You dont have javascript enabled! Please enable it!
বীরেন্দ্রনাথ সরকার
আইনজীবী ও ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ সরকারের জন্ম রাজশাহী জেলার বাগমারা এলাকায়। রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমি থেকে ১৯৩২ সালে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৩৬ সালে আই. এ. এবং ১৯৩৮ সালে বি. এ. পাস করেন। ছাত্রজীবনেই ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন বীরেন্দ্রনাথ। তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ভূপেন্দ্র কিশাের রক্ষিত রায় এবং মাস্টারদা সূর্যসেন প্রমুখ বিপ্লবীর নেতৃত্বে গড়া বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের (বিভি) সদস্য। স্বাধীনতা আন্দোলনে যােগ দেওয়ার অপরাধে ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে বন্দি করে। ১৯৪৫ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। যাদের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করেছেন, তাঁদের মধ্যে মহারাজ ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তী ও রাজশাহীর প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ী উল্লেখযােগ্য। বীরেন্দ্রনাথ আজাদ হিন্দ ফৌজের আন্দোলনে ছাত্রযুবদের মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ কারণে তাকে বিভিন্ন সময় আত্মগােপনেও থাকতে হয়েছে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৪২ সালে তিনি বি. এল, পাস করেন। ১৯৪৫ সালে কারামুক্ত হয়ে তিনি আইন পেশায় যােগ দেন। তিনি সে সময় নতুন প্রতিষ্ঠিত রেভলুশনারি সােসালিস্ট পাটিতে (আর, এস, পি.) যােগ দেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বীরেন্দ্রনাথ কিছুদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। পরে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে তিনি ন্যাপে যােগ দেন। কয়েক বছর পর ন্যাপ বিভক্ত হলে মােজাফফর ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৭০ সালে।
এই দলের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন। পাকিস্তান আমলেও কারাবন্দি হয়েছিলেন এই আজীবন বিপ্লবী। পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ব বাংলার বিভিন্ন গণআন্দোলনে তিনি নানাভাবে অংশ নিয়েছেন ও সহযােগিতা করেছেন। কমিউনিস্ট কর্মী আতাউর রহমান ও তাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকেই রাজশাহীতে বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। নাচোল বিদ্রোহে সংগ্রামী নেত্রী ইলা মিত্রের মামলায় বীরেন্দ্রনাথ সরকার। কনিষ্ঠ আইনজীবী হিসাবে তার পক্ষে লড়েছিলেন। ইলা মিত্রের ওপর জেলখানায় চরম অত্যাচার করা হয়। সরকারের রােষানলে পড়ার ভয়ে তার হয়ে মামলা লড়ার জন্যে প্রথম দিকে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এগিয়ে আসেননি। এই মামলায় সরকারপক্ষের বাঘা বাঘা আইনজীবীর সঙ্গে লড়াই করে বীরেন্দ্রনাথ খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া গরিব কৃষক আন্দোলনকারী, অসহায় মানুষদের হয়ে স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে অনেক মামলা লড়েছেন আইনজীবী বীরেন্দ্রনাথ সরকার। এসব কারণে তিনি সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেন।
বীরেন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি রাজশাহী প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কয়েকবার তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হন। বীরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিক। ভালাে মানের ফুটবল রেফারিও ছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজশাহীতে বড় বড় ম্যাচে রেফারির বাঁশি হাতে তাকে দেখা যেত। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজেও তিনি নিয়ােজিত ছিলেন। একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের সময় সভা, সমাবেশ ও মিছিলে বীরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন বিশেষ ভূমিকায়। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করে যাননি। তার গভীর বিশ্বাস ছিল, “অজাতশত্রু মানুষ আমি, কেউ আমাকে হত্যা করবে না।” কিন্তু তাঁর সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে পাকিস্তানি ঘাতকের দল। ৩ এপ্রিল রাতে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর একটি দল বীরেন্দ্রনাথের বাড়ি ঘেরাও করে। সেনারা গুলিতে ঝাঝরা করে দেয় তার শরীর।  এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় সাংবাদিক সাঈদউদ্দীন আহমদের রচনায়। তিনি লিখেছেন : গণ-আন্দোলনের পর কিছু কিছু হিন্দু ভারতে চলে গেলে অনেকেই বীরেনদাকে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, একবার এক পরামর্শদাতাকে কড়াভাবে শুনিয়ে দিয়েছিলেন- চলে যাব? পালাব? দেশ ভাগ হওয়ার পর যাইনি, এখন যাব? লােকে বলবে বীরেন সরকার কাপুরুষের মতাে পালিয়ে গেল? এই মাটিতে জন্ম, এখানেই মরব। বীরেনদা মরলেন না। শহীদ হয়ে অমর হলেন। ১৯৭১-এর ৩ এপ্রিল বােরকা পরে এক পাকিস্তানি দোসর তার বাড়ি চিনিয়ে দেয়। আমরা যখন এই জন্মভূমি-প্রিয়, অকৃতদার, খ্যাতিমান আইনজীবী, বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, খেলােয়াড়কে দেখতে পেলাম, দেখলাম তার দেহ পড়ে আছে অর্ধেক খাটে, অর্ধেক মেঝেয়। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড)
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!