মুনীর চৌধুরী
নাট্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যসমালােচক মুনীর চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ শহরে। যদিও তাঁদের পৈতৃক নিবাস নােয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার গােপাইরবাগ গ্রামে। তার বাবা খানবাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর মায়ের নাম আফিয়া বেগম। মুনীরের পারিবারিক নাম ‘আবু নয়ীম মােহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। ১৪ ভাইবােনের মধ্যে মুনীর চৌধুরী ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং ছােটবােন ফেরদৌসী মজুমদার দুজনেই নিজ নিজ প্রতিভায় খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। মুনীর চৌধুরীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় বগুড়ায়। এরপর তিনি পড়াশােনা করেন পিরােজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৩৬ সালে তার বাবা ঢাকায় বদলি হলে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে (বর্তমান ঢাকা কলেজ) ভর্তি হন। ছােটবেলা থেকেই মুনীর ছিলেন প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের। কৈশােরে এসে তা আরও বেড়ে যায়। স্কুল জীবনের শেষ দুটি বছর তাকে সিনেমার নেশায় পেয়ে বসেছিল। এজন্য তিনি স্কুল ফাঁকি দিতেন। সে সময়ে ঢাকার ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে গিয়ে ইংরেজি সিনেমাই বেশি দেখতেন মুনীর। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি পড়তে যান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৪৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে আই, এসসি, পাস করেন। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে মুনীরের তেমন আগ্রহ ছিল না, তাঁর আগ্রহ ছিল সাহিত্যে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগারে তার যােগাযােগ ঘটে বিশ্বসাহিত্যের মহান লেখক ও তাঁদের রচনার সাথে। বলতে গেলে মুনীরের জন্মই হয়েছে বইয়ের মাঝে। তার ১৪ বছর বয়সে বাবা তাকে সাতাশ খণ্ডের ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এনে দিয়েছিলেন।
সিলেবাসের বাইরে পড়াশােনা, নিয়মিত আডডা, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানােসবমিলে ক্লাসের পড়াশােনায় ব্যাপক ঘাটতি পড়ে তার। আই. এসসি, চূড়ান্ত পরীক্ষায় দুই বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়েই তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ছেলের এমন খেয়ালি সিদ্ধান্তে আবদুল হালিম ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন। তবে মেধার জোরে দেওয়া পরীক্ষাগুলাে ভালাে হয়েছিল বলেই অপ্রত্যাশিতভাবেই মুনীর ১৯৪৩ সালে আই. এসসি.তে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে পাস করেন। সে বছরেই নিজের আগ্রহ এবং বড় ভাই কবীর চৌধুরীর প্রেরণায় মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মুনীর চৌধুরীর জীবন নতুন বাঁক নেয়। রবি গুহ, দেবপ্রসাদ, মদন বসাক, সরদার ফজলুল করিম- এঁরা প্রত্যেকেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল মুখ। এ সময় মুনীর বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গােস্বামী, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখ প্রগতিশীল লেখক ও রাজনীতিকের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। বক্তৃতায় বিশেষ দক্ষতার কারণে ছাত্রজীবনের প্রথম বছরে ১৯৪৩ সালেই তিনি হলের সেরা বক্তা হিসাবে ‘প্রােভােস্টস কাপ’ জেতেন। ১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযােগিতায় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জেতেন মুনীর। চৌধুরী। ছাত্রাবস্থাতেই এক অঙ্কের নাটক ‘রাজার জন্মদিনে’ লিখেছিলেন, যা ছাত্র সংসদ মঞ্চস্থ করেছিল। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে খুব বেশি সক্রিয় থাকার কারণে তার অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষার ফল তেমন ভালাে হয়নি। মুনীর। চৌধুরী ১৯৪৬ সালে ইংরেজিতে অনার্স এবং ১৯৪৭ সালে মাস্টার্স পাস করেন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছিলেন।
১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকার বামপন্থি সংগঠন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’তে যােগ দেন। স্বরচিত কবিতা পাঠ ও রাজনৈতিক আলােচনা ছাড়াও এ সংঘের উদ্যোগে ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলার কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন। বামপন্থি রাজনীতিতে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে তাঁকে সলিমুল্লাহ হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে প্রথম ছাত্রসভা হয়, তাতে মুনীর বক্তৃতা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে মুনীর চৌধুরী কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে যােগ দেন। ওই বছরেরই শেষ দিকে তিনি প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। মুনীর চৌধুরী ও ছােট বোেন নাদেরা বেগমের বামপন্থি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেওয়া তাদের বাবা কোনােভাবেই মেনে নিতে পারেননি। বিশেষত তাঁর সরকারি চাকরির জন্যে এটা ছিল একটা সমস্যা। কিন্তু নিষেধ করার পরও যখন দুই সন্তানকে রাজনীতি থেকে ফেরাতে পারলেন না, তখন হালিম চৌধুরী তাদের লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দেন। সে সময় মা আফিয়া বেগম ও বড় ভাই কবীর চৌধুরী তাদের নানাভাবে সহযােগিতা করতেন। এ সময় মুনীর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্য নাটক লিখে আয় করেছেন।
১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসাবে যােগ দেন। সেখানে তিনি কিছুদিন বাংলাও পড়িয়েছিলেন। ওই বছর মার্চে তিনি ঢাকায় এসে রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে গ্রেফতার হন, তবে রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড়া পান। একই বছর লিলি মীর্জার সাথে তার বিয়ে হয়। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে যােগ দেন এবং সে বছরই আগস্ট মাসে। ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ােগ পান। মুনীর রাজনীতি থেকে বেশি দূরে থাকতে পারেননি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গিয়ে পুলিশের ধাক্কায় তিনি পড়ে যান। এর পরের দিন, অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভার আহ্বান করা হয়েছিল যার প্রধান উদ্যোক্তার একজন ছিলেন মুনীর চৌধুরী। এই ঘটনায় তখনই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পাকিস্তান সরকারের বৈরী দৃষ্টিতে পড়লেন তিনি। ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের প্রতিবাদ সভা আহ্বান করতে গিয়ে জননিরাপত্তা আইনে আরও দুজন শিক্ষকের সাথে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমে বন্দি শিক্ষকদের সাময়িকভাবে পদচ্যুত করে। মুনীর চৌধুরীর চাকরি অস্থায়ী হওয়ায় কারণে সিদ্ধান্ত জানানাে হয় যে ৬ জুলাই রমজানের ছুটি শেষে তিনি চাকরিতে যােগ দিতে না পারলে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই তার চাকরি থাকবে না। মুনীর চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিবেচনার আবেদন জানালে তা বাতিল হয়। এ সময় প্রায় দুই বছর তিনি দিনাজপুর ও ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। ঢাকা কারাগারে তার সাথে অন্য রাজবন্দিদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, মােজাফফর আহমদ, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অজিত গুহ ও শেখ মুজিবুর রহমান, আর অন্য কক্ষে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তসহ ৬০-৭০ জন কমিউনিস্ট।
দেখতে দেখতে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস চলে এল। রণেশ দাশগুপ্ত তার পূর্বপরিচিত এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সহকর্মী ছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার কাছে গােপনে চিঠি পাঠালেন, জেলখানায় করার মতাে একটি নাটক লিখে দিতে। তিনি মুনীরকে আরও জানালেন, রাত ১০টার পর আলাে নিভে গেলে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। এই অনুরােধের ভিত্তিতে মুনীর চৌধুরী রচনা করেন একাঙ্কিকা ‘কবর’, যা তার শ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ‘কবর’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় জেলখানার ভেতরে, যাতে কারাবন্দিরাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। যেসব ছাত্রবন্দি রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে লেখাপড়া করতেন, তাদের ৮-১০টি হারিকেনের আলােয় মঞ্চ সাজিয়ে তাঁর লেখা নাটকটি সেদিন মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকটি এমনভাবে লেখা হয়েছিল যাতে পুরুষ অভিনেতারাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছিলেন। সঙ্গী কারাবন্দি অধ্যাপক অজিত গুহের কাছ থেকে তিনি প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের পাঠ নেন। নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে কারাগারে থেকেই ১৯৫৩ সালে। বাংলায় প্রাথমিক এম. এ. পরীক্ষা দেন ও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে অন্য রাজবন্দিদের সাথে তিনিও মুক্তি পান। মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করে। তাকে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানাে হয়। আবার জেলে বসেই তিনি বাংলায় এম, এ. শেষ পর্ব পরীক্ষা দিলেন। এবারও তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেলেন। ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি মুক্তি পান।
এরপর আরও একবার তিনি বন্দি হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জে. এল. টার্নারের সুপারিশে ড. ডব্লিউ এ. জেনকিনসের নির্দেশে মুনীর চৌধুরীকে ইংরেজি বিভাগে নিয়ােগ দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রচেষ্টায় বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে নিয়ােগ পান। পরে ৮ আগস্ট তাঁকে বাংলা বিভাগে বদলি করে স্থায়ী পদে আনা হয়। মুনীর চৌধুরী ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে রকফেলার বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই বছর সেপ্টেম্বরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬২ সালে তিনি সহযােগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বাের্ডের উদ্যোগে বাংলা টাইপরাইটারের জন্য উন্নতমানের কি-বাের্ড উদ্ভাবন করেন, যার নাম ‘মুনীর অপূ টিমা’। ১৯৬৫ সালে “An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter শীর্ষক পুস্তিকায় তিনি তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন। এই নতুন টাইপরাইটার নির্মাণের লক্ষ্যে তিনি বেশ কয়েকবার পূর্ব জার্মানি গিয়েছেন।। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-সংস্কার কমিটির রিপাের্টের অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর তীব্র সমালােচনা করে মুনীর চৌধুরী একটি দীর্ঘ ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫৯ সালের ২৭ এপ্রিল প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমিতে পড়া হয়। সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে এই প্রবন্ধে মুসলিমদেরধর্মবিশ্বাসে আঘাতের অভিযােগ তােলে। ১৯৬১ সালে অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও তিনি উদ্যোগী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করলেন। ১৯৬২ সালে মুনীর চৌধুরী প্রভাষক থেকে রিডার পদে উন্নীত হন এবং এই বছরেই ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি জাপানের টোকিওতে নাট্যসম্মেলনে যােগ দিতে যান। টোকিও থেকে ফিরে তিনি ঢাকা আর্টস কাউন্সিলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেন। এ সময়েই তিনি ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাটক প্রযােজনা করেন।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিলে যে ১৯ জন নাগরিক বিবৃতি দিয়ে ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিল, মুনীর তাদের মধ্যে একজন। ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি সরকারি চাহিদা মতাে রিপাের্ট পেশ করে। এই কমিটির তিনজন বিশেষজ্ঞ অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই, ড. এনামুল হক ও মুনীর চৌধুরী লিপি সংস্কারের বিরােধিতা করে আরেকটি রিপাের্ট উত্থাপন করলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল তখন সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেনের নেতৃত্বে সংস্কার কমিটির রিপাের্টটি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুনীর চৌধুরী তখন যুক্তিনিষ্ঠভাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সরকারের এই প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। ১৯৬৯ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই অকালে মৃত্যুবরণ করলে তার স্থানে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। এ বছরই তার বাবা হালিম চৌধুরী মারা যান। ১৯৭১ সালে মুনীর চৌধুরী কলা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হন।
মুনীর চৌধুরীর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘সতেরাে শতাব্দীর “হেয়করি” কবিতা (ফাল্গুন ১৩৪৯) নামের একটি প্রবন্ধ এবং ‘নগ্ন-পা’ (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৯) নামের একটি ছােটগল্প । এ দুটি রচনাই ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তবে মুনীর চৌধুরী নিজের প্রথম রচনা হিসাবে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন ‘আসুন চুরি করি’ নামের একট প্রবন্ধকে। প্রথম জীবনে তিনি বেশ কিছু ছােটগল্প লিখেছিলেন। কিন্তু তার প্রধান আকর্ষণ ছিল নাটকের প্রতি। নাটকের মধ্যে আবার একাঙ্কিকার প্রতিই তাঁর ঝোক ছিল বেশি। ছােটগল্প বা নাটক যাই রচনা করুন না কেন, সবক্ষেত্রেই তার রচনার বিষয়বস্তু ছিল সমকালীন সমাজজীবনের বৈষম্য ও বিকার। মুনীর চৌধুরীর। নাটকে কৌতুকপ্রবণতা, ঘটনাবিন্যাস এবং বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের কারণে খুবই উপভােগ্য। ১৯৪৭-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে মুনীর চৌধুরী ছিলেন নতুন ধরনের নাটকের পথিকৃৎ। তিনি মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমে নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
‘কবর’ (১৯৬৬), দণ্ডকারণ্য’ (১৯৬৬) এবং পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯) বইতে তার ১২টি মৌলিক নাটক সংকলিত হয়েছে। কবর’ নাটকের মতাে রাজনৈতিক চেতনার এমন সূক্ষ্ম প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে খুব কমই দেখা যায়। এই বইতে প্রকাশিত অন্য নাটক দুটি হলাে ‘মানুষ’ এবং ‘নষ্ট ছেলে। “মানুষ” নাটকটির বিষয়বস্তু অসাম্প্রদায়িকতা। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা তাঁর পূর্ণাঙ্গ মৌলিক নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (১৯৫৯)। এ নাটকের মূল চেতনায় আছে যুদ্ধবিরােধী এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে নরনারীর প্রেম। তার অপর পূর্ণাঙ্গ মৌলিক নাটক ‘চিঠি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। দণ্ডকারণ্য’ বইটিতে ছিল তিনটি নাটক : ‘দণ্ড’, ‘দণ্ডধর’ ও ‘দণ্ডকারণ্য’। পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য’ বইতে ছিল ছয়টি নাটক : ‘পলাশী ব্যারাক’, ‘ফিট কলম’, ‘আপনি কে’, ‘একতলা দোতলা’, ‘মিলিটারী’ এবং বংশধর। এছাড়া তার অন্য নাটকগুলাে হলাে : নওজোয়ান কবিতা মজলিস, ‘বেশরিয়তি’, ‘কুপােকাত’, ‘নেতা’, ‘মর্মান্তিক’, ‘একটি মশা’ ইত্যাদি। মুনীর চৌধুরী বিদেশি নাটকের অনুবাদেও অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তার অনুবাদ করা নাটকগুলাে হলাে : ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ (১৯৬৯, জর্জ বার্নার্ড শ), “রূপার কৌটা’ (১৯৬৯, জন গজওয়ার্নি), ‘মুখরা রমণী বশীকরণ” (১৯৭০, উইলিয়াম শেক্পিয়র), এবং জনক’ (১৯৭০, অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ) এবং একাঙ্কিকাগুলাে হলাে ‘গুৰ্গন খাঁর হীরা’ (১৯৬৮, অ্যালান মক্কহাউস) এবং ‘ললাটলিখন’ (১৯৬৯, রিচার্ড হিউস), “মহারাজা’ (১৯৬৮, ইডেন ফিলপটুস) এবং জমা খরচ ইজা (১৯৭৫, এলিয়ট ক্ৰশে উইলিয়াম)। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি নাটকের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। শেপিয়রের “ওথেলাে’ অনুবাদ শেষ করেন কবীর চৌধুরী। টেনেসি ইউলিয়ামসের ‘অ্যা স্ট্রিট কার নেমড় ডিজায়ার’ নাটকের অসমাপ্ত অনুবাদের কাজ শেষ করেন লিলি চৌধুরী, নাম দেন গাড়ির নাম বাসনাপুর।
সাহিত্য সমালােচনার ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরী এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। কোনাে কিছুর নিরাসক্ত মূল্যায়ন, দুটি ভাষার সাহিত্যকর্মের তুলনা, আবার একই চরিত্র বিভিন্ন নাট্যকারের হাতে কেমন রূপ নেয় ইত্যাদি বিশ্লেষণ তাঁর সমালােচনার মৌলনীতি। ‘মীর-মানস’ (১৯৬৫) ও তুলনামূলক সমালােচনা’ (১৯৬৯) বই দুটিতে সে পরিচয় পাওয়া যায়। মুনীর চৌধুরী ‘মীর মানস’ প্রবন্ধ সংকলনের জন্য দাউদ পুরস্কার এবং পাক-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে লেখা সাংবাদিকতাসুলভ রচনা সংকলন। ‘রণাঙ্গন’-এর জন্য ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি পান (১৯৬৬)। রণাঙ্গন’এ তাঁর সহলেখক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক ও রফিকুল ইসলাম। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘ড্রাইডেন ও ডি. এল. রায় (পরে তুলনামূলক সমালােচনা বইতে অন্তর্ভুক্ত) এবং ১৯৭০ সালে প্রকাশিত বাংলা গদ্যরীতি’ বইতে বাংলা গদ্যের, বিশেষত পূর্ব বাংলার সমকালীন বাংলা গদ্যরীতির পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক এক সম্মেলনে যােগ দিতে মুনীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সম্মেলন থেকে তিনি যখন ফিরলেন, বাংলাদেশ তখন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। চলছে অসহযােগ আন্দোলন। অসহযােগের সঙ্গে একাত্ম হতে মুনীর। চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করলেন। এ সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মুনীর চৌধুরীকে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি যেন রাষ্ট্রবিরােধী কোনাে কাজে জড়িত না হন। স্ত্রী লিলি চৌধুরী ও তিন ছেলে ভাষণ, মিশুক, তন্ময়কে নিয়ে তিনি তখন ফুলার রােডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন। চিঠি পাওয়ার পর সবদিক বিবেচনা করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি গিয়ে উঠলেন ঢাকার সেন্ট্রাল রােডের পৈতৃক বাড়িতে। এই বাড়ি থেকেই তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর বাহিনী। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২’তে মুনীর চৌধুরীর ছােট ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়ের দেওয়া জবানবন্দি থেকে সেদিনের ঘটনার বিবরণ জানা যায়। ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই দেওয়া জবানবন্দিতে তন্ময় জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে মুনীর চৌধুরীর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে দেশ স্বাধীন হতে চলেছে। এ বিষয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে আলােচনাও করেছেন। পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে সেন্ট্রাল রােডের বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তার মাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, বেলা ১টার দিকে ২০ নম্বর সেন্ট্রাল রােডের বাড়িতে গােসল সেরে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসবেন মুনীর চৌধুরী। ঠিক এমন সময় বাড়ির লােহার গেটে ঝন্ঝনানির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। দোতলা থেকে জানালার পর্দা সরিয়ে লিলি চৌধুরী দেখতে পান, একটি মিনিবাস দাঁড়িয়ে আছে যার জানালাগুলােতে কাদা লাগানাে এবং গাড়ির ছাদ ডালপালা দিয়ে ঢাকা । লিলি চৌধুরী ওই মিনিবাস থেকে ৩-৪ জন তরুণকে নামতে দেখেন। মুনীর চৌধুরীর ছােট ভাই শমসের চৌধুরী রুশাে দোতলা থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গেলে তরুণদের একজন তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি মুনীর চৌধুরী?” রুশাে উত্তরের বললেন যে মুনীর চৌধুরী তার বড় ভাই। তখন তরুণরা রুশােকে বলল যে উনি যেন মুনীর চৌধুরীকে ডেকে দেন। রুশাে দোতলায় গিয়ে মুনীর চৌধুরীকে এ খবর জানান। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা মুনীর চৌধুরী তখনই নিচে নামার জন্য পা বাড়ান। লিলি চৌধুরী মুনীর চৌধুরীকে যেতে নিষেধ করলে মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, “যাই, দেখি ওরা কী বলে।” মুনীর চৌধুরীর সাথে রুশােও নিচে নেমে আসেন। তখন লিলি চৌধুরীও তাদের পিছু পিছু নিচে নেমে আসেন।
রুশাে গিয়ে গেটের তালা খুলে দেন। মুনীর চৌধুরী ওই তরুণদের জিজ্ঞাসা করেন, “তােমরা কী চাও?” জবাবে তারা বলে, “স্যার, আপনাকে একটু আমাদের সাথে যেতে হবে।” মুনীর চৌধুরী একটু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তােমাদের কাছে কি ওয়ারেন্ট আছে?” এ কথা শুনে তরুণদের একজন আছে বলে মুনীর চৌধুরীর পিঠে বন্দুক চেপে ধরে। মুনীর চৌধুরী ছােট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রুশাে, যাই তাহলে।” ওই তরুণরা বন্দুকের মুখে ঠেলতে ঠেলতে মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে গাড়িতে তােলে। পেছনে দাঁড়িয়ে লিলি চৌধুরী এবং মুনীর চৌধুরীর মেজো ছেলে মিশুক মুনীর বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে পুরাে ঘটনাটি দেখেছেন। এ ঘটনার পর থেকে মুনীর চৌধুরীর আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পর বড় ভাই কবীর চৌধুরী এবং ছােট ভাই শমসের চৌধুরী রুশাে মিরপুর এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অনেক খুঁজেও বিকৃত, আধা বিকৃত বুদ্ধিজীবীদের লাশের মধ্যে মুনীর চৌধুরীর লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। মুনীর চৌধুরীসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং মােহাম্মদ আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু তারা বিদেশে থাকায় সে রায় এখনও কার্যকর করা যায়নি। মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী মঞ্চ, বেতার টেলিভিশন সব মাধ্যমে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। তাদের বড় ছেলে আহমেদ মুনীর ভাষণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মেজো ছেলে আশফাক মুনীর মিশুক (মিশুক মুনীর নামেই পরিচিত) ছিলেন এ দেশের একজন খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক, যিনি ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ছােট ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময় জাতিসংঘের অধীনে একটি সংস্থায় কাজ করেছেন।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা