মিজানুর রহমান মিজু
মিজানুর রহমান মিজুর জন্ম ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়ায়। তার বাবার নাম বজলুর রহমান। মােক্তার, মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। বজলুর রহমান পেশায় ছিলেন আইনজীবী। পাচ ভাইবােনের মধ্যে মিজু ছিলেন চতুর্থ। তার পড়াশােনার হাতেখড়ি স্থানীয় মিশন স্কুলে। এরপর তিনি দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আই. এ. পাস করেন। সে সময় সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অবাঙালি। কলেজের এক অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ উর্দুতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে মিজানুর রহমান মিজু এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদের মুখে অধ্যক্ষ বাধ্য হন ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে। ছােটবেলা থেকেই ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মিজানুর রহমান মিজুর ছিল অবাধ বিচরণ। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস খেলায় তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। বিতর্ক, আবৃত্তি ও কৌতুক অভিনয়ে তার পরিচিতি ছিল ব্যাপক। মিজু ভালাে অভিনয়ও করতেন। দিনাজপুরে থাকাকালে স্থানীয় মুন্সিপাড়া কালচারাল ক্লাব, নবরূপী ও নাট্য সমিতিসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রায় প্রতিটি নাটকে তিনি ছিলেন অপরিহার্য শিল্পী। ছাত্র আন্দোলনেও মিজু সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মিজানুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকায় এসে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। স্নাতক শেষ করার আগেই মিজু ঢাকার অদূরে ঘােড়াশালে অবস্থিত ন্যাশনাল জুট মিসে চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন, মঞ্চ ও রেডিও নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। অভিনয় করে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
মিজু ঘােড়াশাল গণহত্যায় শহীদ হন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ন্যাশনাল জুট মিসে আক্রমণ চালায়। মিজানুর রহমান মিজুসহ ৯৬ জনকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে। তাদের সবাইকে হত্যা করার জন্যে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু টেলিভিশনে নাটক করার সুবাদে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন তাকে চিনতে পেরে ছেড়ে দেয়। কিন্তু একটু পরে আরেক দল পাকসেনা সেখানে উপস্থিত হয়। তারা কাউকেই ছাড়েনি, ৯৬ জনের প্রত্যেককে গুলি করে হত্যা করে। মিজুর বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এখানে গণহত্যার শিকার হন। এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় মিজানুর রহমানের ভাইয়ের মেয়ে জিনিয়া রহমানের ‘আমার কাকু’ রচনা থেকে। তিনি ঘটনার আংশিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। জিনিয়া রহমান লিখেছেন : মিজু কাকুর কথা মনে পড়লে একাত্তরের কিছু ঘটনার ছবি আমি দেখি। তারিখটা ছিল। ১ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর একটা দল ঘােড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিস এরিয়াতে তাদের হিংসাত্মক আক্রমণ শুরু করেছে। আকাশে-বাতাসে আর্তনাদ, পালাও পালাও যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যে যেখানে সম্ভব তৎক্ষণাৎ পালিয়েছে। ছােট কাকু আমাকে। নিয়ে অল্প দূরের এক গােয়ালঘরের খড়ের গাদায় আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেই ছােট আমি তখনকার ভয়াবহতাকে বুঝতে না পেরে মায়ের কাছে যাবার জন্য কান্না জুড়ে জেদ করাতে ছােট কাকু আল্লাহর নাম করে আমাকে সেখান থেকে বের করে দিতে বাধ্য হন। আমি তখন গােলাগুলির শব্দে ভয় পেয়ে মায়ের কাছে যাব বলে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে চলেছি। আমার এই মিজু কাকুই সেদিন এত গােলাগুলির মধ্যে দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে মায়ের কাছে পেীছে দিয়েছিলেন।
সেদিন পরাজয়ের মুখে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতাে হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই হানাদাররা সবাইকে বের করে নিয়ে এল। কিন্তু কি আশ্চর্য, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তাদের লাইনে দাঁড় করানাের পরও ক্যাপ্টেন সবাইকে ছেড়ে দিল। কাকুও ছিলেন সেই দলে। কেন? তিনি টেলিভিশনের পরিচিত শিল্পী, অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। ক্যাপ্টেন তার আবেদনটি রাখল- ঠিক হ্যায়, তুম যাও। কিন্তু না। তখনই এল আরেক দল হায়েনা। তাদের কাছে গুণীর কদর নেই, শিল্পীর দাম নেই- বুলেটে বুকের পাঁজর ঝাঁঝরা হয়ে গেল। সবুজ ঘাসের বিছানায় বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে আমার মিজু কাকু মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। … প্রাণ বাঁচানাের জন্য এই সব মৃত, অর্ধমৃত ও আহতদের ছেড়ে সেদিন আমরা জীবিতরা আর সবার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আশ্রয় নিয়েছিলাম যে যেখানে পারি। দুইদিন পর আকাশে দেখা গেল বােমারু বিমান। বেতারে জানা গেল মিত্রশক্তি ভারতের যুদ্ধ ঘােষণা করার কথা।
এরপর অনেকেই তথ্য নিয়ে এল, ওই এলাকা থেকে । পাকসেনারা পালিয়ে গেছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই সকলে ছুটল নিহত-আহত। আপনজনদের কাছে। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের খােলা মাঠে শিয়াল-কুকুর-শকুনের। খুবলে খাওয়া দেহগুলাে প্রত্যেকে নিয়ে এসে যে যার মতাে কবর দিল। মিজু কাকু ও আব্দুর আপন ফুফাতাে ভাই শহীদুল্লাহ ও সলীল কাকু, মােজাম্মেল ফুফা (প্রকৌশলী) এবং এমনি অনেক আত্মীয়-অনাত্মীয় পরিচিতদের দাফন করা হলাে ওই অঞ্চলের পরিচিত এক সম্পন্ন কৃষকের পারিবারিক গােরস্থানে। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) শহীদ মিজুর আপন ভাই ওবাইদুর রহমান ওবাই সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে আর্টিলারি বিভাগে কাজ করতেন। তিনিও ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল সৈয়দপুরে শহীদ হয়েছিলেন। মিজানুর রহমান মিজু অবিবাহিত ছিলেন।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা