You dont have javascript enabled! Please enable it! ফজলুর রহমান খান - সংগ্রামের নোটবুক
ফজলুর রহমান খান
ফজলুর রহমান খানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ, নেত্রকোনা। জেলার মােহনগঞ্জ উপজেলার কাজিয়াটি গ্রামে। তার বাবা আব্দুল হাকিম খান ছিলেন স্কুল শিক্ষক, মা ফিরােজা খাতুন। আব্দুল হাকিম খানের মূল বাড়ি ছিল নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান গ্রামে। রেলস্টেশন নির্মাণের সময় বাড়ির জমি অধিগ্রহণ করা হলে তিনি কাজিটিয়া গ্রামে চলে আসেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে আব্দুল হাকিম খান পুরনাে বাড়ির অনেকটা জায়গা জুড়ে ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মােহনগঞ্জ পাইলট হাই। স্কুল (বর্তমান মােহনগঞ্জ গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুল) এবং এই স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয় শাখার প্রধান শিক্ষক হিসাবে তিনি যােগ দেন। পরে ১৯৬৯ সালে তিনি কাজিয়াটি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মােহনগঞ্জ কলেজ। ফজলুর রহমানরা ছিলেন তিন ভাই ও দুই বােন। মাত্র দেড় বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। তারা সব ভাইবােন লালিত-পালিত হন তাদের মামির কাছে। মােহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয় শাখায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। লেখাপড়ায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনােযােগী ও মেধাবী। ক্লাসের পরীক্ষাগুলােতে সবসময় প্রথম হতেন। পড়াশােনার পাশাপাশি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমননাটক, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা ইত্যাদিতে ফজলুর রহমান এবং তার অন্য দুই ভাই সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। 
স্কুলজীবন থেকেই ফজলুর রহমান ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি বয় স্কাউটের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল স্কাউট জাম্বুরিতে অংশ নিতে করাচি গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে ফজলুর রহমান প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ওই বছরই ভর্তি হন ময়মনসিংহ আনন্দ মােহন কলেজে। অসুস্থতার কারণে ১৯৫৬ সালে এই কলেজ থেকে তিনি আই, এসসি, পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। পরের বছর পরীক্ষায় অংশ নিলেও দুর্ঘটনাজনিত কারণে তিনি একটি ব্যবহারিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন, তবুও প্রথম বিভাগের সমমানের নম্বর পেয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৫৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে আই. এসসি. পাস করেন।
এরপর কিছুটা গণিত-ভীতির কারণে এবং বড় ভাইদের পরামর্শে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ফজলুর রহমান খান। এই বিভাগ থেকেই তিনি ১৯৬০ সালে প্রথম শ্রেণিতে বি, এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরই তিনি এম, এসসি, ক্লাসে ভর্তি হন এবং মাটির লবণাক্ততা (Soil Salinity) বিষয়ে এম, এসসি, থিসিস সম্পন্ন করে ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম, এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন। |১৯৬৩ সালের ১ আগস্ট তিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান এবং ভর্তি হন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলস প্রদেশের অ্যাবারিস্টওয়িথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পরে চলে যান। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজে। লিলিয়ান পেনসন হলে’ থেকে তিনি গবেষণাকর্ম শুরু করেন ড. এ. এইচ, কর্নফিল্ডের তত্ত্বাবধানে। চার বছরের S TT CICH ‘A Study on the Nutrient Metabolism in Soil at High Moisture Levels’ বিষয়ে গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৬৮ সালের ২৫ জুলাই তিনি পিএইচ. ডি. ডিগ্রি পান। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে পিএইচ. ডি. শেষ করে তিনি ওমরাহ পালন করতে যান। দেশে ফিরে ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে আগের পদেই যােগ দেন। একই বছরের ১৫ আগস্ট তিনি ওই বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে উন্নীত হন।
ব্যক্তিজীবনে নিষ্ঠার সাথে ধর্ম পালন করলেও ফজলুর রহমান মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত অমায়িক। তিনি শ্রেণিকক্ষে পড়াতেন খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে। বিষয়বস্তুকে ছাত্রছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করতেন সরল ও আকর্ষণীয়ভাবে। যে-কোনাে সমস্যা সমাধানে ছাত্রছাত্রীদের জ্বালাতনেও তিনি কখনও বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। মৃত্তিকাবিজ্ঞানের গবেষণায় নিজে যদিও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি, কিন্তু তার আদর্শ, সততা ও আন্তরিকতা অনেক ছাত্রছাত্রীকে প্রভাবিত করেছে।  ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ফরিদা রউফ খান শিরীনের সঙ্গে বিয়ে হয় ফজলুর রহমান খানের। ফরিদা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। এই বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এম, এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁদের একটি কন্যা শিশু জন্মেছিল, কিন্তু জন্মের মাত্র ১৪ দিনের মাথায় শিশুটি মারা যায়। এ সময় ফরিদা উচ্চশিক্ষার জন্যে বৃত্তি পান এবং ১৯৭০ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন যান।
১৯৭১ সালে ফজলুর রহমান থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার অর্থাৎ বর্তমান জহুরুল হক হলের (তকালীন ইকবাল হলের) পাশের আবাসিক শিক্ষক ভবনের তিনতলায়, পূর্বদিকের ২৩/এফ ফ্ল্যাটটিতে। সঙ্গে থাকত কলেজ পড়ুয়া ভাগ্নে কাঞ্চন এবং ঘরের কাজের সহযােগী ১০-১২ বছরের একটি ছেলে। এ সময় ফজলুর রহমান খান বসন্ত রােগে আক্রান্ত হন। তাঁকে দেখাশােনার জন্য প্রায় ৬০ বছর বয়সী জবান আলী নামের একজনকে তার বাসায়। নিয়ে আসা হয়। মার্চের ২০ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনই জবান আলীকে নিয়ে। ৮-১০ মিনিট হেঁটে এলিফ্যান্ট রােডের ৩০৮ নম্বর বাড়িতে গিয়েছেন ফজলুর রহমান খান। সেখানে থাকতেন তার ছােট ভায়রা ড. শামিমুজ্জামান বসুনিয়া এবং ভয়েস অব আমেরিকার তঙ্কালীন প্রধান খন্দকার রফিকুল হক। সেখানে তাদের মধ্যে। দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ-আলােচনা হতাে।
২৫ মার্চ রাতে ফজলুর রহমান ও জবান আলীকে রাতটা তার বাসায় থেকে যেতে বলেন ড, বসুনিয়া। কিন্তু ভাগ্নে কাঞ্চন বাসায় একা থাকবে ভেবে সেদিন ভাত খেয়েই জবান আলীকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে আসেন ফজলুর রহমান। কাঞ্চন। সেদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন আজিমপুরে তার বাবার বাসায়। তাকেও রাতটা সেখানেই থাকতে বলা হয়। কিন্তু মামা একা থাকবে ভেবে কাঞ্চনও চলে আসে মামার ইকবাল হলের ফ্ল্যাটটিতে।
 ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যায় মেতে ওঠে। তাদের প্রধান। আক্রমণ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রাত শেষ হয়ে ২৬ মার্চ ভােরের দিকে পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রধান দরজা ভেঙে ভেতরে ঢােকে। চিঙ্কার ও গালিগালাজ করে তারা বের হয়ে আসতে বলে বাসার ভেতরের সবাইকে। চিরকালের সরল মনের ফজলুর রহমান ভেবেছিলেন, হাত তুলে বেরিয়ে এলে কিছু হবে না। ভয়ে ভয়ে তারা তিনজন দরজা খুলে হাত তুলে বেরিয়ে আসেন শােবার ঘরের সামনে। মুহতেই একঝাক গুলিতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তারা। কাজের ছেলেটা বাথরুমের মধ্যে লুকিয়েছিল বলে সেদিন বেঁচে যায়। শরীরে চারটা গুলি লাগার পরও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন জবান আলী। তার। কাছে ড. ফজলুর রহমান খান একটি কথাই শুধু বলেছিলেন, “জবান, শিরীনের সঙ্গে আর জীবনে দেখা হলাে না।” শােবার ঘরের মেঝেতে দেড় দিন পড়ে থাকার। পর ২৭ তারিখ সকাল ৮টার দিকে কারফিউ শিথিল হলে আত্মীয়-পরিজনেরা শহীদ উ, ফজলুর রহমান খান এবং কাঞ্চনের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে। সমাহিত করেন। লন্ডনে অবস্থানরত ফরিদা রউফ খান শিরীন ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুর খবর পেয়ে পড়াশােনা ছেড়ে দেন। একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে সেখানেই কয়েক বছর ছিলেন ফরিদা খান। পরে দেশে ফিরে আসেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা