You dont have javascript enabled! Please enable it!
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার জন্ম ময়মনসিংহ শহরের বড়বাসা এলাকায়, ১৯২০ সালের ৭ জুলাই। যদিও তাঁর পৈতৃক নিবাস পিরােজপুরের বানাড়ীপাড়ায়। তাঁর বাবা কুমুদচন্দ্র গুহ ঠাকুরতা পেশায় ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মা সুমতি গুহ ঠাকুরতাও শিক্ষকতা করতেন। ছােটবেলায় দুষ্টু আর চঞ্চল ছিলেন জ্যোতির্ময় । কিন্তু একই সাথে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। ১৯৩৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর ১৯৩৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আই, এসসি-তে ভর্তি হন। এক বছর সেখানে পড়াশােনাও করেছেন। কিন্তু টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। পরে তিনি কলকাতা থেকে ফিরে আসেন এবং ময়মনসিংহের আনন্দ মােহন কলেজে আই. এ.-তে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৩৯ সালে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে অনার্স পাস করেন। পরের বছর ইংরেজিতে দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি এম, এ. পাস করেন। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৪৩ সালে কিশােরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে। এরপর ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতার পর ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যােগ দেন। মেধাবী শিক্ষক হিসাবে ফেলােশিপ নিয়ে তিনি ১৯৬৪ সালে লন্ডন যান এবং ১৯৬৭ সালে লন্ডন কিংস কলেজ থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে ইংরেজি বিভাগের রিডার পদে উন্নীত হন।
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ছিলেন একজন আপাদমস্তক মানবতাবাদী। তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রেডিকেল হিউম্যানিজম’ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজে তিনি অগ্রগণ্য বিবেচিত হতেন। জ্যোতির্ময় ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের পর থেকেই তিনি পাকিস্তান সরকারের কুনজরে পড়ে যান। পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে পাকিস্তান মিলিটারি ইন্টেলিজেন্টের লাল খাতায় তার নাম তালিকাভুক্ত ছিল। এ কারণে পরবর্তী দিনগুলােতে ময়মনসিংহ ও ঢাকার থানাগুলােতে তার নাম ‘বিপজ্জনক ব্যক্তির তালিকায় লেখা থাকত। তবে তিনি এ বিষয়টি একেবারেই জানতেন না। এটা তিনি প্রথম টের পেলেন যখন দরখাস্ত করলেন পাসপাের্টের জন্য। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাকে বহু বিরক্ত করেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করার কারণে তার প্রতিটা কাজে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। পাকিস্তান সরকার। যে কারণে পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা বা রেডিও অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া তাঁর জন্য ছিল প্রায় নিষিদ্ধ।
জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে প্রখর ধারণা ছিল জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার। যুক্তিবাদী ছিলেন, অকাট্য যুক্তি দিয়ে বােঝাতে পারতেন। তার ছাত্ররা মনে করত, তার কাছে। একটা ক্লাস করা মানে অন্যের কাছে হাজারটা ক্লাস করার সমতুল্য। তর্ক করতে তিনি অসম্ভব ভালােবাসতেন। কিন্তু তর্ক-প্রবণতা তার গণতান্ত্রিক মননকে বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন । করেনি। গণতান্ত্রিক চেতনার প্রশ্নে তিনি মােটেও ছাড় দিতেন না। তিনি নাটক পড়াতেন। নাটকের দ্বন্দ্ব বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে ভালােবাসতেন। আর নাটকের ব্যাখ্যার ভেতরে ফাক পেলেই তিনি সাম্যবাদী রাজনীতির যুক্তি টেনে নিয়ে আসতেন। তিনি নিজেও বহু নাটক পরিচালনা করেছেন। শরীরের প্রতি বেশ যত্নবান ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দিনে সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা নিয়ম করে হাটতেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তার হাঁটার সঙ্গীরা ছিলেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক আবু নাসের ম. মুনীরউজ্জামান, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ ফারুক, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক কে, টি. হােসেন। হাটা শেষে এঁরা এসে বসতেন রেসকোর্স ময়দানে। তাদের আড্ডায় রাজনৈতিক আলাপ-তর্ক ছিল নিয়মিত ব্যাপার। স্নেহভাজনদের কাছে তিনি ঠাকুর দা’ হিসাবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন।
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা বিভিন্ন সময়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজচিন্তামূলক অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লিখিত প্রবন্ধ ‘মাইনরিটি পাকিস্তান অবজারভারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালে সংবাদ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘প্রাদেশিকতা’ প্রবন্ধ তখনকার সচেতন মানুষদের মধ্যে চিন্তার ঢেউ তুলেছিল। ‘সুইনবার্ন, স্টার্জ মুর অ্যান্ড এলিয়ট’ নামের যে অভিসন্দর্ভ তিনি পিএইচ. ডি.-র জন্য লিখেছিলেন, তা ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়। তিনি দুঃখ করে বলতেন, “আমি কিছুই লিখতে পারলাম না। প্রফেসর হয়ে আমি কিছুই রেখে যেতে পারলাম না।” তিনি তৎকালীন বাংলা উন্নয়ন বাের্ড থেকে একটা ইংরেজি অভিধান লেখার দায়িত্ব। নিয়েছিলেন, কিন্তু সে কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। তিনি যখন লন্ডন কিংস কলেজ থেকে পিএইচ. ডি. লাভ করেন, তখনও তার। পক্ষে সেখানে চাকরি নিয়ে থেকে যাওয়ার সুযােগ ছিল। কিন্তু তিনি দেশ ফিরে। আসেন। তার মা এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় সবাই থাকতেন ভারতে। দেশে তাকে পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া বহু প্রতিকূলতা মােকাবেলা করতে হতাে। তার অসুস্থ মাকে দেখার জন্যে ভারতে যাওয়ার ভিসার আবেদন করলে। সেই ভিসা পর্যন্ত দেওয়া হতাে না। তারপরও তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনও ভাবেননি।
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের শেষ দিনগুলােতে সবাই উদ্বিগ্ন, যে কোনাে সময় হামলা হতে পারে। তাই নিজের পরিচিতদের, জগন্নাথ হলের ছাত্রদের সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেছিলেন গুহ ঠাকুরতা। কিন্তু নিজে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেননি, হলের অন্য ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভেবেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার আগে স্ত্রী বাসন্তী গুহ ঠাকুরতাকে বলেছিলেন :  সবাই আমাকে সাত দিন দূরে থাকতে বলছে। আমি হলের প্রভােস্ট। আমি কি করে ছাত্রদের ফেলে যাবাে? ওদের জন্যেই তাে এ কোয়ার্টার আমাকে দিয়েছে, ফোন দিয়েছে। আমি জানি, কিছু হলে আমাকেই আগে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।” অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতা তখন থাকতেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উল্টো দিকে ৩৪ নম্বর ভবনের নিচতলায়। ২৫ মার্চ রাতে আনুমানিক ২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই ভবনে হানা দেয়। এক পাকিস্তানি অফিসার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে : “প্রফেসার সাহেব হ্যায়?” বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা ভেবেছিলেন পাকসেনারা অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। তাই তিনি স্বামীকে পাঞ্জাবি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তােমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে।” পাকিস্তানি অফিসার তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “আপ প্রফেসার সাব হ্যায়?” জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা দৃঢ়ভাবে ভারী গলায় বললেন, “ইয়েস।” “আপকো লে যায়গা।” তিনি একই ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, “হােয়াই?” তাঁর সেই ‘হােয়াই’-এর উত্তর ওরা দেয়নি। টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছে। বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা তখনও ভাবছেন, জ্যোতির্ময়কে পাকসেনারা গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।
ওই ভবনের তিনতলায় থাকতেন অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান। তার বড় ছেলে, ছােট ভাই এবং এক ভাতিজাসহ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতার দরজার সামনে। মুনীরউজ্জমানের স্ত্রী নিচে নেমে এসে দেখতে পান, তাঁর স্বামী-ছেলে সবাই মারা গেছেন এবং ড. গুহ ঠাকুরতাকেও গুলি করে ফেলে রাখা হয়েছে। তিনি গিয়ে চামচ দিয়ে জল দিলেন অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতার মুখে। কয়েক চামচ খাওয়ানাের পরই তার মনে হলাে, এখনও অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতার বাঁচার সম্ভাবনা আছে। দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিলেন বাসন্তী গুহ ঠাকুরতার ঘরের দরজায় : “দিদি, বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব এখনাে বেঁচে আছেন।” হাতের কাছেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ। কিন্তু কারফিউয়ের কারণে ২৬-২৭ তারিখ তাকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ২৮ তারিখ অধ্যাপক গুহ ঠাকুরতাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। এখানেই আরও তিনদিন তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার শরীর থেকে বুলেট বের করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে শরীরের একাংশ অবশ অবস্থায় অধ্যাপক জ্যোতির্ময় বলেছিলেন, “বােধ হয় উঠতে আর পারব না। শুয়ে বসে কাটাতে হবে। ঠিক আছে। ব’সে ব’সে বই লিখব। তাতেই চলে যাবে আমাদের।” ৩০ মার্চ রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাত নম্বর ওয়ার্ডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। তার মৃতদেহ সৎকারের জন্য তার স্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়নি। মৃতদেহ নেওয়ার জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি এসেছিল। কিন্তু তাদেরও দেওয়া হয়নি। দুদিন ধরে তার মৃতদেহ মেডিকেল কলেজের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছিল। অবশেষে জগন্নাথ হলের কয়েকজন কর্মচারী মিলে গুহ ঠাকুরতার দেহটি মেডিকেল কলেজের পশ্চিম দিকের দেওয়ালের পাশে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। জীবনে যিনি কোনাে প্রথাগত ধর্ম পালন করেননি, মৃত্যুতেও তাকে কোনাে ধর্মীয় রীতি মানতে হলাে না। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রি পাস করেছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। তাদের একমাত্র মেয়ে মেঘনা গুহ ঠাকুরতা (দোলা)।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!