নূরুল আবসার
নূরুল আবসারের জন্ম কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মজিদপুর গ্রামে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছােট। তার ডাকনাম ছিল মজনু।। ছাত্র হিসাবে নূরুল আবসার ছিলেন মেধাবী। বাংলা ভাষা এবং কবিতার প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে আই. এসসি, পাস করেন নূরুল। এরপর ভর্তি হন ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালে তিনি যােগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ই. এম. ই. ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে। দুবছর পর তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে ক্যাপ্টেন নূরুল আবসারকে প্রশিক্ষণের জন্য বদলি করা হয় পাকিস্তানের লাহােরে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ তিনি ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। এ সময় তিনি ট্যাঙ্কবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। একাত্তরের ২৯ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাপ্টেন নূরুল আবসার এবং আরও কয়েকজন বাঙালি। সেনা কর্মকর্তা মিলে সাত-আটটি ট্যাঙ্ক বিকল করে দেন। তাদের কর্মকাণ্ডে সন্দিহান। হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। নূরুলকে নিরস্ত্র করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে। এর আগে তাকে কড়া পাহারার মধ্যে নিয়ে আসা হয় তার সেজো ভাই গােলাম রব্বানীর বাসায়। সেদিন তিনি তার পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, “আর হয়তাে কোনােদিন দেখা হবে না। আব্বা-আম্মাকে কাদতে মানা করবেন।”
রংপুরের বন্দিশিবিরে তাদের কী দুঃসহ অবস্থার মধ্যে কেটেছে, সে বর্ণনা পাওয়া যায় নূরুলের সাথে আটক থাকা মেজর (অব.) নাসিরউদ্দিনের লেখা ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ বইতে। ওই বই থেকে জানা যায়, নূরুল আবসার ও নাসিরউদ্দিনসহ আরও কেউ কেউ বন্দিদশা থেকে পালানাের পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা করেছিলেন ক্যাপ্টেন নূরুল আবসার। তারা বর্ষা মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কারণ বর্ষায় পালাবার সুবিধা বেশি। কিন্তু সেই সুযােগ তারা পাননি। তার আগেই তাকে এবং লেফটেন্যান্ট হাশেমকে হত্যা করা হয়। বইটিতে নাসিরউদ্দিন লিখেছেন : রংপুর শহরের বাইরে বগুড়া মহাসড়কের পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলাে। বাড়ির চারদিকে কড়া প্রহরা। সেই প্রহরার বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে আমাদের দুজনকে (নূরুল আবসার ও নাসিরউদ্দিনকে – সম.) একটি রুমে নিয়ে বসানাে হলাে। ক্যাপ্টেন জুলফিকারও একটি চেয়ার টেনে। বসলেন। কাঠের হাতল লাগানাে একটি লম্বা ধারালাে তরবারি দেখতে পেলাম তার হাতে। তরবারিটি নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ আনমনে নাড়াচাড়া করলেন। ঠিক এই সময় হঠাৎ করেই মাঝ বয়সী দুজন লােক রুমে এসে ঢুকল। তাদের প্রত্যেকের হাতেই বৈদ্যুতিক তার। কোনাে কথা না বলেই লােক দুটি প্রচণ্ডভাবে এলােপাতাড়ি প্রহার শুরু করল আমাদের এরপর আমার যখন জ্ঞান ফিরল, দেখতে পেলাম অন্য একটি রুমে মাটিতে পড়ে আছি। সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা রক্তাক্ত আপাদমস্তক উঠে বসতে চেষ্টা করলাম।
কিন্তু পারলাম না। ক্যাপ্টেন আবসারের ক্ষীণ কন্ঠ শুনতে পেলাম। অদূরে। তিনি আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে বললেন। আমি গলার আওয়াজ অনুসরণ করে বহু কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম মাটিতেই বসে আছেন তিনি। তার কাপড়-চোপড়ের সর্বত্র চাপ চাপ রক্তের দাগ তখনও শুকায়নি। ঠোট কেটে ফুলে উঠেছে। ভালাে করে তাকাতে পারছিলেন না। আমার দিকে। বারবার তার মাথা নুয়ে আসছিল। লজ্জা, গ্লানি আর অপমানের অন্তজ্বালা যেন তাকে আরও অবনত করে ফেলেছে। মেজর (অব.) নাসিরউদ্দিনের লেখা থেকে জানা গেছে, লালমনিরহাট নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ক্যাপ্টেন নূরুল আবসার ও লে. হাশেমকে নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়া। মহাসড়কের পাশে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সেখানেই তাঁদের টেনে-হিচড়ে রাস্তার ধারে নামিয়ে হত্যা করা হয়।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা