নাসিরউদ্দীন আহমদ
নাসিরউদ্দীন আহমদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের চিফ পারসােনাল অফিসার বা সি, পি. ও.। ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি পরিবার নিয়ে বাস করতেন চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীর রেল কোয়ার্টারের একটি নিচু টিলার ওপর বাংলােতে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই চট্টগ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রেলের বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্চে অসহযােগ। আন্দোলনের সময় নাসিরউদ্দীন অন্য সহকর্মীদের মতাে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে অসহযােগে শামিল হন। চট্টগ্রাম বন্দরে সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের বিরুদ্ধে বন্দরের বাঙালি কর্মকর্তা ও শ্রমিকরা যে বিদ্রোহ করেছিল, তাদের সাথে নাসিরের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল বলে জানা যায়। অসহযােগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে পাহাড়তলীসহ চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে অবাঙালিরা বাঙালিদের ওপর হামলা। চালায়। অবাঙালিরা নাসিরউদ্দীনের বাসায় হামলা চালাতে পারে, এমন একটি খবর শােনা যায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে নাসিরউদ্দীন রেলওয়ে ডাক্তারের সহযােগিতায় অ্যাম্বুলেন্সে করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সি. আর. বি. এলাকায় তার সহকর্মী মাহমুদ হাসানের বাড়িতে চলে যান। সেখানে দিন দশেক থাকার পর ১৩ মার্চ আবার বাংলােয় ফিরে আসেন। ২৫ মার্চের পর থেকে নাসিরউদ্দীন মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করতে থাকেন। ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম শহর পাকসেনাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন হাতে গােনা কয়েকজন ছাড়া সমস্ত রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যান। বাকিরা পাকবাহিনী এবং তাদের অবাঙালি সহযােগিদের হাতে ঘেরাও হয়ে পড়েন।
এ অবস্থায় নাসির তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রেলের চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মােজাম্মেল চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। হামিদ এবং এল, আর. খান নামের দুজন রেল কর্মকর্তা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ২ এপ্রিল রাতে শােনা গেল, বাঙালিরা বেশ কয়েকজন অবাঙালি রেল কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় অবাঙালিরা প্রতিশােধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে নাসিরউদ্দীন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মােজাম্মেল চৌধুরীর বাড়ি থেকে বের হয়ে মাইলখানেক দূরে আরেকজন বাঙালি রেল কর্মকর্তার বাড়িতে গিয়ে আত্মগােপন করেন। সেখানে যাওয়ার পর ৫ এপ্রিল তারা শুনতে পান, অবাঙালিরা মােজাম্মেল চৌধুরীর বাড়িতে হামলা করে মােজাম্মেল চৌধুরী, তার দুই ছেলে এবং হামিদ ও এল, আর, খানসহ মােট ১১ জনকে জবাই করে হত্যা করেছে। অবাঙালিরা হামলা করার জন্য তাদের আশ্রয়স্থলের দিকে এগিয়ে আসছে। এ খবর শােনার পর তারা সেখান থেকে নিজেদের গাড়িতে করে পালিয়ে আসেন। তাঁরা আশ্রয় নেন চট্টগ্রাম শহরের একটি পাড়ার পরিত্যক্ত বাড়িতে। সেখানে থেকেই নাসিরউদ্দীন ও আরও কয়েকজন অফিস করতে থাকেন। ২৩ মার্চ তার কয়েকজন সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারলেন পাকিস্তানি সেনারা যে কোনাে সময় তাঁকে গ্রেফতার করতে পারে। এ খবর শুনে নাসিরউদ্দীন নিজেদের নাম-পরিচয় গােপন করে রাউজানে একজন পরিচিত ডাক্তারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরই মধ্যে তাঁদের রেল কলােনির বাসাটি লুট হয়ে যায়। নাসিরউদ্দীনের আশ্রয়দাতা ডাক্তার একদিন জানালেন, যে-কোনাে সময় বাঙালিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারে। এ কথা শুনে নাসির ডাক্তারের হাতে তার শেষ সম্বল দুই হাজার টাকার ব্যাংক চেক তুলে দেন। এর পরদিন, ১১ মে ১৯৭১, একদল পাকিস্তানি সেনা ডাক্তারের বাড়িতে হানা দিয়ে নাসিরউদ্দীনকে ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাদের সাথে দুজন বাঙালি রাজাকারও ছিল।
আশ্রয়দাতা ডাক্তার দুদিন বাড়ি ছিলেন না। দুদিন পর তিনি ফিরে এলে নাসিরউদ্দীনের স্ত্রী কামরুন তার কাছে নাসিরের খোঁজ জানতে চান। প্রথম দিকে মিথ্যা কথা বললেও চাপাচাপির এক পর্যায়ে তিনি জানান যে পাকিস্তানি সেনারা প্রধান সড়কে পৌছে ডাক্তার ও নাসিরকে বাসে তুলে নেয়। প্রায় ১৫ মিনিট চলার পর বাসটি একটি সেতুর কাছে থামে। এই সেতুটি ছিল পাকিস্তানি সেনাদের চেক পয়েন্ট। দুজন সেনা নাসিরকে নামিয়ে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার তিনটি গুলির শব্দ শুনতে পান। এর কিছুক্ষণ পর সেনারা বাসে ফিরে আসলেও নাসিরউদ্দীন আর ফিরে আসেননি। | শহীদ নাসিরউদ্দীন আহমদের স্ত্রীর নাম কামরুন আহমদ। তাদের সংসারে দুই মেয়ে ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কামরুন আহমদ শিক্ষকতায় যােগ দেন। তাদের মেয়ে রাসেদা ইরশাদ নাসির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা