাম আয়সা খাতুন। আবদুল লতিফ ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। চার ভাই ও চার বােনের মধ্যে শফী ছিলেন সবার ছােট। শফী ১৯৩০ সালে হুগলি জেলা হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৩২ সালে তিনি হাওড়া সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে আই. এসসি. পাস করেন। মুহাম্মদ শফী ১৯৩৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এম. বি. বি, এস, পাস করেন। তিনি ডেন্টিস্ট্রিতে ডিপ্লোমা করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কিছুদিন কলকাতায় ‘ডা, আর, আহমদ ডেন্টাল ল্যাবরেটরিতে ডেন্টাল সার্জন হিসাবে কাজ করেছেন। পরে তিনি চট্টগ্রামে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। এখানে তিনি চট্টগ্রাম জেলের চুক্তিভিত্তিক দন্ত চিকিৎসক ছিলেন। ছবি আঁকা, ছবি তােলা বা ফটোগ্রাফি, দাবা খেলা এবং বেহালা বাজানাে ছিল তাঁর শখ। বেহালা বাদক হিসাবে তিনি কলকাতা বেতার ‘আকাশবাণী’র শিল্পী ছিলেন। এনগ্রেভিংয়েও তিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন। |মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার, বন্ধুবৎসল ও মানবদরদি। তার কাছে যারা চিকিৎসা করতে আসতেন, তাদের সাথে এমন বন্ধুত্ব হয়ে যেত যে পরে তারা কেউ চিকিৎসা করাতে এলে তিনি আর ফি নিতেন না। এমনকি তাদের পরিবারের কোনাে সদস্য বা আত্মীয় এলেও বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন শফী। 
ডা. শফী বামপন্থি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রান্তিক’ ও ‘জাগৃতি’র তিনি ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপােষক। এ সংগঠন দুটিকে তিনি অকাতরে অর্থ সহযােগিতা করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন শফী। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের উদ্যোক্তা ও কর্মীদের নানাভাবে সহায়তা ও উৎসাহ দিয়েছেন। ডা. শফী চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারের ‘মুশতারী লজ’ নামের বাড়িতে বাস করতেন। ২৭ মার্চ স্থানীয় ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন আর রশীদ তাঁর বাড়ির দোতলায় বেশকিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ লুকিয়ে রাখেন। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, যুদ্ধ শুরু হলে এই অস্ত্র কাজে লাগবে। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তারা আর সে অস্ত্র সরিয়ে ফেলার সুযােগ পাননি। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সকালে তাঁর বাসাভবনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হানা দেয় এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। শফীকে সার্কিট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে ডা. শফীর রােগী একজন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। করেন। ডা. শফী বাসায় ফিরে আসতে না আসতেই বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আরেকটি দল পুনরায় তার বাসায় হানা দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে প্রতিবেশী দুজন অবাঙালির যৌথ স্বাক্ষরিত একটি অভিযােগপত্র ছিল। এই লিখিত অভিযােগে বলা হয়েছিল যে ডা. শফীর বাসায় আওয়ামী লীগের সভা হয়, হিন্দু রবীন্দ্র সঙ্গীতের জলসা হয়, জয় বাংলা রেডিওর কর্মীরা এখানে থাকে, ডা. শফী ভারতের গুপ্তচর, তাঁর স্ত্রী মুশতারী শফী আওয়ামী লীগের নেতা এবং পাকিস্তানবিরােধী মিছিল করেছেন ইত্যাদি। এবার পাক বাহিনীর সদস্যরা ওই লুকানাে আগ্নেয়াস্ত্রের খোঁজ পেয়ে যায়। তারা ডা, শফীর সাথে তার শ্যালক, মুশতারী শফীর একমাত্র ছােটভাই খােন্দকার এহসানুল হক আনসারীকেও ধরে নিয়ে যায়। তার কেউ আর ফিরে আসেননি, তাদের কোনাে খবরও পাওয়া যায়নি।
তার স্ত্রী মুশতারী শফীর স্মৃতিচারণ থেকে ডা. মুহাম্মদ শফী এবং সে সময়ের ঘটনাবলি সম্পর্কে জানা যায়। তিনি লিখেছেন :
তার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তার সদাহাস্য প্রাণচঞ্চল আমুদে। স্বভাব, তারুণ্য, আমার প্রতি উদার মনােভাব, অগাধ ভালােবাসা আমাকে অভিভূত করেছিল। আমি যেন এক নিশ্চিত আশ্রয় পেলাম। শিশুকালে মাতপিতৃহীনা হওয়ায় আমার লেখাপড়া তেমন হয়নি, কিন্তু তিনি আমার শিক্ষার পিপাসা মেটাতে চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গৃহশিক্ষক রেখে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম, পরে গিটার শিক্ষা- সবকিছুতেই তিনি যেন আমাকে পুরােপুরিভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।. তিনি চট্টগ্রাম জেলের রাজবন্দিদের চুক্তির ভিত্তিতে চিকিৎসা করতেন। আর এ জন্যই তাঁর পক্ষে আরও সম্ভব হয়েছিল গােপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া। মাঝে মধ্যে কড়া পুলিশ প্রহরায় রাজবন্দিদের নিয়ে আসা হতাে আমাদের গৃহসংলগ্ন তার চেম্বারে। জেল কর্তৃপক্ষকে বলে এ কাজটি তিনিই করেছিলেন কৌশলে। বিয়ের পর থেকেই দেখছি বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত। চলছে রাজনৈতিক আডডা, মাঝে মধ্যে গণসঙ্গীতের আসর। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলে অনেক রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হন, অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন, তাঁরা আসতেন । গভীর রাতে হঠাৎ হঠাৎ। ডা. শফীকে দেখতাম তখন আনন্দে আত্মহারা হতে।
ডা. শফী নারীশিক্ষার ব্যাপারে প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করতেন গভীরভাবে।  সেই সাথে বিশ্বাস করতেন, নারীর সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ছাড়া সামাজিক কল্যাণ এবং দেশের অগ্রগতি কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই তার একান্ত সাহায্য-সহযােগিতায় আমি গড়ে তুলেছিলাম বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। … ১৯৬৮ সালে সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ক্ষুদ্র ছাপাখানা আমরা প্রতিষ্ঠা করি আমারই বাসগৃহে। এই প্রেস প্রতিষ্ঠার পেছনেও ডা. শফীর ছিল অপরিসীম উৎসাহ। ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালি নিধন চলছে পুরােদমে। এ সময় একদিন আমাদের পাড়ায় এনায়েত বাজারের বাঙালি ছেলেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে দা, ছুরি, হকিস্টিক, লােহার রড ইত্যাদি নিয়ে অবাঙালি বাড়ি আক্রমণ করতে হৈহৈ করে ছুটে এল। আমাদের এই এলাকায় আগাখানি ও বােহরা সম্প্রদায়ের অবাঙালি। ব্যবসায়ীদের বসবাস বেশি। ডা. শফীকে দেখলাম সেই ক্ষুব্ধ জনতার সামনে। ছুটে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে, বক্তৃতা করে, বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের আদর্শ ব্যাখ্যা করে, এমনকি নিজের জীবনদানের জন্য প্রস্তুত বলে জানালে সেই উন্মত্ত জনতা থেমে যায়, ফিরে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল তার রােগী।
ডা. শফীর আরেকটি গুণ ছিল দরিদ্র প্রতিবেশী এবং শ্রমজীবী মানুষদের কাছ থেকে কখনােই ফি নিতেন না। শুধু তাই নয়, অনেকেই বুঝত না ‘ডেন্টাল সার্জন’ মানে কেবলই দাঁতের চিকিৎসক। সাইনবাের্ডে ‘ডাক্তার’ লেখা আছে, তাই যে কোনাে রােগের জন্যই ওরা আসত, এমনকি গভীর রাতেও আসত। তিনি। বিরক্ত হতেন না, দেখতাম হাসিমুখে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ দিচ্ছেন। বড় রকমের কিছু হলে চিঠি লিখে পাঠাতেন অন্য ডাক্তারের কাছে, যাতে ফি না নেয় । অথবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন, ভালাে না হওয়া পর্যন্ত খোঁজখবর নিতেন। এ কারণেই তিনি সবার পরিচিত ছিলেন, অনেকেই তাকে ভালােবাসত, শ্রদ্ধা করত, আর তাই অবাঙালি প্রতিবেশীরাও সেদিন রক্ষা পেয়েছিল।  এলাে ৭ এপ্রিল। যে তারিখটি রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে আছে আমার বুকের গভীরে।  সকাল ৯টা। একটা জিপ আর একটা লরি এসে থামল বাড়ির সামনে। চোখের নিমেষে সৈন্যরা আমার বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারপর ড্রইংরুমের দরজায় দুমদুম ধাক্কা। ডা. শফী নিজেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন, ওরা জানতে চাইল, “ডা. শফী কে?” তিনি বললেন, “আমি।” “তুমি এখানে দাঁড়াও”- ওঁকে ড্রইংরুমে দাঁড় করিয়ে রাখল। সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির ভেতরে। প্রতিটি রুম, বাথরুম, রান্নাঘর তছনছ করে খুঁজল। ভয়ে আমি কাঠ।
যদি এবার দোতলায় যায় এবং তালা ভাঙে তারপর? কিন্তু না, ওরা দোতলায় গেল না। অফিসারকে কী যেন বলে লরিতে গিয়ে উঠল, সাথে ডা. শফীকেও নিয়ে গেল সার্কিট হাউসে। আমার আকুল অনুনয়-বিনয়, বাচ্চাদের কান্না, কোনাে কিছুতেই ওদের মন গলল না। কিন্তু না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুপুর ১২টার দিকে তিনি ফিরে এলেন। চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না, ডা. শফী আমার সামনে দাড়িয়ে। বাচ্চারা আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে ওদের আব্বাকে। সবার হাজার প্রশ্ন, “কী করে এ সম্ভব হলাে?” ডা. শফী মিন হেসে বললেন, “ফিরে এসেছি ব্রিগেডিয়ার বেগের জন্য। মীর্জা আসলাম বেগ ছিলেন ডা. শফীর রােগী। জেনারেল বেগের দাঁতে। ক্যান্সার হয়েছে, এই তথ্য মিথ্যে প্রমাণ করে তিনি তাকে সুস্থ করে। তুলেছিলেন। আমি এবার কেঁদে বললাম, “এসেছে যখন আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে নয়, এক্ষুণি চল অন্য কোথাও।” তিনি এবার রাজি। বললেন, “নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু এই দিনের বেলা বেরুতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা। সবার দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। সন্ধ্যা হােক।”
দুপুর ১টা। ভাত দেওয়া হয়েছে টেবিলে। বাচ্চাদের নিয়ে তিনি সবে খেতে বসেছেন। আবার গুলির শব্দ, বেরিয়ে দেখি ৪০-৫০ জন সৈন্য আমার বাড়ি আবার ঘিরে ফেলেছে। এরা অন্য গ্রুপ। সাথে দুজন অফিসার। সৈন্যরা আবার ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। ডা. শফী খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন ওদের সামনে। আমিও গেলাম ওর সাথে। আমার ভাই এহসানও এসে দাড়াল পাশে। ওরা বলল, “তুমি আর তােমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে এলিগেশন আছে। তােমরা আওয়ামী লীগ করাে। গােপন রেডিওর সাথে যুক্ত, তােমাদের এখানে গােপন অস্ত্রও আছে।” শেষের কথায় বুকটা ধড়াস করে উঠলাে। এত যে সাহসী ডা. শফী, তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ আমিই সাহসের সাথে প্রতিবাদ করলে ওরা। হেসে একটা টাইপ করা কাগজ খুলে ধরেছিল আমাদের চোখের সামনে। হ্যা, এক, দুই করে এগারােটি অভিযােগ রয়েছে আমাদের নামে। আর তাতে স্বাক্ষর রয়েছে আমাদের অবাঙালি প্রতিবেশী দুজনের, তার মধ্যে একজন ডাক্তার। এদেরকেই ডা. শফী একদিন বাঁচিয়েছিলেন। সৈন্যরা এবার দুপদাপ শব্দে উঠে । গেল দোতলায়। ওরা দুমদাম শব্দে তালা ভাঙছে। সে সময়ের অনুভূতি প্রকাশের। ভাষা নেই। আমরা মৃত্যুর প্রহর গুনছি। তালা ভাঙা শেষ হতেই ওরা উত্তেজনায় ছুটে এল। হড়বড়িয়ে মেজরদের কী বলতেই “হােয়াট” বলে হুঙ্কার ছাড়ল মেজর । আগুন ঝরছে ওদের চোখে মুখে কুটিল হাসি। বলল, “চল উপরে।” আমরা তিনজনই ওদের সাথে গেলাম উপরে। মেজর বােখারী মুচকি হেসে বলল, “মিসেস শফী, তুমি বললে তােমার ভাড়াটিয়ারা এসব রেখে গেছেন গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। দেখ তাে প্রতিটি বাক্সের ওপর কত তারিখ আছে?”
আমরা তিনজনই প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখলাম প্রতিটি বাক্সের ওপর লাল কালিতে ইংরেজিতে লেখা ২৭.০৩.১৯৭১। ওরা এবার ডা. শফী আর এহসানকে দিয়েই বাক্সগুলাে ট্রাকে তুলল। আর আমি নির্বাক দাড়িয়ে থেকে মনে মনে বললাম, “হারুন ভাই, এ আপনি কী করলেন?” আমরা তৈরি হলাম। কিন্তু না, ওরা আমাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করল না। গুলির বাক্সগুলাে ট্রাকে তােলা হলে আমাদের তিনজনকে বলল জিপে উঠতে। আমার ভাই এহসান অনুমতি চাইল ওদের কাছে, “আমি একটু অজু করে আসি।” ওরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে বলল, “যাও।” আমি বােবা কান্নায় ইশারায় বললাম, তুই আর এখানে আসিস না ভাই, পালিয়ে যা। কিন্তু না, এহসান ঠিক অজু করে লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরে এল। বাচ্চাদের কান্না-চিল্কার পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম জিপের কাছে। উঠতে যাব, দুই মেজর পাঞ্জাবি ভাষায় নিজেরা কী যেন বলল; তারপর একজন আমাকে বলল উর্দুতে, “মিসেস শফী তুমি এখন থাকো। তােমার বাচ্চারা বড় বেশি কাদছে। প্রয়ােজন হলে পরে নেব তােমাকে। কিন্তু খবরদার, পালাবার চেষ্টা করবে না। তাহলে তােমার স্বামী আর ভাইকে তাে পাবেই না, বাড়িটাও ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেব।”
 এই প্রথম আমি মেজরের দুই হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম, “তােমরা তাে। আমার ভাই আর স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছ, এই ছােট ছােট বাচ্চাদের নিয়ে আমি কোথায় যেতে পারি? কিন্তু তােমরা কথা দিয়ে যাও ওদের ফিরিয়ে দেবে?” ওরা বলেছিল, “আমরা কথা দিচ্ছি ওরা ফিরে আসবে।” পাঠান-পাঞ্জাবিরা নাকি মিথ্যা কথা বলে না! তবু ওই সময় ওদের ওই কথা আমি পুরােপুরি বিশ্বাস না করলেও মনে হলাে ডা. শফী যেন বিশ্বাস করেছিলেন। তাই তাঁর মুখ সামান্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল প্রচ্ছন্ন আশায়। আমাকে শেষ কথা বলেছিলেন, “তুমি ভেবাে না, ঘরে যাও বাচ্চাদের কাছে। দেখাে, আমি আবার ঠিক ফিরে আসব।” না, তিনি আর ফিরে আসেননি। ডা, মুহাম্মদ শফীর বিয়ে হয় ১৯৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি, বেগম মুশতারী । শফীর সাথে। তাদের সংসারে তিন ছেলে ও চার মেয়ে ছিল। মুশতারী শফী একজন সাহিত্যিক এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!