You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাদার তেরেসা এবং শরনার্থী, যুদ্ধশিশু ও বীরাঙ্গনারা
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মিশনারিজ অব চ্যারিটি এবং মাদার তেরেসার শিশু ভবন স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কলকাতা থেকে মাদার তেরেসা ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ঢাকা এসে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

যখন তারা বাংলাদেশের অবমানিতা নারীদের অবস্থা বিষয়ে আলােচনা করেন, নতুন সরকারের কোনাে ধারণা ছিল না কী করবেন । দেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানে জেলে বন্দি ছিলেন। সময়ের গুরুত্ব বুঝে প্রেসিডেন্ট ইসলাম মাদার তেরেসাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাদারকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার মনে করেন মাদার তেরেসার সঙ্গে অবমানিতা নারী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করবার উপযুক্ত সময় এটা। সরকার মাদার তেরেসার উপর সম্পূর্ণ অস্থাশীল ছিলেন। কারণ ততদিনে তিনি সারা বিশ্বে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছেন। পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে প্রেসিডেন্ট মাদারকে অনুরােধ করেন তিনি যেন দুস্থ নারীদের মুক্তি বিষয়ক কর্মসূচি নিয়ে সরকারের সহায়তায় এগিয়ে আসেন।

ঐ সময় পুরনাে ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে অবস্থিত ৩৫০ বছরের পুরনাে পর্তুগিজ মনাস্টারিতে আটজন মিশনারিজ অব চ্যারিটির সন্ন্যাসিনী ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য একটি আশ্রয কেন্দ্র চালু রেখেছিলেন। তিন সপ্তাহের মাথায় মাদার তেরেসা আবার ঢাকায় এলেন ‘৭২ এর জানুয়ারি মাসে। সঙ্গে নিয়ে এলেন চারজন ভারতীয় সন্ন্যাসিনী এবং দুজন নার্স, প্রতিষ্ঠা করলেন শিশু ভবন, তাঁর সেবা কেন্দ্র।

সংক্ষেপে সিস্টারদের কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, সন্তানসম্ভবা কোনাে মহিলাকে কখনাে কোনাে ধরনের প্রশ্ন (যেমন- কোথায়, কখন এবং কীভাবে গর্ভধারণকরেন বা কে সন্তানের বাবা ইত্যাদি সম্পর্কে) যেন জিজ্ঞাসা করা না হয়; প্রত্যেক অন্তঃস্বত্তা মহিলাকেও নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল তাদের গর্ভধারণের বিষয়ে তারা কখনাে কোনাে প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন না । ঢাকাস্থ মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপিরিয়র সিস্টার ম্যারি তার স্মৃতিচারণে বলেন গর্ভবতী মাকে তার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, ধর্ষণের শিকার নারী তার অবমাননা বিষয়ে কিছুই বলবেন না বা তাকে বলতে বাধ্য করার চেষ্টা করা যাবে না। এ ধরনের নিশ্চয়তাদানের জন্য সন্তানসম্ভবারা অনেক স্বস্তিবােধ করেন এবং গর্ভমােচনের পরিবর্তে সন্তান প্রসবের সিদ্ধান্ত নেন।

প্রকৃত প্রস্তাবে বহু গর্ভবতী নারী গর্ভনাশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন । আবার অনেকে ব্যক্তিগতভাবে গর্ভনাশের বিরােধিতা করেছেন। কিন্তু তাদের বেলায় ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে বলপ্রয়ােগপূর্বক গর্ভধারণ হয়েছিল, সে বিষয়টা নিয়েও অসহনীয় দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন। ভাগ্যক্রমে মাদার তেরেসা যখন কলকাতা থেকে ঢাকা এলেন, তিনি জানালেন, গর্ভবতী নারীর উচিত গর্ভধারণের পূর্ণ মেয়াদ পার করে সন্তান প্রসব করা, বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাগত জানান। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার এবং মাদার তেরেসার দৃষ্টিভঙ্গিতে এ বিষয়ে অনেক পার্থক্য ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গর্ভনাশের জন্য কোনাে ধরনের চাপ ছিল না। সরকার গর্ভনাশ ও গর্ভপাতের সিদ্ধান্তটি অন্তঃসত্ত্বাদের উপর ছেড়ে দিয়ে দুবিষয়ে তাদের দায়িত্ব নেন।

সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, ১৯৭২-এর সে সংকটময় সময়ে সরকারের অবস্থান সুস্পষ্ট ছিল। যে মূল বাতাটা সরকার সংবেদনশীলতার সাথে নির্যাতিত নারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে খুব কৌশলে এবং বিচক্ষণতার সাথে গােপণীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়ে পৌঁছানাের চেষ্টা করেন, সেটার বক্তব্যটি ছিল এরকমঃ সরকারি নীতি অনুসারে যারা গর্ভমােচনের পক্ষে, তারা গােপনে গর্ভনাশে সরকারের সকল সহযােগিতা পাবেন । যেক্ষেত্রে গর্ভমােচন করার সময় থাকবে না, সেক্ষেত্রে গর্ভিনীকে সন্তান প্রসবে উৎসাহ দিতে হবে; নবজাতককে লিখিতভাবে পরিত্যাগ করে জন্মদাত্রী মা তাকে সরকারের প্রত্নে রেখে চলে যেতে পারবেন। তখন সেবা সদন, নারী পুনর্বাসন বাের্ড, শিশু ভবন এবং বেবি হােমের বাইরেও কিছু আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়েছিল। একদিকে বিষয়টির গােপনীয়তা রক্ষা করা, অন্যদিকে যতদূর পর্যন্ত সম্ভব এ উদ্যোগ সম্পর্কে তথ্য পৌছে দেয়ার মধ্যে যে দ্বন্ধ, সে। দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হওয়াতে সরকারকে যথেষ্ঠ সাবধানতার সাথে কাজ করতে হয়েছিল । এ বিশেষ সংবাদ বা সরকারের উদ্যোগটি সবার কাছে পৌছানাের বিষয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও সরকার মােটামুটিভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র এ সংবাদ পৌঁছাতে সফল হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ অজানা সংখ্যক ধর্ষিতা ও অবমানিতা ও তাদের নবজাতকদের ১৯৭২ সালে আশ্রয় দিয়ে সন্তানসম্ভবাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়েই আশ্রম ও বেবি হােমের সবাই মিলে এক সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করেন।

এছাড়া মায়ের গর্ভে মৃত্যু হয়েছিল (স্টিল বার্থ) এমন শিশু, অপুষ্ট ও অপরিণত নবজাতকের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না, যদিও এর কোনাে সঠিক হিসাব নেই। সেবা সদন ও শিশু ভবনে যারা ছিলেন, তাদের অনেকের প্রসবকালে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। যার মধ্যে মায়েদের উচ্চরক্ত চাপের কেইস ও মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই শিশুজন্মের কারণে ঘটেছিল। আর প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবিলা করার পর শিশু ভবনের নথিপত্র পরীক্ষা করার সময় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক ছিল। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, শিশুদেরকে যথাযথভাবে কোনাে বিশেষ সংজ্ঞায় অন্তর্ভূক্ত না করে তাদেরকে নানাভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন, এই শিশুদের কখনাে বলা হয়েছে “অনাথ,’ পিতৃমাতৃহীন, বেআইনি’, রাস্তায় পাওয়া’ ইত্যাদি। কাজেই নথিপত্র পরীক্ষার সময় যে বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হয়েছে তা হলাে শিশুটির জন্মের তারিখ । লক্ষনীয়,

আমরা ভূমিকাতে যুদ্ধশিশু ও প্রাসঙ্গিক শব্দের (যেমন “অনাথ,” “পরিত্যক্ত শিশু” এবং “যুদ্ধশিশু”) পার্থক্য নিরূপণ করে যথাযথ ব্যাখ্যা রেখেছি।

যুদ্ধশিশুর বাইরেও রয়েছে পরিত্যক্ত শিশু, অনাথ, পিতৃমাতৃহীন শিশু, ইত্যাদি। এরা কেউই যুদ্ধশিশুর সংজ্ঞায় পড়ে না। এরা পাকিস্তানি সৈন্যদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেনি। সে সময়ের খবরের কাগজের প্রতিবেদনে যুদ্ধশিশু নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ হয়েছিল সেসব অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নারী পুনর্বাসন বাের্ড কর্তৃক ১৯৭২ সালে যে ২২টি সেবা সদন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ শিশুর জন্ম হয়েছিল। অবশ্য একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, এ সংখ্যার সাথে সরকারের নির্ধারিত পরিসংখ্যানের মিল রয়েছে।
রেফারেন্স – ৭১-এর যুদ্ধশিশু – অবিদিত ইতিহাস – মুস্তফা চৌধুরী
সংগ্রামের নোটবুক

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!