You dont have javascript enabled! Please enable it! মশিউর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক
মশিউর রহমান
একদিকে জীবন আর অন্যদিকে মৃত্যু- এর যে কোনাে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল মশিউর রহমানকে। তিনি তখন যশাের-৩ নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চেয়েছিল তাকে দিয়ে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার পক্ষে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়াতে। পাকিস্তানিরা দেখাতে চেয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের সাথেই আছে। এই উদ্দেশ্যেই মশিউরের সামনে দেওয়া হয় একটি বিবৃতির কাগজ। তাকে বলা হলাে, হয় এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ কর অথবা মরার জন্যে তৈরি হও। হানাদার বাহিনীর দেওয়া বিবৃতির কাগজটি টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলেন মশিউর রহমান। স্বাধীন বাংলার জন্য হাসিমুখে জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে নির্ভয়ে বীরের মতাে আলিঙ্গন করেছিলেন মৃত্যুকে। আইনজীবী ও রাজনীতিক মশিউর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে যশাের জেলার চৌগাছা থানার সিংহঝুলি গ্রামে। তার বাবা মােহাম্মদ ইসমাইল হােসেন এবং মা সৈয়দুন্নেসা। তিন ভাই ও তিন বােনের মধ্যে মশিউর ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে তিনি যশাের জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) থেকে ১৯৩৮ সালে আই, এ, এবং ১৯৪০ সালে বি, এ. পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে বি. এল. ডিগ্রি লাভ করেন। আইন পড়ার সময়ে তিনি একটি মার্চেন্ট অফিসের ইংরেজ কর্মকর্তার সহকারী হিসাবে কাজ করায় ইংরেজিতে দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জনে সক্ষম হন।
কলকাতাতে ছাত্র অবস্থাতেই মশিউর রহমান রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৫ সালে তিনি মুসলিম লীগে যােগ দেন। সে সময়ে তিনি হােসেন। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন এবং তার একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে কাজ করেন। এ সময় তাঁর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। যশােরে ফিরে মশিউর রহমান আইন ব্যবসার পাশাপাশি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় আইন সভার নির্বাচনে যশাের জেলা মুসলিম লীগের নির্বাচনী অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ যশাের শহরে একটি ছাত্র ধর্মঘট হয়। সেটি ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘স্টুডেন্ট ফেডারেশন প্রভাবিত। কিন্তু মশিউর রহমান তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যশাের শহরের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করে এবং ছাত্রদের এক বিশাল প্রতিবাদ সভা হয় যশাের ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে (বর্তমানে টি, অ্যান্ড টি, ময়দান)। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মশিউর রহমান। ওইদিন তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। যশােরের অনেক রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি ও মিথ্যা অজুহাতে রাজনৈতিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে তিনি ১৯৪৮ সালে স্থানীয় কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ দিন অনশন করার পর প্রশাসন তার দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। তখন কলকাতা থেকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এসে মশিউর রহমানের অনশন ভাঙান।
তিনি ১৯৪৮ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে যশাের জেলা বাের্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিন্তু বাঙালির প্রতি মুসলিম লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি যতই প্রকট হতে থাকে, মশিউর রহমানের সাথেও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব তত বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তকালীন মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে মতানৈক্য ঘটায় ১৯৪৯ সালে তিনি যশাের জেলা পরিষদের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেন এবং যশােরে দলটিকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালে তিনি যশাের জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে যশাের দক্ষিণ-পশ্চিম নির্বাচনী এলাকা। থেকে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মশিউর এত বিপুল ভােটে নির্বাচিত হন যে বাকি ১৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সকলেই জামানত হারান। তিনি ১৯৫৩১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন পূর্ববঙ্গীয় সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মশিউর প্রচার, সংসদ বিষয়ক এবং রাজস্ব ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। প্রায় ছয় মাস কারাভােগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
মশিউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন একেবারে সরলরৈখিক ছিল না। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে মশিউর রহমান আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখেন। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক মাের্চা বা পি. ডি. এম. গঠিত হয়। একে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হলে মশিউর পি, ডি, এম.-পন্থি আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরে আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের সময় ১৯৬৮ সালে তিনি পুনরায় মূল ধারার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ঢাকার বাইরে থাকলেও তিনি ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের নেতা, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয়দের একজন। ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে মশিউর রহমান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন চলাকালে খুলনার এক জনসভায় বক্তৃতা করে ফেরার পথে শেখ মুজিবুর রহমানকে যশােরে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল গ্রেফতার করেই যেন শেখ মুজিবকে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যশােরে মশিউর রহমানসহ অন্যান্য আইনজীবী আদালতে মামলায় লড়ে তাকে জামিনে মুক্ত করেন। এবং মুক্তির পর তিনি মশিউর রহমানের বাসাতেই ছিলেন।
ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আইনি সহায়তা দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য শেখ মুজিবের স্ত্রী। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যশাের থেকে বিশেষ অনুরােধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। মশিউর রহমানকে। মামলা পরিচালনায় তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা ছিল। অসাধারণ। মামলার প্রয়ােজনেই তিনি প্রায় এক বছর নিজের পেশাগত কাজকর্ম ও ঘর-সংসার ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মশিউর রহমান আওয়ামী লীগের মনােনয়নে যশাের-৩ নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সারাদেশে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযােগের অংশ হিসাবে যশােরের জনগণ স্থানীয় সেনানিবাসে খাদ্যসহ সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মশিউর রহমান। ৩ মার্চ অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে পাকসেনারা যশােরে চারুবালা করকে গুলি করে হত্যা করে। বিক্ষুব্ধ জনতা চারুবালা করের মৃতদেহ নিয়ে শহরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিছিলে নামে। মশিউর রহমান সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি সার্কিট হাউজের সামনে পৌছালে বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীর দিকে ইট-পাটকেল মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জনতা মারমুখী হয়ে সেনাবাহিনীকে ধাওয়া করে সার্কিট হাউসের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় এবং সেখানে সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল এসময় গুলি চালানাের নির্দেশ দিলে মশিউর রহমান গিয়ে সার্কিট হাউজের সামনে দাঁড়ান। তিনি সেনাবাহিনীকে গুলি চালনা থেকে নিবৃত্ত থাকার আহ্বান জানান এবং জনগণকে স্থানীয় ঈদগাহের দিকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন।
মশিউর রহমানের বাড়িটি ছিল যশােরের সার্কিট হাউজ রােডে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার দিকে মশিউর রহমান একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কী ভেবে আবার বাসায়ই রয়ে যান। ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে রয়ে যান শুধু তিনি নিজে, স্ত্রী এবং বড় ছেলে। ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে এসে মশিউর রহমানের পুরাে বাড়িটি ঘিরে ফেলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় যশাের ক্যান্টনমেন্টে।
গ্রেফতারের পর পরই মশিউর রহমানের উপর নির্যাতন শুরু হয়। তাকে পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার জন্য বলা হয়। ক্যান্টনমেন্টে তাঁকে প্রায় এক মাস অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বিবৃতি দিতে অস্বীকার করায় পাকসেনারা তাঁর শরীরের চামড়া ধারালাে চাকু দিয়ে ছিলে ফেলেছিল। এ ধরনের মধ্যযুগীয় বর্বরতার মুখেও তিনি বিন্দুমাত্র আপস করেননি, কোনাে বিবৃতিতে স্বাক্ষরও করেননি। এ সময় মশিউর রহমানের যশােরের বাড়িটি মর্টারের গােলায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তাঁর গ্রামের বাড়িতেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিহিংসামূলকভাবে মশিউর রহমানের চাচাতাে ভাই মতিয়ার রহমানকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সঠিক দিনক্ষণ জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল। পাক হানাদার বাহিনী স্বাধীনতার অকুতােভয় সৈনিক মশিউর রহমানকে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৫০ সালে মশিউর রহমানের সাথে বিয়ে হয় বগুড়ার চান্দবাইশ গ্রামের মাহমুদা খাতুনের। উচ্চশিক্ষিত মাহমুদা সারাজীবন মশিউরের পাশে থেকে তাকে দেশসেবার কাজে সহায়তা করেছেন। মাহমুদা নিজেও ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান হিসাবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। মশিউর রহমান ও মাহমুদা খাতুন দম্পতির দুই ছেলে, দুই মেয়ে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা