You dont have javascript enabled! Please enable it! জিকরুল হক - সংগ্রামের নোটবুক
জিকরুল হক
রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক ডা. জিকরুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর বর্তমান নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম ডা. জিয়ারতউল্লাহ আহমদ, মায়ের নাম খমিউননেছা চৌধুরাণী। চার ভাই ও দুই বােনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। জিয়ারতউল্লাহ আহমদের আদি নিবাস দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার পলাশবাড়ীতে।।
জিকরুল ১৯৩৩ সালে সৈয়দপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৩৯ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এল, এম. এফ. পাস করেন। মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় তিনি এ. কে. ফজলুল হক এবং হােসেন সােহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরপর তিনি মুসলিম লীগে যােগ দেন। জিকরুল হক থানা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি এবং জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।  এম, এল, এফ, পাস করে দারওয়ারি হাসপাতালের হাজারীহাট দাতব্য চিকিৎসালয়ে অবৈতনিক মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরে ডাঙ্গারহাট শাহ আব্দুল গফুর চ্যারিট্যাবল ডিসপেন্সারিতেও অবৈতনিক মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে পিতার প্রতিষ্ঠিত জেয়ারতউল্লাহ মেডিকেল হলে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেন। এরপর তিনি সৈয়দপুরে ফিরে আসেন এবং চিকিৎসা পেশার সাথে সাথে রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভােটে জয়ী হয়েছিলেন।
সৈয়দপুর এলাকাটি অবাঙালি অধ্যুষিত। এরকম একটি এলাকা থেকে তিনি ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের এম. পি. এ. (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভােটে। তাঁর এই জনপ্রিয়তার কারণ ছিল বিভিন্ন সমাজসেবামূলক ও শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম। তিনি সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২ বছর সেক্রেটারি ছিলেন। সৈয়দপুর ৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল ও সৈয়দপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর অবদান এখনও স্মরণযােগ্য। এছাড়া তিনি। সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শিল্প-সাহিত্য সংসদের সভাপতি। ছিলেন। সৈয়দপুর জামে মসজিদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজেও জড়িত ছিলেন। হাজারীহাট পােস্ট অফিস স্থাপনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
জিকরুল হকের ডাক্তারখানায় যেসব মানুষ আসতেন, তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন গরিব। তিনি তাদের কাছ থেকে কখনও টাকা নিতেন না। এমনকি যাদের সামর্থ্য ছিল, তাদের কাছ থেকেও কখনও টাকা চেয়ে নেননি। যে যা দিয়েছেন, তা-ই নিয়েছেন। পাকিস্তান শাসনামলে একজন অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় স্থানীয় অবাঙালিরা সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয় কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা করে। তারা চেষ্টা করেছিল ওই বিদ্যালয়টি বাঙালিমুক্ত রাখার। তাদের এই চক্রান্ত তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন নিয়ে সৈয়দপুরে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় বাঙালিদের অনেকেই জিকরুল হকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ৮টার সময় পাকসেনারা বাবুপাড়ার তার বাড়িতে হানা দেয় এবং তাকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত তাকে রংপুর সেনানিবাসে অন্যান্য নেতার সঙ্গে আটক রেখে পাক সেনারা অমানুষিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। ১২ এপ্রিল সকলের সাথে ডা. জিকরুল হককে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের কাছে গুলি করে হত্যা করা হয়। ডা. জিকরুল ফুল অসম্ভব ভালােবাসতেন। তার স্ত্রীর নাম আজিজা খাতুন। তাদের সংসারে নয় ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় জিকরুল হকের আপন দুই ভাই জহুরুল হক ও আমিনুল হক এবং ভাইয়ের ছেলে কুদরত-ইএলাহীসহ আরও কয়েকজন আত্মীয় শহীদ হন। তার দুই ভাইয়ের একজনকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং আরেকজনকে ১৪ ডিসেম্বর অবাঙালিরা হত্যা করে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা