You dont have javascript enabled! Please enable it!
ন. আ. ম. ফয়জুল মহী
শিক্ষাবিদ ন, আ. ম. ফয়জুল মহীর (অনেক জায়গায় তার নাম লেখা হয়েছে ‘এন. এ. এম. ফয়জুল মহী’) জন্ম ১৯৩৯ সালের ১০ আগস্ট ফেনীতে। তার বাবার নাম মুহম্মদ নূরুল ইসলাম চৌধুরী। ফয়জুল মহী ১৯৫৫ সালে ফেনী সরকারি হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। ফেনী কলেজ থেকে তিনি ১৯৫৭ সালে আই. এ. এবং ১৯৫৯ সালে বি. এ. পাস করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. এড. ডিগ্রি পান।  ফয়জুল মহী ১৯৬২ সালে ফেনী জি, এ, একাডেমি স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। এখানে দুই বছর শিক্ষকতার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এম, এড. কোর্সে ভর্তি হন এবং এম, এড. ডিগ্রি পান। ১৯৬৫ সালে ফয়জুল মহী সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। তিনি ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কলােরাডাে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. এবং ১৯৬৮ সালে শিক্ষা প্রশাসনে ডক্টরেট অব এডুকেশন (এড. ডি.) ডিগ্রি পান। ওই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিল্পকলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন এবং সে বছরের ১১ ডিসেম্বর তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৬৮ সালের গােড়ার দিক থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই. ই. আর.-এর প্রত্যেকটি বিভাগেই ছাত্র সংখ্যা বাড়ছিল। ফলে নতুন এবং যােগ্য শিক্ষক নিয়ােগের প্রয়ােজন দেখা দেয়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল যােগ্য শিক্ষক নিয়ােগের বিষয়ে গুরুত্বের সাথে উদ্যোগ নেওয়া। ফয়জুল মহী ওই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। এ কমিটি শুধু শিক্ষাগত যােগ্যতার দিকেই দৃষ্টি দেয়নি, শিক্ষকদের স্বভাব চরিত্রের বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছিল।  ফয়জুল মহী ছিলেন কৃতী ও ছাত্র-প্রিয় অধ্যাপক এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের  অধিকারী।
তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় ‘মহী ভাই’  খেলাধুলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের  প্রতি অনুরাগী ছিলেন মহী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, লনটেনিস, তাস ও দাবা খেলতেন। তিনি  ড. কাজী মােতাহার হােসেনের কাছে দাবা খেলার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ফয়জুল  মহী ছিলেন অসম্ভব সময়নিষ্ঠ এবং সব কাজ তিনি পরিকল্পনা মাফিক করতেন।  দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ  প্রকাশিত হয়েছে। আদর্শবাদী ও মুক্তচিন্তার অধিকারী ফয়জুল মহী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। কোনাে রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতি ও সেমিনারে নিয়মিত অংশ নিতেন, আলােচনা করতেন। তিনি প্রকাশ্যেই পাকিস্তান সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের সমালােচনা করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধাদের ও পাকবাহিনী কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারকে তিনি আর্থিক সাহায্য করেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ফুলার রােডের আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। এখান থেকেই আরও কয়েকজন শিক্ষকের সাথে তাকে আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।
ফয়জুল মহীর জীবনের শেষ দিনগুলাে সম্পর্কে জানা যায় তার সহকর্মী ম. ওবায়দুর রহমানের ‘আমার সহকর্মী’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন :  শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিবেশ ও এখানে অবস্থান ক্রমে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠতে লাগল। সে-সময় এখানে বেশ কয়েকজন অবাঙালি শিক্ষক-শিক্ষিকা, অফিসার ও কর্মচারী ছিলেন। মাঝে মধ্যে পাকিস্তানি আর্মির লােকজন, সাদা পােষাকে গুপ্তচর এবং অপরিচিত লােকজনের আনাগােনা ছিল। সে সঙ্গে ছিল। পাকিস্তানিদের কিছু দালাল, বিশেষ করে শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহর সন্দেহজনক কার্যাবলী। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তীব্র, তীক্ষ ব্যঙ্গ ও কটুক্তি যা অনেক সময় সহ্যের সীমা ছেড়ে যেত।  এমনও শােনা যায় ড. হাবিবুল্লাহ সে-সময় ঢাকাস্থ আলবদর বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কথাবার্তা সব ঠিকঠাক, ১১ ডিসেম্বর সকাল ৯টার। মধ্যে সকলে জিঞ্জিরা ঘাটে মিলিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে চলে যাব।.ড. ।মহীকে সময়মতাে প্রস্তুত হয়ে বের হওয়ার জন্য সংবাদ দিতে সেদিন সকাল। ৭টায় তার ফুলার রােডের ৩৫ নং বাসায় গেলাম। উনিও আমার অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে দেখে নেমে এলেন। তখনও প্রস্তুত হননি দেখে মনে সংশয়। জাগল। হতাশভাবে জানালেন, রাত্রে দেশ থেকে কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন, এ মুহূর্তে তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
তারপর এল সেই ১৬ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক বিজয় দিবস। আমরা যে দল। যে দিকে ঢাকা ছেড়েছিলাম, খুশিমনেই ফিরে এলাম। এসেই শুনলাম ড. মহী নেই, নেই আরও অনেকে। ড. মহী সম্বন্ধে যা শুনলাম- ১৪ ডিসেম্বর সকালে সাদা এক মাইক্রোবাস এসে ফুলার রােডের ৩৫ নং বাসার কাছে থামে। ড. আবুল খায়ের বাসার সামনেই একটা শাল গায়ে দিয়ে ঘােরা-ফেরা করছিলেন। মাইক্রোবাস থেকে ৭-৮ জন মুখােশধারী যুবক, ১৮-১৯ বছর হবে, হাতে। স্টেনগান, রাইফেল নিয়ে নেমে আসে। প্রথমেই ড, খায়েরকে ধরে এবং ওই বিল্ডিং-এর তিন তলা থেকে, লুঙ্গীপরা, চোখ বাঁধা অবস্থায় ড. ফয়জুল মহীকে ধরে নিয়ে এসে মাইক্রোবাসে উঠায়। ঠিক ওই সময় ড. হাবিবুল্লাহ কাছেই ৩৬ নং বিল্ডিং-এর বারান্দা থেকে সব কিছু দেখছিলেন। তিনি ওখান থেকেই জানিয়ে দেন সঠিক লােকদেরই ধরা হয়েছে। এই তাদের শেষ যাওয়া। স্বাধীনতার পরে কুখ্যাত রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে শত শত শহীদের মধ্যে ড. মহীর গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত, বিকৃত লাশ শনাক্ত করা হয় এবং ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের উত্তর পাশে অন্যান্য শহীদদের সাথে সমাহিত করা হয়। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড)

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!