You dont have javascript enabled! Please enable it! ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত - সংগ্রামের নোটবুক
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত যে অল্প কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখে গেছেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদের অন্যতম। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাছে রামরাইল গ্রামে। তার বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা ও নবীনগর মুনসেফ আদালতের সেরেস্তাদার। দুই ভাই ও দুই বােনের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন তৃতীয়। মাত্র নয় বছর বয়সে তার মা মারা যান। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর জগবন্ধু দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯০৪ সালে নবীনগর হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং ১৯০৬ সালে কুমিল্লা কলেজ হতে এফ. এ. পাস করেন। এরপর ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে বি. এ. এবং একই কলেজ থেকে ১৯১০ সালে বি. এল. পরীক্ষায় পাস করেন। শিক্ষাজীবনের শেষে তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর থানার বাঙ্গরা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে (বর্তমান নাম বাঙ্গরা উমালােচন হাই স্কুল) সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন এবং ১৯১০ সালের ১ মার্চ হতে ১৯১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর আইন ব্যবসার উদ্দেশ্যে ১৯১১ সালে তিনি কুমিল্লা জেলা বারে যােগ দেন।  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতায় লেখাপড়া করার সময় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রসূলের রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনে যােগ দেন।
এ সম্পর্কে তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন : সেই সময়ে ভারতবর্ষে, বিশেষ করিয়া বাংলাদেশে, একদল যুবক যে কোনাে পন্থা অবলম্বনে ইংরাজ শাসন হইতে দেশকে মুক্ত করিবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। সেই সময়ে ঢাকা শহরে প্রথমে ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর সমিতি’, বৈপ্লবিক দল গঠিত হয়। কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের উদ্ভব হয়। ইংলন্ডের সহিত সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে, এই ছিল ইংরাজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চরমপন্থীদের মত। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব হইবে না বলিয়া তাহারা ঘােষণা করে। Revolutionary Block-এ (তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী দলে) যােগদান করি নাই। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক পথে দেশকে স্বাধীন করা যাইবে না তাহা অনুভব করিয়াছিলাম। কী পন্থা অবলম্বন করা হইবে সে সম্বন্ধে কোন দিশা ছিল না। আমি কলিকাতায় ছাত্রজীবনে সভা সমিতিতে যােগদান করিয়া, চরমপন্থী পত্রিকা পাঠ করিয়া আমার সময় কাটাইয়াছি। … আমাদের জেলার জনাব এ. রসূল সাহেবকে আমার রাজনৈতিক গুরু বলিয়া গ্রহণ করি।” (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতিরক্ষা পরিষদ, ঢাকা : ১৯৯৫: পৃ: ৩১-৩২)।
তিনি ১৯০৭ সালে ত্রিপুরা হিতসাধনী সভা’র সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং ১৯১৫ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে মানুষের প্রশংসা লাভ করেন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে তিনি মুক্তি সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করেছিলেন। কুমিল্লার সুপরিচিত জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘অভয় আশ্রমে’র কর্মকাণ্ডের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে তিনি অংশ নেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলে তিনি সে ডাকে সাড়া দেন এবং তিন মাসের জন্য আইন ব্যবসা স্থগিত রেখে অসহযােগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ সময়ের একটি ঘটনা মানবতাবাদী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের চরিত্র বুঝতে সহায়ক হবে। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে আসাম-সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। তারা কাজ ছেড়ে দিয়ে দলে দলে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে রওনা দেয়। কিন্তু সে সময় রেলওয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছিল। বলে রেল চলাচল বন্ধ ছিল। একদল চা-শ্রমিক আখাউড়া এসে উপস্থিত হয়। স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে টাকা ও চাল-ডাল ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৩৬ সালে ত্রিপুরা জেলা বাের্ডের (পরে কুমিল্লা জেলা বাের্ড) সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশােধন এবং বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনী আইন পাসের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যােগ দেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণসামগ্রী বিতরণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশবিরােধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছেন এবং বিভিন্ন কারাগারে কখনও বিনাশ্রম আবার কখনও সশ্রম দণ্ড ভােগ করেছেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস দলের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির আলােচনা শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যাওয়ার প্রস্তাব সমর্থন না করে পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ থেকে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উচ্চারিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদ প্রথমবারের মতাে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন। তিনি অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। ইংরেজিতে দেওয়া সেই ভাষণে যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন – I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengali should not be treated as a provincial language. It should be treated as the language of the state. (অর্থাৎ, আমি আমাদের রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগকে প্রকাশ করছি। এবং বাংলাকে কোনােভাবেই একটা প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে গণ্য করা উচিত নয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া উচিত।)
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ আপাত নিরীহ বক্তব্য সেদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ গণপরিষদের বাঙালি সদস্যদের একাংশ এই বিলের পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতারা এই বিলটিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের চেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেন। তারা এ প্রস্তাবের মধ্যে পাকিস্তান ভাঙার বিপদ’ এবং পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আলামত দেখতে পান। পাকিস্তানের তক্কালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবকে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস’ আখ্যা দিয়েছিল। তাদের বিরােধিতায় বিলটি বাতিল করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না গিয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশােধনীসহ বিলটি উত্থাপন করেন, কিন্তু প্রতিবারই তা একই পরিণতি বরণ করে। সে সময় রাজনৈতিক দল হিসাবে কংগ্রেসের কার্যক্রম গণপরিষদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সে সময় মুসলিম লীগ সরকার কংগ্রেস পরিষদীয় দলের মধ্যে যাদের সবচেয়ে বেশি ভয় করত এবং যাদের প্রতি সব থেকে শত্রুভাবাপন্ন ছিল, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানি জান্তা গুলি চালায়। গুলিবর্ষণের সংবাদ আইন পরিষদে পৌছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ছয়জন সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবি করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরােধ করেন। সরকারি দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ হন। কিন্তু নুরুল আমিন সব দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রিত্বের দায়িত্বকে তিনি কীভাবে নিয়েছিলেন, সেটা তাঁর আত্মকথায় পাওয়া যায় : “আমি সন্ন্যাব্রত গ্রহণ করিলাম। বস্তুত যে কোনাে দেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা, বিশেষ করিয়া অনুন্নত দেশের, সন্ন্যাব্রত গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই নহে।” (আত্মকথা, পৃ: ১১৩)।  তাঁর নাতনি আরমার লেখা থেকে জানা যায়, সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করে এক অখণ্ড জাতি গঠনের কথা গভীরভাবে ভাবতেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আরমা লিখেছেন : “দাদু বার বার বলতেন, যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ব্রিটিশরা এই দেশে বুনে দিয়ে গেছে মৃত্যুশেল হিসাবে, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার একটিমাত্র পথ আছে। আর তা হলাে, এই দেশে ইন্টার-ম্যারেজ’ হওয়া।” তাঁর এই চিন্তা নিঃসন্দেহে অসম্ভব সাহসী এবং তাৎপর্যময়।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবি ছিল তাঁর প্রিয় বই। মনে হয়, এ বই থেকেই তিনি নিজের জীবন দর্শন গড়ে নিয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে এ বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলছেন : “আমরা সবাই পথিক। মানুষের মনুষ্যত্বের পক্ষে চলবার সর্বপ্রকার দাবি অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙেচুরে যাব আমাদের পরে যারা আসবে, তারা যেন নিরুপদ্রবে হাঁটতে পারে। তাদের অবাধ মুক্তগতিকে কেউ যেন রােধ করতে না পারে।” পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর এবড়াে’ (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়ােগ করা হয়। তাকে সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করা হয় এবং এর ফলে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন। অব্যাহত দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে যাননি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর উত্তাল বাংলাদেশ। তখন তার বয়স ৮০ অতিক্রম করেছে, কিন্তু তার মনােবল ছিল অটুট। এ সময়ে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পাশাপাশি নিজের অক্ষমতা তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিল। কলকাতা প্রবাসী বড় ছেলে সঞ্জীব দত্তকে লেখা চিঠিতে তিনি বলছেন, “১৯৭০ ইং এই রাষ্ট্রের অত্যন্ত ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বৎসর- সেই রাজনীতি চিন্তা হইতে মুক্ত হইতে পারি নাই- মন যথেষ্ট চিন্তায় ভরপুর, তবু সক্রিয় অংশগ্রহণ করিতে পারিতেছি না, ইহা দুঃখময়।”
১৯৭১ সালের মার্চে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকসেনাদের সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা যখন শুরু হয়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন কুমিল্লায় নিজের বাড়িতেই ছিলেন। সেখান থেকে আগরতলা একেবারে কাছে। আত্মীয়, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে বার বার অনুরােধ জানিয়েছিল দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। জানতেন, পাকিস্তানি জান্তারা তাকে ক্ষমা করবে না। বলেছেন, “আমার বাঁচার খুবই প্রয়ােজন ছিল বাংলাদেশের জন্য, কিন্তু মনে হচ্ছে তার সম্ভাবনা নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর যে কারণে তিনি পাকিস্তান ছেড়ে যাননি, একই কারণে একাত্তরের মার্চে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হননি। বরং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তার সিদ্ধান্ত- “আমি দেশত্যাগ করব না, মরতে হয় জন্মভূমিতে মরব।” একাত্তরের ২৯ মার্চ ভােররাতে পাকিস্তানি ঘাতকের দল ছােট ছেলে দিলীপ দত্তসহ ৮৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধরে নিয়ে যায়। এ কাজে সহযােগিতা করেছিল কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী অ্যাডভােকেট আবদুল করিম। তারপর তাদের আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছােট ছেলে দিলীপ দত্তকে সম্ভবত মার্চ মাসেই হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের নাপিত রমণীমােহন শীলের কাছ থেকে জানা গেছে, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। রমণীমােহন শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারিদের প্রয়ােজনে, কারণ তার মৃত্যু হলে পাকিস্তানি সেনাদের চুল-দাড়ি কাটার মতাে কোনাে লােক থাকবে না।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর ক্যান্টনমেন্টে কী অমানবিক অত্যাচার চালানাে হয়েছিল, তার বিবরণ রমণী শীল দিয়েছেন সাখাওয়াত আলী খানকে দেওয়া এক সাক্ষাঙ্কারে। সাখাওয়াত আলী জানিয়েছেন : ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধন মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোথায় প্রস্তাব করবেন। আমি আঙুল দিয়ে ইশারায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বার বার। বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, “এটা একটা দেখার জিনিস নয়, নিজের কাজ কর।” এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি, বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তার কপালে এই দুর্ভোগ। তার ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।’ (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ, পৃষ্ঠা : ৩০২) এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তাকে হত্যা করা হয়। কারও কারও মতে, ১৪ এপ্রিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে হত্যা করা হয়।  ১৯০৬ সালে তকালীন কুমিল্লা মহকুমার মুরাদনগর থানার পূর্বধইর গ্রামের কৃষ্ণকমল দাসমুন্সীর মেয়ে সুরবালা দাসের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বিয়ে হয়। সুরবালার মৃত্যু হয় ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট। তাদের সংসারে সাত মেয়ে ও দুই ছেলে ছিল। তাঁর স্মরণে কুমিল্লা শহরে তার বাসভবনের সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক’।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা