You dont have javascript enabled! Please enable it!
মামুন মাহমুদ
মামুন মাহমুদ জন্মেছিলেন ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের খান বাহাদুর আবদুল আজিজ রােডের বাসায়। তাঁর প্রকৃত নাম সালাউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর বাবা ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ছিলেন চিকিৎসক এবং মা শামসুন নাহার মাহমুদ বিশিষ্ট লেখক ও নারী আন্দোলনের নেত্রী। এ পরিবারের দুই ছেলের একজন মামুন। মামুন মাহমুদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার প্র্যাট মেমােরিয়াল স্কুলে। এরপর ১৯৪৩ সালে কলকাতা বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। থেকে তিনি এন্ট্রান্স, ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই, এ. এবং ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. পাস করেন। দেশ ভাগ হওয়ার পর। তাদের পরিবার পূর্ব বাংলায় চলে আসে এবং ১৯৪৯ সালে মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণসংযােগ (পাবলিক রিলেশন্স) বিষয়ে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে মামুন সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ সার্ভিস লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে মহকুমা পুলিশ অফিসার, পুলিশ সুপার এবং ডি. আই. জি. পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং একজন দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে মামুন মাহমুদ রাজশাহী রেঞ্জের ডি, আই, জি, ছিলেন। সংস্কৃতি এবং ক্রীড়া জগতের সাথে মামুন মাহমুদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বিশেষত মা শামসুন নাহার মাহমুদের কল্যাণে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ কলকাতার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলকে তিনি কাছ থেকে দেখার সুযােগ পেয়েছিলেন। তার জন্মের সময় কবি নজরুল তাকে ‘শিশু যাদুকর’ কবিতা দিয়ে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন।
তিনি সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন এবং জবাবও পেয়েছিলেন। তাঁর সেই চিঠি রবীন্দ্রনাথের মারা যাওয়ার পর পর ১৯৪১ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মামুন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে ভালােবাসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মামুন অভিনয়, খেলাধুলা ও ছাত্র-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তিনি মিছিলের পুরােভাগ থাকার সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হন। ফজলুল হক হল টিমে খেলা ছাড়াও তিনি ওয়ারী ক্লাব ও পুলিশ দলের পক্ষে খেলেছেন। ১৯৫৪ সালে কুড়িগ্রামে মহকুমা পুলিশ অফিসার থাকার সময়ে তিনি কুড়িগ্রাম ক্রিকেট ক্লাব (কেসিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন রেফারিজ বাের্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৫৬ সাল থেকে প্রকাশিত পুলিশ বাহিনীর ‘ডিটেকটিভ’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন মামুন মাহমুদ। চাকরিজীবনে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নানা অন্যায় আদেশ অমান্য করা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন-সহযােগিতা দেওয়ার কারণে মামুন পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরাগভাজন হতে থাকেন। খুলনায় এস, পি, পদে থাকার সময় তিনি চোরাকারবারির অভিযােগে মুসলিম লীগ নেতা খান সবুরের কয়েকজন। ঘনিষ্ঠ সহযােগীকে গ্রেফতার করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমান খুলনায় জনসভা করতে যান। এ সময় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মামুন সে নির্দেশ অগ্রাহ্য করেন। এরপর ৭ জুন প্রতিবাদ দিবসে খুলনায় ১৪৪ ধারা জারি করার নির্দেশও তিনি কার্যকর করেননি। এসব কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁকে লিখিতভাবে সতর্ক করে।
ঢাকার পুলিশ সুপার থাকা অবস্থায় মামুন ১৯৬৯ সালের ১ নভেম্বর মিরপুরে অবাঙালিদের গ্রেফতার করে পাকিস্তানি শাসকদের বিরাগভাজন হন। এরপর ১৯৭০ সালের ১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানাের সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করেন। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ২৪ ঘণ্টার নােটিশে ময়মনসিংহে বদলি করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলার সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর জনৈক অফিসারের প্রশ্নের জবাবে মামলার অন্যতম আসামি খান শামসুর রহমানকে আমার ঘনিষ্ঠবন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন মামুন। ১৯৭১ সালের মার্চে মামুন রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। ৩ মার্চ রাজশাহীতে পাকিস্তানি সেনারা কয়েকজন বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ডি. আই. জি. হয়েও তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে কালাে পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। ২৫ মার্চে ভয়াবহ কিছু ঘটতে পারে অনুমান করেই তিনি পুলিশ বাহিনীকে সতর্ক রেখেছিলেন। এ সময় তিনি বাঙালির প্রতিরােধ আন্দোলনে সহায়তা দেওয়ার জন্যে গােপনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মােকাবেলা করার জন্য স্থানীয় নেতাদের কাছে তিনি দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক চেয়েছিলেন। এসব বৈঠকের খবর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে চলে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর মামুন মাহমুদকে তার অধীন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের জন্য বলে। কিন্তু মামুন তা উপেক্ষা করেন।
এ পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইলে মামুনের নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা তাকে তা করতে দেয়নি।  ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় মামুনের কাছে খবর পাঠানাে হয় যে রংপুর থেকে ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ ওয়্যারলেসে তার সাথে কথা বলতে চাইছেন। এই খবর দিয়ে একজন পাকিস্তানি অফিসার তাকে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৩ এপ্রিল ভারতীয় বেতার আকাশবাণীর বাংলা খবরে রাজশাহীর ডি. আই. জি. নিহতের খবর প্রচারিত হয়। ২৬ মার্চ ছিল মামুনের ১৭তম বিয়ে বার্ষিকী। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে রেখে যান। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেছে ‘মামুন  মাহমুদ সড়ক।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!