You dont have javascript enabled! Please enable it! গােবিন্দচন্দ্র দেব - সংগ্রামের নোটবুক
গােবিন্দচন্দ্র দেব
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব সবার কাছে পরিচিত ছিলেন জি. সি. দেব নামে। তঙ্কালীন আসাম প্রদেশের পঞ্চখণ্ড পরগনার এবং বর্তমান সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামের এক ধনী পরিবারে ১৯০৭ সালে তার জন্ম। তাঁর পুরাে নাম গােবিন্দচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ। তার বাবার নাম ইশ্বরচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ এবং মায়ের নাম শরৎ সুন্দরী দেবী। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। হাসি-খুশি, খােশমেজাজি এবং মানবিক উদার হৃদয়ের এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন গােবিন্দচন্দ্র দেব। গােবিন্দচন্দ্র দেব শৈশবে নিজের বাড়িতে একজন হিন্দু পণ্ডিতের কাছে ভারতীয় ঐতিহ্যের বেদ-বেদান্ত-উপনিষদের পাঠ নিয়েছেন। তিনি ১৯২৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে (একটি সূত্রে বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘পঞ্চখণ্ড হরগােবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়) প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর ১৯২৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শনে অনার্সসহ বি. এ. পাস করেন এবং ১৯৩৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দর্শন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে এম, এ. পাস করেন।
এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধীনে বিনা বেতনে দর্শনের উপর গবেষণার কাজ শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে ‘Reason, Intution and Reality শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। | শিক্ষাজীবনের শেষে ১৯৪৪ সালে কলকাতায় গবেষণার মাধ্যমে গােবিন্দচন্দ্র দেবের কর্মজীবন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে রিপন কলেজের কার্যক্রম বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হয়। ড, দেব দিনাজপুরে চলে আসেন। দিনাজপুরের এই কলেজটির জন্মলগ্ন থেকেই ড. দেবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই কলেজের জন্য ড. দেব গরুর গাড়িতে করে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে ধনীদের কাছ থেকে টাকা এবং চাল সংগ্রহ করে তহবিল তৈরি করেছেন। তিনি মানুষের কাছে এই বলে আবেদন রাখতেন যে, “আপনাদের দেশে একটা প্রথম কলেজ হলাে। আপনাদের ছেলেমেয়েরাই এতে পড়বে। একে বাঁচাতে টাকার প্রয়ােজন, যা আপনারাই পারেন দিতে।” পরবর্তী জীবনে নিজের গড়া কলেজ এবং ভক্তজনদের দেখতে মাঝে মধ্যেই ড. দেব দিনাজপুরে আসতেন।
বেশ কয়েক বছর দিনাজপুর কলেজে শিক্ষকতা করার পর ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যােগ দেন। ১৯৫৬ সালের ৩ মার্চ তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পান। হল প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে ছাত্রদের সমস্ত সুবিধা-অসুবিধার দেখভাল করার পাশাপাশি ছাত্রদের বসবাসের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। ড. দেব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। তবে ওই সময় তিনি ছুটিতে ছিলেন। ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব ১৯৬৩ সালে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৬৭ সালে বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন। এ সময় আমেরিকার পেন সিলভেনিয়া প্রদেশের উইল কসবার কলেজের ভিজিটিং প্রফেসরও ছিলেন। ফিরে এসে পুনরায় দর্শন বিভাগে যােগ দেন। তিনি লন্ডনে ‘The Union Of The Study of Great Religion’ এবং আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের “Philosophy And Science Association’-এর সদস্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া প্রদেশের উইলকসবার কলেজে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে যােগ দেন এবং সেখানে দর্শন বিভাগের কেন্দ্রীয় গবেষণা কক্ষে দিন-রাত গবেষণার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। এ সময় তাঁর গুণগ্রাহীদের দিয়ে ‘ওয়ার্লড ব্রাদারহুড’ নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। 
তিনি সাতটি ইংরেজি ও দুটি বাংলা বই এবং বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে শতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর পিএইচ. ডি. অভিসন্দর্ভটি সামান্য। পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে ১৯৫২ সালে ‘Idealism and Progress’ নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। তাঁর অন্য বইগুলাে হলাে : ‘Idealism: A New Defense an A New Application’ (১৯৫৮), ‘আমার জীবন দর্শন’ (১৯৬০), *Aspirations of the Common Man’ (১৯৬৩), ‘The Philosophy of Vivekananda and the Future of Man’ (১৯৬৩), “তত্ত্ববিদ্যাসার’ (১৯৬৬), “Buddha : The Humanist’ (১৯৬৯), ‘Parables of the East (মরণােত্তর প্রকাশনা, ১৯৯৩), ‘My American Experience’ (মরণােত্তর প্রকাশনা, ১৯৬৯)। ড. দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব দর্শনকে ভালােবেসেছিলেন সমগ্র অন্তর দিয়ে। উদাত্ত কণ্ঠে বলতেন : “Philosophy is my first love, philosophy is my last love।” এটা নিছক মুখের কথা ছিল না; এটা ছিল তার সমগ্র জীবনসাধনার চুম্বকসার। ড. দেবের নিজের ভাষায় : “সারা জীবনদর্শনের সঙ্গে যােগ স্থাপনের চেষ্টা করে এ সত্য উপলব্ধি করেছি যে, দর্শনমাত্রই জীবনদর্শন। দর্শন কথাটি তাই জীবনদর্শন কথারই প্রতিশব্দ।” | ড. দেবের পাণ্ডিত্য ছিল ব্যাপক ও বহুমুখী। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হিসাবে। কিন্তু এই জ্ঞান তার মধ্যে অহমিকার জন্ম দেয়নি, তাকে বিনয়ী করেছিল। সক্রেটিস যেমন বলতেন, “আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র’, তেমনি ড, দেবও প্রায়ই বলতেন, “কে দার্শনিক? আমি দার্শনিক নই, দর্শনানুরাগী মাত্র- শ্ৰীমতী দর্শনই আমার প্রথম ও শেষ প্রেম।”
চলায়-বলায়, কথায় ও চিন্তায় উদার, নির্বিবােধ এবং নিরহংকার মানুষ ছিলেন গােবিন্দচন্দ্র দেব। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই তার গায়ে থাকত সেই চিরাচরিত পােশাক- সাধারণ মানের ধুতি, খদ্দরের পাঞ্জাবি, কাধে ঝুলানাে খদ্দরের চাদর। তাঁর জীবনযাপন এবং বেশভূষা এত সাধারণ ছিল যে বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারত না মানুষটি কোন স্তরের। একটি ঘটনা তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় হাসতে হাসতেই উল্লেখ করেছেন। গল্পটি এ রকম : একদিন তিনি স্টিমারে ভ্রমণ করার সময় আপার ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। টিকেট পরীক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত কর্মকর্তা তাকে ওখানে দেখে তাে অবাক। ভাবখানা এমন, এ আটপৌরে বেশভূষার সাধারণ লােকটা কী করে এল এখানে, আপার ক্লাসে? অবশেষে ড. দেবকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “এটা আপার ক্লাস।” আপার ক্লাস? বিষয়টা অনুধাবন করতে কষ্ট হলাে না সুরসিক দার্শনিক ড. দেবের। সহজ-সরল ইংরেজিতে ওই উৎসুক কর্মকর্তাকে তিনি জানিয়ে দিলেন : “My dear friend, my apperrance is third class, but my ticket second class.”  