You dont have javascript enabled! Please enable it! নুরুল আবসার মাে. জাহাঙ্গীর - সংগ্রামের নোটবুক
নুরুল আবসার মাে. জাহাঙ্গীর
রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় নারায়ণপুরে ১৯৩১ সালের মে মাসে নুরুল আবসার মাে. জাহাঙ্গীরের জন্ম। তার বাবার নাম আব্দুল কাদির, মায়ের নাম জাহানারা বেগম। আব্দুল কাদির ছিলেন চিকিৎসক। চার ভাই ও দুই বোনের। মধ্যে মো. জাহাঙ্গীর ছিলেন সবার বড়। তার ডাকনাম ছিল মাে. জাহাঙ্গীর পাংশা জর্জ হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এসসি, পাস করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি এম. বি, বি, এস, পাস করেন। ১৯৫৩ সালে মাে. জাহাঙ্গীর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যােগ দেন। তিনি পাকিস্তানের আজাদ কাশীর, পিন্ডি, শিয়ালকোট, মালি প্রভৃতি জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭০ সালে তাকে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের ৪০ নম্বর ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে বদলি করা হয় এবং তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। মাে. জাহাঙ্গীর ছাত্রজীবনে ‘মুকুল ফৌজের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাজপথের আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ সামরিক আদালতের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি দেখতে পান যে বেশিরভাগ মামলাই উদ্দেশ্যমূলক এবং মামলার আসামিরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগের কর্মী অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযােগের মামলায় গ্রেফতার এম, এ. আজিজ ও অমূল্য বিকাশ তার আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। এরকম আরও অনেকেই তার আদালত থেকে মওকুফ পেয়ে যান। এ কারণে তিনি পাকিস্তানি অফিসারদের বিরাগভাজন হন। তিনি ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ কাজে পাকিস্তানিদের গাফিলতি ও অবহেলা দেখতে পেয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এসব কারণে মার্চের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা তাকে নজরবন্দি করে রাখে।
১৯৭১ সালের মার্চে ডা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুল আবসার মাে. জাহাঙ্গীর। ছিলেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ৪০ নম্বর ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের কমান্ডিং অফিসার। ২৫ মার্চ রাতেই তার বাসার চারদিকে সেনা সদস্যরা পাহারা বসায়। ২৬ মার্চ তাকে হেড কোয়ার্টারে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরদিন ২৭ মার্চ ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ইউনিটকে সব অস্ত্র জমা দিতে বলা হলে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর কিছু অস্ত্র জমা দিয়ে বাদবাকি অস্ত্র লুকিয়ে ফেলেন। সেদিন বিকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সে হামলা চালায় এবং গণহত্যা চালায়। ২৯ মার্চ ৪০ নম্বর ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু পাহারার কারণে মাে. জাহাঙ্গীর সেখানে যেতে পারেননি। এদিন একটি মটারের আঘাতে তাদের বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আরেক বাঙালি অফিসারের বাসায় আশ্রয় নেন। ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি অফিসার, সেনা ও বেসামরিক কর্মচারীসহ প্রায় ৩০০ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। এই ৩০০ জনের প্রায় সবাইকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করে। ৩০ মার্চ সকালে পাকসেনারা আটক করে ডা. লে. কর্নেল মাে. জাহাঙ্গীরকে। এদিন দুপুরের দিকে জাহাঙ্গীরের গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে তার চোখ বাঁধা হয়। এ সময় তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?” জাহাঙ্গীরকে বলা হয় যে তাকে ইস্পাহানী স্কুলে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তাকে সেখানে না নিয়ে ব্রিগেড অফিসের দক্ষিণে একটি গর্তের পাশে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবারের সদস্যরা তার মৃত্যুর খবর জানতে পারেনি। 
শহীদ ডা. লে. কর্নেল নুরুল আবসার মো. জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর নাম জেবুন নিসা। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর জেবুন নিসা তার সন্তানদের নিয়ে আরও অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকের পরিবারের সাথে ইস্পাহানী স্কুলে বন্দি ছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের গণকবর থেকে শহীদ ডা. লে. কর্নেল মাে. জাহাঙ্গীরের লাশ তুলে ওখানকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সামনে একটি টিলায় সামরিক মর্যাদায় পুনরায় সমাহিত করা হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি প্রধান সড়ক তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা