You dont have javascript enabled! Please enable it! মহিউদ্দীন হায়দার - সংগ্রামের নোটবুক
মহিউদ্দীন হায়দার
মহিউদ্দীন হায়দারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই, পাবনা শহরে। তার বাবা শিক্ষাবিদ সদরুদ্দীন আহমদ এবং মা নেগনাজ বেগম। মহিউদ্দীনের ডাক নাম ছিল পন্টু। এক বােন ও ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছােট। ১৯৫৩ সালে মহিউদ্দীন পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে আই. এ. এবং ১৯৫৭ সালে বি. এ. পাস করেন। মাঝে রংপুর কারমাইকেল কলেজে কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন। বি. এ. পাসের পর তিনি আইন বিষয়ে পড়াশােনা শুরু করেন এবং এ অবস্থাতেই ওয়াপদায় চাকরি নেন। কিন্তু এ চাকরি তিনি বেশিদিন করেননি। সংস্কৃতিমনা মহিউদ্দীন হায়দার ১৯৬৪ সালে তল্কালীন রেডিও পাকিস্তানে যােগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি প্রােগ্রাম অর্গানাইজার পদে উন্নীত হন। ১৯৭১ সালে তিনি রংপুর কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। মহিউদ্দীন হায়দারদের পারিবারিক পরিবেশে শিল্পচর্চার আবহাওয়া ছিল। তার বড় ভাই জিয়াউদ্দীন হায়দার ছিলেন কবি। সেজো ভাই ডা. সাঈদ হায়দার ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রথম শহীদ মিনারের নকশাও করেছিলেন। পঞ্চম ভাই সুজা হায়দার চিত্রশিল্পী। মহিউদ্দীন নিজেও ছিলেন শিল্পমনা। গল্প, কবিতা ও গান লিখতেন। রাজশাহী ও রংপুরের অনেক শিল্পীই তাঁর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই মহিউদ্দীন ছিলেন সাহসী ও স্পষ্টভাষী। কর্মজীবনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষতি স্বীকার করেছেন, তবু পিছপা হননি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে মহিউদ্দীন সপরিবারে দিনাজপুরে চলে যান মেজো ভাই শামসুদ্দীন হায়দারের বাসায়। পরে অবস্থার অবনতি হতে থাকলে শামসুদ্দীন সপরিবারে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মহিউদ্দীনকেও তার সঙ্গে যেতে বলেন। কিন্তু সে সময় মহিউদ্দীনের স্ত্রী খুরশিদা বেগম সন্তানসম্ভবা থাকায় তিনি স্ত্রী ও ছেলেকে দিনাজপুর মিশন হাসপাতালে ভর্তি করেন। আর নিজে একটা কারফিউ পাস জোগাড় করে রংপুরে ফিরে আসেন। কয়েকদিন পর ওই হাসপাতালে তাঁর ছােট ছেলের জন্ম হয়। কিছুদিন পর এক উর্দুভাষী আইনজীবীর সহায়তায় স্ত্রী-সন্তানদের রংপুরে নিয়ে আসেন মহিউদ্দীন। বাংলার একদিন জয় হবে, এই নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে তিনি তাঁর ছােট ছেলের নাম রাখেন ‘জয়’। তার নিখোঁজ হওয়ার তারিখ ১৫ আগস্ট ১৯৭১। এদিন সকালে সরকারি গাড়িতে করে অফিসে গিয়েছিলেন মহিউদ্দীন হায়দার। গাড়িটি বেতার কেন্দ্রের প্রবেশ মুখ দিয়ে ঢােকার সময় সেখানে পাহারারত পাকিস্তানি সেনাদলের এক সেনা গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করে। গাড়িতে একটি বােমা পাওয়ার অজুহাতে সেনারা মহিউদ্দীনকে আটক করে। এরপর তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে। হত্যার সঠিক তারিখ কারও জানা নেই।
তার বড় ভাই জিয়াউদ্দীন হায়দার মনে করেন, যে উর্দুভাষী আইনজীবী মহিউদ্দীন হায়দারকে দিনাজপুর থেকে স্ত্রী-ছেলেদের রংপুরে আনতে সহযােগিতা করেছিল, মহিউদ্দীনের নিখােজ এবং মৃত্যুর সাথে সে জড়িত । কারণ ওই আইনজীবী স্থানীয় মার্শাল ল’ কোর্টের উপদেষ্টা ছিলেন। জিয়াউদ্দীনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় : ১৫ আগস্ট রােববার ছুটির দিন হলেও মহিউদ্দীন জরুরি কাজের জন্য অফিসে। রওনা হয়। বেতার কেন্দ্রের গাড়িতে চেপে কেন্দ্রের গেটে পৌছামাত্র পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গাড়িটি তল্লাশি করা হয়। গাড়ির আসনের নিচ থেকে একটি বােমা উদ্ধার করা হয়েছে বলে চিৎকার করে সেখানে কর্তব্যরত সামরিক অফিসারকে জানায়। এই মিথ্যা অজুহাতে কয়েকজন সহযাত্রীসহ তাকে স্থানীয় সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দিনের মধ্যে সবাইকে ছেড়ে দিলেও মহিউদ্দীন ও চালককে তারা ছাড়েনি। পরে তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পরে জেনেছিলাম, পাকিস্তানি সেনারা শ্যামপুর মিলের কাছে বধ্যভূমি, চিনিকলের নিজস্ব পরীক্ষামূলক ফার্মের জমিতে মহিউদ্দীনের মৃতদেহ পুঁতে রেখে চলে যায়। মিলের লােকেরা তখনই মাটি খুঁড়ে স্যুট পরিহিত অবস্থায় মহিউদ্দীনের লাশ বের করে। তারা ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের রাস্তার ধারে জানাজা পড়ে তাকে সমাহিত করে। এ কথা জেনেছিলাম ওই মিলের জেনারেল ম্যানেজার মােসলেহউদ্দীন। সাহেবের কাছে। তিনি আমার ছােট ভাইকে শনাক্ত করেন। তিনিই এই দুঃসংবাদটি আমাদের জানিয়েছিলেন। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড; সামান্য পরিমার্জিত) মহিউদ্দীন হায়দার ও খুরশিদা বেগমের সংসারে দুই ছেলে ছিল।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা