You dont have javascript enabled! Please enable it!
গােলাম হােসেন
১৯১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় গােলাম হােসেনের জন্ম। যদিও তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুরে। তার বাবা খান সাহেব গােলাম রব্বানী ব্রিটিশ শাসনামলে পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন এবং পুলিশ সুপার হিসাবে অবসর নেন।  অল্প বয়সেই গোলাম হােসেন তার মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর শােকগ্রস্ত গােলাম হােসেন মাত্র ১১ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে একা একাই ইউরােপে চলে গিয়েছিলেন। এতে তার পড়াশােনায় ছেদ পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। এরপর কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে প্রথম বিভাগে আই. এ. পাস করে বৃত্তি লাভ করেন।  রিপন কলেজে বি. এ. পড়ার সময়ই গােলাম হােসেন তঙ্কালীন বেঙ্গল পুলিশে সাব ইন্সপেক্টর হিসাবে যােগ দেন। ভারত ভাগের পর চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। বিভিন্ন সময় পাকিস্তান গােয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশ বিভাগে, কুষ্টিয়া ও ঢাকায় বিভিন্ন পদে চাকরির পর ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে বরিশালে বদলি হন।
ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় তিনি চুয়াডাঙ্গায় এস. ডি. পি. ও. (মহকুমা পুলিশ প্রশাসক) ছিলেন। তখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (পাঞ্জাবি এস. ডি. ও.) আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলি চালানাের নির্দেশ দিলেও তিনি তা পালন করেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে গােলাম হােসেন তার সাথে সক্রিয়ভাবে একাত্মতা ঘােষণা করেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে গােলাম হােসেন প্রতিরােধযােদ্ধাদের সহযােগিতা করার জন্য সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন। বরিশালের পুলিশ সুপারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় এম, এল. এ. নূরুল ইসলাম মঞ্জু এবং প্রতিরােধযােদ্ধাদের অধিনায়ক মেজর জলিলের হাতে বরিশাল পুলিশ লাইন্স থেকে ১০০ রাইফেল সরবরাহ করেছিলেন। ২৯ মার্চ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগার খুলে দিয়ে অবশিষ্ট অস্ত্রগুলােও প্রতিরােধযােদ্ধাদের দিয়ে দেন।
গােলাম হােসেন হয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। ১৯৭১ সালের ২৬  এপ্রিল বরিশাল শত্রু কবলিত হলে তিনি আত্মগােপনে চলে যান এবং সহকর্মী ও কোর্ট ইন্সপেক্টর জোনাব আলীর বাসায় আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সেনারা তখন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। এ সময় তার সহযােগীদের কয়েকজন তাকে ধরিয়ে দেন। জোনাব আলীর বাসা থেকেই ২ মে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে অজ্ঞাত কোনাে স্থানে মরদেহ মাটিচাপা অথবা নদীতে ফেলে দিয়েছে। হত্যার সঠিক তারিখ জানা যায়নি।
গােলাম হােসেনের ভূমিকা ও মৃত্যু সম্পর্কে জানা যায় তার স্ত্রী সৈয়দা জাকিয়া বানুর ‘আমার স্বামী’ রচনায়। তিনি লিখেছেন :
বরিশালের সেই আগুনঝরা সংগ্রামী দিনগুলির কথা আজও মনে পড়ে। আমাদের বাংলার সামনে দিয়ে যখন উত্তেজিত জনতার মিছিল যেত, আমার স্বামী হাত তুলে তাদের অভিনন্দন জানাতেন। অনেক দামাল ছেলে হয়তাে অনেক সময় পুলিশ লাইনের মধ্যে ঢুকে যেত, তিনি বলতেন, এখন নয়, সময় হলে আমি তােমাদের ডেকে নেবাে, আমি তােমাদেরই।…
১৮ এপ্রিল হানাদার বাহিনী বরিশালে চলে আসে এবং অনেকে গােলাম হােসেনের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে এবং কে বা কারা গােলাম হােসেন সাহেবের রাইফেল বণ্টনের ছবি ও ভাষণ টেপ করে রেখেছিল, সেগুলি ব্রিগেডিয়ার আতিক, মেজর এহিয়া, মেজর আসলামের হাতে অর্পণ করে। আমার সুমহান দেশপ্রেমিক স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমার স্বামীর কোনাে স্মৃতিচিহ্ন আমি পাইনি। তিনি ভালাে কাজের পুরস্কারস্বরূপ পিপিএম মেডেল পেয়েছিলেন। হানাদার বাহিনী ও বরিশালের স্থানীয় লােক, সাথে পুলিশের লােকও ছিল- এরা। সবাই মিলে আমার বাসার সমুদয় জিনিসপত্র লুটপাট করেছিল। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) গােলাম হােসেন ও সৈয়দা জাকিয়া বানুর সংসারে এক ছেলে ছিল, তার নাম মােহসীন মাে. ইকবাল।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!