You dont have javascript enabled! Please enable it!
জহির রায়হান
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে হারিয়েছি, কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তাদের অন্যতম। তার অন্তর্ধান ও মৃত্যু এখনও এক রহস্য। জহির রায়হান জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালের ৫ আগস্ট ফেনীর জেলার সােনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে (বিভিন্ন জায়গায় তাঁর জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ আগস্ট, কিন্তু তাঁর বােন দাবি করেছেন জহির রায়হানের জন্ম তারিখ ৫ আগস্ট)। তাঁর বাবার নাম মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। মওলানা মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতার ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া” বা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির রায়হানের পারিবারিক নাম জহিরুল্লাহ। পাঁচ ভাই ও তিন বােনের পরিবারের একজন জহির রায়হান। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার তার বড় ভাই।  বাবার চাকরির সুবাদে জহির রায়হানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। তিনি কলকাতায় মিত্র ইনস্টিটিউটে এবং পরে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশােনা করেন। ভারত বিভাগের পর পরিবারের সাথে নিজ গ্রামে চলে আসেন। তিনি ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে আই. এসসি. পাস করেন তিনি। সাহিত্য অনুরাগী হওয়ায় বিজ্ঞান ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে বি. এ. (অনার্স) পাস করেন।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন জহির রায়হান। ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। অন্যদের সঙ্গে তাকেও মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করা হয়।  জহির রায়হান ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। পার্টিতে তিনি কুরিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌছে দিতেন। গােপন পার্টিতে তার নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। ধীরে ধীরে তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানবিরােধী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। সক্রিয় ছিলেন জহির। তিনি ১৯৫৮ সালে সামরিক আইনে কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেন জহির রায়হান।  সাংবাদিকতায়ও জহির রায়হানের অবদান আছে। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলাে পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ‘খাপছাড়া’, ‘যাত্রিক’, ‘সিনেমা’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসাবে ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় যােগ দেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়া জহির রায়হান ‘সমকাল’, ‘চিত্রালী’, ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘সিনেমা’, ‘যুগের দাবী’ প্রভৃতি পত্রিকার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি চিত্রালীতে প্রবেশ নিষেধ’ শিরােনামে একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলেন।
ফটোগ্রাফি শিখতে গিয়ে ধীরে ধীরে জহির রায়হান চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৫২ সালে কারাভােগ শেষে ফটোগ্রাফি শেখার জন্য তিনি কলকাতায় প্রমথেশ বড়ুয়া মেমােরিয়াল ফটোগ্রাফি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ শুরু করেন। এই শিল্পে তার প্রথম কাজ ‘জাগাে হুয়া সাবেরা’। এ ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। তিনি সালাউদ্দীনের যে নদী মরুপথে’ ছবিতেও সহকারী হিসাবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে ‘এ দেশ তােমার আমার’ ছবিতে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। | ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের স্বল্প সময়ে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে অসাধারণ কাজ করেন জহির রায়হান। ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম ছবি ‘কখনাে আসেনি’। এরপর ‘সােনার কাজল’ (কলিম শরাফীর সাথে যৌথ পরিচালনা), কাচের দেয়াল’, ‘বেহুলা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘আনােয়ারা’, ‘সংগম’, ‘বাহানা’, ‘জ্বলতে সুরুজ কে নীচে’ ছবি বানিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে ‘কাচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি “নিগার’ পুরস্কার লাভ করেন। তকালীন সমগ্র পাকিস্তানে তিনিই প্রথম রঙ্গিন (টেকনিকালার) ছবি ‘সঙ্গম নির্মাণ করেন। উর্দু ছবি ‘বাহানা’ তকালীন পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি। পরিচালক, প্রযােজক, লেখক ও চিত্রনাট্যকার হিসাবে মােট ২৩টি চলচ্চিত্রের সাথে জহির রায়হান জড়িত ছিলেন। এছাড়া আলমগীর কবির নির্মিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবিটির মূল পরিকল্পনাকারীও ছিলেন তিনি।
১৯৬৫ সালে জহির রায়হান তার উপন্যাস আর কতদিন’ অবলম্বনে ‘Let Their Be Light’ নামে একটি ছবি করার কথা ঘােষণা করেছিলেন। জহির। রায়হানের ইচ্ছে ছিল, ছবিটি নির্মিত হবে ইংরেজি ভাষায় এবং ডাব করা হবে বাংলা, উর্দু, রুশ এবং ফরাসি ভাষায়। উর্দু এবং ইংরেজি সংলাপ লিখেন কবি ফয়েজ আহমেদ, রুশ সংলাপ লিখবেন নােবেল পুরস্কার বিজয়ী রুশ ঔপন্যাসিক মিখাইল। শলােকভ। জহির রায়হান এই ছবির কাজ শুরু করেন ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে। ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। শুটিং শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশ অসহযােগ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায় । মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান চালান এবং তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত তার চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কলকাতায় হয়। চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাসহ অনেকেই প্রশংসা করেন। নিজের আর্থিক সংকট সত্ত্বেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে পাওয়া পুরাে অর্থ তিনি মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দিয়ে দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার নির্মমতা এবং বাঙালির মুক্তির আকুতি তুলে ধরে তিনি প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনােসাইড’ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কোনাে ধরনের চিত্রনাট্য ছাড়াই তিনি এ ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এ ছবিটির ধারা বর্ণনা করেন আরেক পরিচালক আলমগীর কবির। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে এসে ‘অ্যা স্টেট ইজ বন নামের তথ্যচিত্রটি সম্পন্ন করেন।
জহির রায়হান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় শরণার্থী শিল্পীসংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে গড়ে তােলেন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী পরিষদ’। এই ব্যানারে শুধু নিজেই ‘স্টপ জেনােসাইড’ নির্মাণ করেননি, আলমগীর। কবির, বাবুল চৌধুরীকে সহায়তা করেন একগুচ্ছ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে। বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘ইনােসেন্ট মিলিয়নস্’ এবং আলমগীর কবীর নির্মাণ করেন “লিবারেশন। ফাইটার্স’। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববাসীর সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ড, শরণার্থীদের দুর্দশা তুলে ধরা। জহির রায়হানের সাহিত্যচর্চা শুরু স্কুল জীবন থেকে শুরুর দিকে তিনি কবিতা লিখতেন, আর পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন তাঁর রচনার একনিষ্ঠ শ্রোতা প্রথমপ্রকাশিত রচনা হলাে কবিতা ‘ওদের জানিয়ে দাও’
ওদের জানিয়ে দাও।
ওরা আমার ভাইবােনকে
কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে।
ওদের ষ্টীম রােলারের নীচেওদের জানিয়ে দাও।
ওরা দেখেও যদি না দেখে বুঝেও যদি না বুঝে।
আগুনের গরম শলাকা দু’চোখে দিয়ে ওদের জানিয়ে দাও
 মরা মানুষগুলােতে কেমন জীবন এসেছে।
 
কবিতাটি ১৯৪৯ সালে নতুন সাহিত্য কুটির’ থেকে প্রকাশিত ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছােটগল্প ‘হারানাে বলয়’। এটি প্রকাশিত হয় ড. আলীম চৌধুরী এবং এম. এ. কবীর সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় ১৯৫১ সালে; জহির রায়হান তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। জহির রায়হানের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়। গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’। তার রচিত প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৬০ সালে। এটি প্রথমে সাপ্তাহিক “চিত্রালী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের নায়ক কাসেদ একজন কেরানি। কেরানি জীবনের স্বপ্ন ও সামর্থ্যের করুণ-মধুর কাহিনি নিয়ে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। জহির রায়হানের সবচেয়ে জনপ্রিয়।  ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ধরা হয় ‘হাজার বছর ধরে’। এ উপন্যাস প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭১ সনে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের দুঃখ-দারিদ্র্য, সংস্কার-সংকীর্ণতা এ উপন্যাসের মূল বিষয়। এ উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পান।
জহির রায়হানের পরবর্তী উপন্যাস ‘আরেক ফাল্লুন। এটি ১৯৫২ সালের  একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে রচিত। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তৎকালীন ছাত্র, শিক্ষক, কেরানিসহ সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে।  ভাষা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন উপলক্ষে ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি এবং তাকে কেন্দ্র করে নতুন আন্দোলনের সূচনা এ উপন্যাসের ভরকেন্দ্র। উপন্যাস শেষ হয় ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবাে’- এই আশাবাদ দিয়ে। জহির রায়হানের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন স্থান পেয়েছে সবচেয়ে বেশি।  জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭৬ সনে। উপন্যাসটি প্রথমে ‘উত্তরণ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটি এক  শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি। আর কতদিন’ প্রকাশিত হয় ১৩৭৭। সনে। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় “সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকায়। আর কতদিন একটি প্রতীকধর্মী রচনা। এই ক্ষুদ্রাকার রচনাটিতে কোনাে কাহিনি। বলার প্রয়াস নেই, চরিত্র সৃষ্টির প্রয়ােজন সে কারণেই দেখা দেয়নি। জহির রায়হান লিখেছেন :
ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে হিরােশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে। জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বােনটা এক সাদা কুত্তার বাড়িতে বাদি ছিল। তার প্রভু তাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে হত্যা করে মেরেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই, তাকে ফাসিতে ঝুলিয়ে মেরেছে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালােবাসতাে। … বর্ণের নামে, জাতীয়তার নামে, সংস্কৃতির নামে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে নির্মমভাবে। বিপন্ন মানবতা এবং নিপীড়িতলাঞ্ছিত মানুষ অশুভের অন্ধকার থেকে কল্যাণের আলােতে ছুটে চলেছে, মানুষের এ এক নিরন্তর যাত্রা।
 
‘তৃষ্ণা’ উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৬২ সাল। এটি ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে শওকত ও মার্থার মধ্য দিয়ে মানুষের চিরন্তন জীবনতৃষ্ণার কথা ব্যক্ত করেছেন জহির রায়হান। সামান্য একটু নিশ্চয়তা, সুখ আর শান্তির জন্যে শওকত ও মার্থা জীবন মন্থন করেছে দু’হাতে, কিন্তু জীবন তাদের কিছুই দেয়নি। কয়েকটি মৃত্যুর প্রকাশকাল বাংলা ১৩৮২ সন। এটি প্রথম সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। জহির রায়হানের দুটি সিনেমা নিয়ে বিশেষভাবে বলা যায়। এর প্রথমটি হলাে ‘বেহুলা’ যা ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। বেহুলার মধ্য দিয়ে জহির বােঝানাের চেষ্টা করেছেন যে মানুষ যদি মানুষকে ভালােবাসে, তাহলে মৃত্যুর কাছ থেকেও তাকে ফিরিয়ে আনা যায়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দর। সংক্রান্ত লােককথার একটা নতুন ব্যাখ্যা এখানে হাজির করলেন জহির রায়হান।  জহির রায়হানের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া। পূর্ব পাকিস্তানের সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পটভূমিতে নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি সংগ্রামী মানুষের আলেখ্য হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। যে সময়ে ছবিটির জন্ম, সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে এই ছবিকে একটি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা বলে মানতে হয়। এই ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে পরিচালক জহির রায়হান অনেক সরকারি বাধার সম্মুখীন হন। যদিও এ ছবির নাম প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’। ১৯৭০ সালের ১৬ জানুয়ারি জহির রায়হান এ নামে ছবি করার জন্য এফডিসিতে আবেদন করেন। কিন্তু অনুমােদন পাওয়ার পর ২৮ জানুয়ারি জহির রায়হান ছবির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। এ ছবির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল এভাবে :
একটি দেশ।
একটি সংসার।
একটি চাবির গােছা একটি আন্দোলন
বড় পর্দায় জনগণের রাজনৈতিক চাহিদার এত স্বতঃস্ফূর্ত রূপায়ণ বাংলাদেশের আর কোনাে সিনেমায় দেখতে পাওয়া যায় না। যদিও ঘরানার দিক থেকে সিনেমাটিকে সামাজিক বা পারিবারিক বলা চলে, কিন্তু এর মাঝেই পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী জনগণের অব্যক্ত কথার সুন্দর প্রতিফলন ঘটিয়ে দেখিয়েছেন নির্মাতা জহির রায়হান ।
১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (মরণােত্তর) দেওয়া হয় জহির রায়হানকে। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক (মরণােত্তর) এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে’ (মরণােত্তর) ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে তাঁকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে’ (মরণােত্তর) ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর পরই ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন জহির রায়হান। এসে শুনতে পান, বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে এবং তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন দেশের আরও অনেক বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনার বিচারের দাবি নিয়ে তিনি সােচ্চার হয়ে ওঠেন। তারই চেষ্টায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। জহির রায়হান ছিলেন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাশারত আলী ছিলেন সদস্য সচিব। জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি ঘরে ছিল এই কমিশনের দফতর।  বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত কাজের পাশাপাশি তিনি ক্যামেরায় তুলতে থাকেন পাকিস্তানি বর্বরতার ছবি। ৩০ ডিসেম্বর ভােরে তিনি খবর পান যে শহীদুল্লা কায়সারকে ঢাকার মিরপুরে রাখা হয়েছে। তিনি তাকে উদ্ধারের জন্য সেখানে যান। ওই সময় মিরপুর ছিল ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বিহারি অধ্যুষিত এলাকা। ভারতীয় মিত্র বাহিনী মিরপুর ঘিরে রেখেছিল  কেউ কেউ দাবি করেন যে সেদিন বিহারি ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশিদের ওপর অতর্কিতে গুলি চালালে তিনি নিহত হন। ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি মিরপুর হানাদার মুক্ত হয়। কিন্তু জহির রায়হানকে আর পাওয়া যায়নি, তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি। মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রমের ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে তিনি লিখেছেন : সেদিন বিহারিদের আক্রমণের মুখে বেঁচে যাওয়া সেনাসদস্যদের কাছ থেকে। ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনি। বিশেষ করে ডি কোম্পানির অধিনায়ক হেলাল মাের্শেদ ও প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার ওয়াজেদ আলি মিয়া বারকী ঘটনার বিস্তারিত জানান।  ওই সময় আমাদের সৈন্যদের কোনাে মৃতদেহ দেখতে পাইনি। পরিস্থিতির কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ভেতরের দিকে খোঁজাখুঁজি করা সম্ভব হয়নি। নিহতদের মধ্যে লে. সেলিমসহ মাত্র কয়েকজনের মৃতদেহ দিন দুয়েক পর। পাওয়া যায়। পুরাে এলাকা জনশূন্য করার পরও বাকিদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ৩০ জানুয়ারি রাতেই সম্ভবত বিহারিরা সেগুলাে সরিয়ে ফেলে। (পৃ : ২৬-৩৪)

জহির রায়হান ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে ও ১৯৬৬ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করেন। দু’জনেই ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সুমিতা দেবীর সংসারে তার দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। আরেক স্ত্রী সুচন্দার সংসারে দুই ছেলে অপু রায়হান ও তপু রায়হান।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!