অধ্যাপক গােবিন্দচন্দ্র দেব বহু এতিম ছেলেমেয়েকে নিজের সন্তানের মতােই লালনপালন করেছেন। তিনি জগন্নাথ হলের বাংলােতে এবং ধানমন্ডিতে অবস্থিত তার নিজ বাসভবনে এই এতিম ছেলেমেয়েদেরকে থাকার জায়গা করে দিয়েছিলেন। চিরকুমার ড. দেব মানুষকে বিচার করেননি ধর্মীয় গোঁড়ামি দিয়ে। তাঁর দর্শনের মূল। কথা ছিল মানুষের বড় পরিচয় ধর্মীয় লেবাসে নয়, মানুষের বড় পরিচয় সে মানুষ। তার এ মনােভাবের কারণে বহু মুসলমান ছেলেমেয়ে তার সহযােগিতা পেয়েছে, তার কাছে লালিত-পালিত হয়েছে। 
মানুষের প্রতি তাঁর দরদবােধ কত গভীর ছিল তা বােঝার জন্যে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। তারই ছাত্র অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের স্মৃতিচারণে ঘটনাটি উল্লেখ আছে। ১৯৬৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রামকৃষ্ণ মিশনের আমন্ত্রণে তিনি কুমিল্লা গিয়েছিলেন। ঢাকায় ফেরার সময় রিকশায় করে যাচ্ছিলেন কুমিল্লা বিমানঘাঁটিতে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন, কুমিল্লার সর্বনিম্ন রিকশা ভাড়া মাত্র এক আনা। এটা শুনে তিনি বিস্ময় ও বেদনায় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। খানিক চুপ করে থেকে তিনি বলেছিলেন, “এটা কিন্তু অসহায় শ্রমজীবী মানুষের ওপর একটা অত্যাচার।” এরপর বিমানঘাঁটিতে পৌছে তিনি ওই রিকশাচালককে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ড. দেব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। তখন তার একাডেমিক ছুটি চলছিল। পায়ের প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের উত্তাল পরিস্থিতি আর পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচারের খবর শুনে এই অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি বিদেশের মাটিতে নিশ্ৰুপ বসে থাকতে পারলেন না। সাধারণত কোনাে রাজনৈতিক আলােচনায় তিনি যােগ দিতেন , কিন্তু সচেতন থাকতেন পুরােপুরি। দেশে এসে গােবিন্দচন্দ্র দেব প্রথমে শিক্ষকদের সংঘবদ্ধ করার কাজে মনােনিবেশ করেন এবং সংগ্রাম পরিষদের একজন বলিষ্ঠ সদস্য হিসাবে তিনি নিজেকে নিয়ােজিত করেন ও পুরাে উদ্যমে কাজ আরম্ভ করেন।  জগন্নাথ হলের সামনে একতলা একটি কোয়াটারে ড, দেব থাকতেন। সময়ের সাথে সাথে তাঁর শরীরে নানা সমস্যা বাড়ছিল। মার্চ মাসে দাতেও ব্যথা শুরু হলাে। দাঁতের ব্যথা গলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। ২৩ মার্চ কয়েকজন ছাত্রনেতা তার সাথে দেখা করেন। স্বাধীন বাংলার পতাকা বানানাের জন্য তাদের হাতে কিছু অর্থ তুলে দেন। তাদের সাথে আলাপে তিনি বলেন, এবার দেশের কিছু একটা হবেই। এ সময়ের পুরাে ঘটনা উ. দেবের পালিত কন্যা রােকেয়া সুলতানা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বর্ণনা করেছেন। তার দেওয়া বক্তব্য থেকে জানা যায়, শরীর ভালাে না। থাকায় ২৫ মার্চ রাতে ড. দেব আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত ১১টার কিছু পরে গুলির শব্দ সবাই জেগে ওঠেন। ঝাকে ঝাকে গুলি এসে পড়ছিল বাসার উপর। বাসাটা থর থর করে কাপছিল।
ড. দেব থাকতেন মাঝের ঘরে। শেষের ঘরটায়। থাকতেন বেগম রােকেয়া সুলতানা ও তার স্বামী। গুলির শব্দে স্বামীকে জাগালেন এবং বাচ্চাকে বুকে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে ড, দেবের কক্ষে ঢােকেন। ভাের রাতের দিকে গুলির তীব্রতা এতই বাড়ল যে সবাইকে বাসার কোণের ছােট্ট একটা ঘরে আশ্রয় নিতে হলাে। গুলির সাথে সাথে মাইক লাগিয়ে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে ইংরেজিতে আদেশ দিচ্ছিল। ২৬ মার্চের সকালের দিকে গুলির তীব্রতা কমতে শুরু করে। রাত জাগার ফলে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েন ড. দেব। জগন্নাথ হলের সামনে শুধু পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্য। মাঠের মাঝখানে রাতের হামলায় নিহত ও আহতের লাশ। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাঝের ঘরটায় জড়াে হলেন তারা। এমন সময় দরজায় আঘাত পড়ে। শব্দ ভেসে আসে, ‘মালাউন কা বাচ্চা দরওয়াজা খােল দে’। উত্তেজনায় ড. দেব উঠে দাঁড়ান। তাকে জোর করে বসিয়ে দেন রােকেয়া। ততক্ষণে দরজায় লাথির পরে লাথি পড়ছে। বাচ্চাকে রােকেয়ার কোলে দিয়ে উ, দেবকে সামলাতে বলে তার স্বামী দরজা খুলতে এগিয়ে যান। কাছে যেতে না যেতেই দরজা ভেঙে গায়ের উপর পড়ে। পাকসেনাদের লাথির আঘাতে রােকেয়ার স্বামী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উঠে দাঁড়াতেই একজন রাইফেলের বাট দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। এ সময় একটি গুলি এসে বিধে রােকেয়ার স্বামীর বুকে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। বাচ্চাসহ রােকেয়া ও ড. দেব তখন মাঝের ঘরে দাড়ানাে।
পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে ড, দেব বললেন, “বাবারা, কী চাও এখানে?” একজন সেনা কর্মকর্তা ড. দেবের কাছে জানতে চাইল, “What is your name?” ড. দেব উত্তর দিলেন, “আমি অধ্যাপক গােবিন্দচন্দ্র দেব।” এটাই ছিল ড. দেবের জীবনের শেষ কথা। তার কথা শেষ হতে না হতেই হানাদার সৈন্যরা গুলি করে। দুটি গুলি তার কানের পাশ দিয়ে মাথায় লাগে, বেশ কয়েকটি বুকে লাগে। চোখের পলকে লুটিয়ে পড়ে ড. দেবের দেহ। রােকেয়াকেও তারা রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। ড. দেবের মৃত দেহটাকে হানাদার সৈন্যরা বেয়নেট দিয়ে বারে বারে বিদ্ধ। করে। ড. দেবের রক্তাক্ত দেহ অনেকক্ষণ সেখানেই পড়ে ছিল। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে ঘণ্টাখানেক পর তিনি মারা যান। তার মৃতদেহ সারাটা দিন জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে ফেলে রাখে পাকসেনারা। বেলা শেষে সন্ধ্যায় অধ্যাপক গােবিন্দচন্দ্র দেবের মৃতদেহ অন্যান্য শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে গণকবর দেয় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
ড. গােবিন্দচন্দ্র দেব নিজেকে আখ্যায়িত করতেন ভাববাদী স্বাপ্নিক বলে। কিন্তু। তিনি প্লেটোর মতাে কোনাে আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেননি, শুধু চেয়েছিলেন ধর্ম-বর্ণ। নির্বিশেষে সব মানুষকে নিয়ে এমন একটি বিশ্বসমাজ গড়ে তুলতে যেখানে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম অধিকার ও আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটবে, সব মানুষ খেয়েপরে সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবে। এটিই ছিল গােবিন্দচন্দ্র দেবের স্বপ্ন ও সাধনা, তাঁর জীবনদর্শনের মূল লক্ষ্য ও উপজীব্য। এ লক্ষ্যেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে শহীদ হওয়ার আগেই তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির অর্ধেক। উইল করে দেন এক হিন্দু দত্তক ছেলে ও এক মুসলিম দত্তক মেয়েকে। বাকি অর্ধেক দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। তার সেই দানপত্রে উল্লেখ করা ইচ্ছা অনুসারেই মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্যে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রতিষ্ঠা হয় গােবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র’ (Dev centre for philosophical Studies)।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা