You dont have javascript enabled! Please enable it!
মীর আবদুল কাইয়ুম
মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তিনজন শিক্ষক শহীদ হয়েছেন, তাঁদেরই একজন মীর আবদুল কাইয়ুম। তার জন্ম ১৯৩৯ সালের ৬ জুলাই, ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের ঘাগড়া গ্রামের মীরবাড়িতে। তাঁর বাবার নাম মীর সুবেদ আলী।  আবদুল কাইয়ুম ছােটবেলায় বাবাকে হারান। মীর আবদুল কাইয়ুম গফরগাঁও কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ময়মনসিংহের আনন্দ মােহন কলেজ থেকে বি. এ. পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনােবিজ্ঞান বিভাগে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে এম. এ. ডিগ্রি অর্জনের পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। আর তাই বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় বিশ্বাসী মীর আবদুল কাইয়ুম ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেলেও তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। তিনি দেশে থেকেই দেশের কথা ভেবেছেন এবং গােপনে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছেন। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনােবিজ্ঞান বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষক ছিল পাকিস্তানি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও ছিল অনেক অবাঙালি। তারা কেউ কেউ ছিল সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযােগী। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার কারণে মীর আবদুল কাইয়ুম তাদের, বিশেষত তার বিভাগের পাকিস্তানি শিক্ষকদের নজরে পড়ে যান।
মীর আবদুল কাইয়ুম থাকতেন মালােপাড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া বাসায়। মালােপাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষক থাকতেন। ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত শিক্ষক কোয়ার্টার না থাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মালােপাড়ায় শিক্ষকদের জন্য কিছু বাসা ভাড়া নিয়েছিল। একাত্তরের এপ্রিলে মীর আবদুল কাইয়ুমের মালােপাড়ার বাসা পাকিস্তানি সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণে তিনি ঘােড়ামারায় তার শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একাত্তরের ২৫ নভেম্বর রাতে তিনি ঘােড়ামারায় তার শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। তৈয়ব আলী নামের রেজিস্ট্রার বিভাগের এক অবাঙালি কর্মচারী সেদিন রাতে মীর আবদুল কাইয়ুমের কাছে এসে জানান, এক ক্যাপ্টেন তাঁকে দেখা করার জন্যে ডেকেছেন। তিনি প্রথমে যেতে চাননি। কিন্তু তৈয়ব আলী জানায় যে আপনি দেখা করেই ফিরে আসবেন। তৈয়বের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাইয়ুম দেখা করতে যান। কিছুক্ষণ পর তৈয়ব আলী কাইয়ুমের শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসে জানান, পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় ছিল, তারা তাকে জোহা হলে নিয়ে গেছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজশাহী শহর থেকে মীর আবদুল কাইয়ুমসহ মােট ১৪ জনকে (কারও মতে, ১৭ জন) ওই রাতে একই কায়দায় আটক করে। তারপর তাদের পদ্মা নদীর পাড়ে সরকারি বাংলাের সামনে বাবলা তলায় নিয়ে হাত বেঁধে জীবন্ত মাটিচাপা দেয় হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার পর ৩০ ডিসেম্বর স্থানীয় লােকজন এই গণকবর চিহ্নিত করে। সেখান থেকে মীর আবদুল কাইয়ুমসহ সবার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তখন দেখা গেছে, সবার হাতই পেছনে একটা মােটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। এঁদের কারও গায়ে গুলির চিহ্ন ছিল। শহীদ হওয়ার সময় কাইয়ুমের বয়স ছিল মাত্র ৩২। কাইয়ুমকে পরে কাদিরগঞ্জে সমাহিত করা হয়। এ সম্পর্কে তার স্ত্রী মাসতুরা খানম লিখেছেন : যখন ৭১-এ অনেকেই দেশ ছেড়ে ওপারে গেলেন তখনও কাইয়ুমের কণ্ঠে একই কথা ‘দেশ ছেড়ে যাব না, দেশে থেকে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবব, দেশ একদিন স্বাধীন হবেই, কিন্তু দেখে যেতে পারব তাে?’ তার এই সংশয়ই। শেষ পর্যন্ত সত্যি হলাে, স্বাধীনতা আর তাঁর দেখে যাওয়া হলাে না। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) জানা যায়, মীর আবদুল কাইয়ুমকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল যে কর্মচারী, স্বাধীনতার পরও তার চাকরি বহাল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেনশনসহ অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা সে ভােগ করে গেছে।  নিহত হওয়ার সময় কাইয়ুমের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তাঁর ছােট সন্তানের জন্ম হয়। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা ছিলেন। শহীদ মীর আবদুল কাইয়ুমের নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পােস্ট গ্র্যাজুয়েট ডরমেটরির নামকরণ করা হয়েছে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!