মহসিন আলী দেওয়ান
শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মহসিন আলী দেওয়ানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি জয়পুরহাটের ভুটিয়াপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মঙ্গল আলী দেওয়ান ও মায়ের নাম ছলেমননেছা। মহসিন আলী নওগাঁ জেলার নজিপুর হাই স্কুল (পত্নিতলা উপজেলা) থেকে সম্ভবত ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে পর্যায়ক্রমে আই. এ. এবং বি. এ. পাস করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম, এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে মহসিন আলী ছিলেন একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে বগুড়া জেলায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। লেখাপড়া শেষে মহসিন আলী শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। প্রথমে তিনি নওগাঁ কলেজে বাংলার প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। পরে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যাপক ও বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেন। এরপর এই পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে শেরপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসাবে যােগ দেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তারের কাজে মহসিন আলী দেওয়ান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। জয়পুরহাট কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। তিনি বগুড়া আইন কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বগুড়া শাহ সুলতান কলেজের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং এই কলেজের নামকরণ তিনিই করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছাত্রদের জন্য বহু পাঠ্যবই লিখেছেন। তিনি বগুড়া। জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মহসিন আলী দেওয়ান ছিলেন বিরল প্রতিভাধর এবং বহুমুখী গুণের অধিকারী। তিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন উল্লেখযােগ্য নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন বগুড়া জেলার খ্যাতনামা সাংবাদিক। মহসিন আলী ১৯৫৪ সালে দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার স্টাফ রিপাের্টার ও সহযােগী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬১ সালে ৩০ অক্টোবর তিনি বগুড়া বুলেটিন’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন যা বগুড়ার সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক ঘটনা। পত্রিকাটি মহসিন আলী দেওয়ান ও আমানুল্লাহ খান যৌথভাবে সম্পাদনা করতেন। ইংরেজি নাম হলেও পত্রিকাটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হতাে। সে সময়ে বগুড়া বুলেটিন’ সমগ্র উত্তরবঙ্গে সমাদৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
পরে নিজেই সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে উত্তরবঙ্গ বুলেটিন’ নামে একটি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন মহসিন আলী। এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন তবিবর রহমান। ১৯৬০ সালে তিনি “অতএব নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ‘অতএব’ পত্রিকায় সিনেমা সংক্রান্ত সংবাদ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায় তা বগুড়ার প্রথম সিনেমা পত্রিকা হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। মহসিন আলী দেওয়ান বগুড়ার সংবাদপত্রের ইতিহাসে আর একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি বগুড়ার ইতিহাসে প্রথম একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, নাম, জনমত’। এটি একটি সান্ধ্য দৈনিক হিসাবে প্রকাশিত হতাে। সে সময়ে এই সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশ করা ছিল সমগ্র উত্তরবঙ্গের জন্যেই এক আলােড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। পত্রিকাটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। জানা যায়, ঈদুল আযহা উপলক্ষে প্রকাশিত একটি বিশেষ সংখ্যার মুদ্রাকর ও প্রকাশকের নাম মুদ্রিত না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। জেলা পরিষদের মুখপত্র পাক্ষিক ‘মহাস্থান’ ১৯৬৯-‘৭০ সালে মাসিক আকারে প্রকাশিত হতাে। এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মহসিন আলী দেওয়ান। তিনি বগুড়া। প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি বগুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। মহসিন আলী নিজের বাড়িতে দেওয়ান বুক সেন্টার’ নামে একটি প্রকাশনালয় এবং ‘আর্ট এন্ড পাবলিসিটি’ নামে প্রেস স্থাপন করেন। বগুড়া জেলা পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও বগুড়া জেলা প্রেস মালিক সমিতির সভাপতি হিসাবে তিনি। সাংগঠনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৮ সালে মে মাসে তিনি সরকারি সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ করেছিলেন। মহসিন আলী গল্প লেখক হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গল্পের চিড়িয়াখানা’ নামে ছােটগল্পের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। তাকে সাহিত্যরত্ন উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সদস্য ছিলেন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাক হানাদার বাহিনী বগুড়া শহর দখল করলে তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন। শহর দখল করে সেনাবাহিনী স্কুল-কলেজ খােলার নির্দেশ দেয়। কিন্তু মহসিন আলী কলেজে যাননি। কিছুদিন পর থেকে কলেজের উপাধ্যক্ষ তার কাছে অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে চাপ দিতে থাকে। মহসিন আলী প্রথমে এই চাপ উপেক্ষা করেন। পরে ভয়-ভীতি দেখানাে শুরু হলে তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে যান। উপাধ্যক্ষ দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার নাম করে তাকে ভাওতা দিয়ে বগুড়া শহরে নিয়ে যায় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে তুলে দেয়। এর পর থেকে তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। মহসিন আলীর মেয়ে স্নিগ্ধা মহসিনা আহসানের লেখায় এ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। তিনি লিখেছেন : কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল বাবাকে কলেজের দায়িত্ব তার হাতে বুঝিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অনবরত লােক পাঠাতে লাগল। বাবা যদি না যান, তবে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ভয় দেখাল। এভাবে চাপ সৃষ্টি করে জোর করে কলেজে নিয়ে গেল। আমার নানার গ্রাম থেকে তার কলেজের দুজন ছাত্র ও একজন হাফেজ সাহেবকে নিয়ে কলেজে গিয়েছিলেন। চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে যখন ফিরতে চেয়েছেন, তখন ভাইস প্রিন্সিপাল জোর করে বগুড়ায় বাবার প্রিয় বাড়ি দেখাবার লােভ দেখিয়ে এনে নরঘাতকদের হাতে তুলে দেয়। বাবার সঙ্গে সেই নির্দোষ হাফেজ সাহেবও নিখোজ হলেন। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) মহসিন আলী দেওয়ানের স্ত্রীর নাম দেওয়ান ফজিলাতুন্নেসা রেবা। তাদের সংসারে তিন সন্তান ছিল।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা