You dont have javascript enabled! Please enable it!
গিয়াসউদ্দিন আহমদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯ মার্চ ১৯৩৬ সালে, বাবার কর্মস্থল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে। যদিও তাদের পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার আমদিয়া ইউনিয়নের বেলাব গ্রামে। তার বাবা আবদুল গফুর ছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মায়ের নাম শামসুন্নাহার বেগম। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই ও পাঁচ বােন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। তাঁর ডাকনাম ছিল বাচ্চু। গিয়াসউদ্দিন আহমদের বাবা আবদুল গফুর যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে এম. এ. ক্লাসে পড়তেন, তখন বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তকুমার মহলানবীশ তার সহপাঠী ছিলেন এবং তাঁর এক ক্লাস নিচেই পড়তেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা। গিয়াসউদ্দিন আহমদের মা শামসুন্নাহার বেগম কিশােরগঞ্জ জেলার কালিকাপ্রসাদের বিখ্যাত জমিদার বংশের মেয়ে ছিলেন। ছােট থেকেই বাচ্চু ছিলেন সবার আদরের। তার স্নিগ্ধ চেহারার দিকে তাকালে চোখ ফেরানােই কঠিন হতাে। স্বভাব-চরিত্রে অত্যন্ত ধীরস্থির, উচ্চকণ্ঠ কিন্তু মধুরভাষী বাচ্চুর লেখাপড়ায় ছিল গভীর আগ্রহ। বাচ্চু ১৯৪২ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন।
ক্লাসের সেরা ছেলে, সেরা বক্তা ও সেরা আবৃত্তিকার ছিলেন গিয়াসউদ্দিন। বাবার সরকারি চাকরি থেকে অবসর ও সপরিবারে গ্রামে আসার ফলে ১৯৪৩-৪৪, এই দুই বছর গ্রামের বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে। পড়াশােনা করেন তিনি। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে চাকরিতে পুনরায় নিয়ােগ পেয়ে তার বাবা ঢাকায় আসেন।  ১৯৪৫ সালে গিয়াসউদ্দিনও আবার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে তিনি ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কসহ মেধা তালিকায় দশম স্থান পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫২ সালে নটরডেম কলেজ (যা তখন ‘সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ ছিল) থেকে গণিতে লেটার মার্কসহ মেধাতালিকায় অষ্টম স্থান পেয়ে আই. এ. পাস করেন।  নটরডেম কলেজের ছাত্র থাকাকালে কলেজের তকালীন ইতিহাসের শিক্ষক ফাদার গিলেসবি, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের শিক্ষক ফাদার গাঙ্গুলি ইত্যাদি খ্যাতিমান দিকপালের কাছে গিয়াসউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। এঁদের কারণেই কলেজ জীবন থেকেই ইতিহাস হয়ে ওঠে তার প্রিয় বিষয়। আর এ আগ্রহের কারণেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সে বছরই তার বাবা আবার চলে যান গ্রামের বাড়িতে। গিয়াসউদ্দিন তখন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনি ১৯৫৫ সালে বি, এ. (অনার্স) পাস করেন। পরের বছর অসুস্থতার জন্যে তিনি এম. এ. পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
পরের বছর ১৯৫৭ সালে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। বি. এ. ও এম. এ. দুই পরীক্ষাতেই তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। খেলাধুলা অসম্ভব ভালোবাসতেন গিয়াসউদ্দিন। দাবা খেলায় তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তাঁর বাস্কেটবল খেলার নৈপুণ্যে সলিমুল্লাহ হল অথবা ইতিহাস বিভাগ জয়ী হতাে অধিকাংশ সময়। টেনিস খেলায়ও পারদর্শী। ছিলেন, কিন্তু ছােটবেলায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়া, কলেজে পড়ার সময় হার্নিয়া অপারেশন এবং এর বছরখানেক পরেই নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল ছিলেন তিনি। তাই স্বাস্থ্যগত কারণে এক পর্যায়ে তাঁকে বাস্কেটবল, টেনিস খেলা ছেড়ে দিতে হয়। খেলাধুলার পাশাপাশি গানেরও, বিশেষ করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একজন ভক্ত ছিলেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে গিয়াসউদ্দিন জগন্নাথ কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক হিসাবে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর প্রায় এক বছর পর ১৯৫৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে খণ্ডকালীন প্রভাষক পদে যােগ দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন প্রভাষক পদে যােগ দেন।
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন ১৯৬৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে পড়তে যান এবং ১৯৬৭ সালে অর্থনীতিতে বি, এসসি, (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। সকল সময়েই শিক্ষার্থীদের নিকট পিএইচ. ডি. অধিক সমাদৃত। কিন্তু পরিশীলিত ও মননশীল জ্ঞানপিপাসু গিয়াসউদ্দিন কেবলমাত্র জ্ঞানের গভীরতা অর্জনের জন্য একটি সিনিয়র অনার্স কোর্সে ডিগ্রি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি। পরবর্তীতে ইউরােপের অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপর পিএইচ. ডি. করার ইচ্ছা থাকলেও তিনি দেশে ফিরে আসেন। কারণ তিনি চাননি অতিরিক্ত সময় বিদেশে অবস্থানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তার চুক্তি ভঙ্গ হােক। ১৯৬৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি পুনরায় ইতিহাস বিভাগে যােগ দেন। পিএইচ, ডি, না করার কারণে ভবিষ্যতে তার পদোন্নতির সমস্যা হলেও অন্য সহকর্মীদের পেশাগত উন্নতিতে তিনি মনক্ষুন্ন হননি। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে উন্নীত হন। আধুনিক বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল।
কেবল চলন-বলন-বেশভূষায় নয়, প্রকৃত অর্থে শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন আহমদ তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করে গিয়েছেন জ্ঞান অর্জন, শিক্ষার্থীদের কল্যাণ এবং সর্বোপরি দেশের জন্যে। ১৯৫৮ সালে তিনি এশিয়াটিক সােসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন এবং ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সােসাইটির কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সেক্রেটারি থাকা অবস্থায় তিনি ধ্বংসপ্রায় ক্লাবটিকে পূর্বের মর্যাদায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ১৯৬২ সালে তিনি সলিমুল্লাহ হলের। আবাসিক শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফেরার পর তাঁকে মহসীন হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। শিক্ষক হিসাবে এবং সলিমুল্লাহ ও মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি ছাত্রদের যথার্থ অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন থাকলেও তৎকালীন শিক্ষকদের কোনাে বিশেষ। রাজনৈতিক দল সমর্থন করা ছিল আইনানুযায়ী নিষিদ্ধ। তাই গিয়াসউদ্দিন নিজেও কোনাে রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেননি। তবে প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী গিয়াসউদ্দিন আহমদ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করতেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় রেডিও পাকিস্তান ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। যে সকল বুদ্ধিজীবী রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও সাহিত্য সম্প্রচারে দাবি জানায়, তাদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিনও ছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্রতিবাদী ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকা রেডিও থেকে দুপুর ১২টায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি ঘােষণা প্রচার করা হয় । রাজনৈতিক দলগুলাের সাথে পরামর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ নাটকীয়ভাবে এই ঘােষণায় জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘােষণা করেন। একজন ছাত্র ক্লাসে এসে এই খবরটি জানায়। খবর শুনে গিয়াসউদ্দিন একটু থমকে যান। তারপর “এরপর আমার পক্ষে আর ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি ক্লাস ছেড়ে চলে যান। আর ২৫ মার্চের রাতের গণহত্যার পর গিয়াসউদ্দিন বলেছিন, “পাকিস্তানের মৃত্যু হলাে, স্বাধীন বাংলা এখন একটি সময়ের প্রশ্ন মাত্র।”
২৫ মার্চ রাতের পর শহীদ শিক্ষকদের পরিবারের সদস্যদের জন্যে আসে চরম দুর্ভোগ। তখন গিয়াসউদ্দিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিবেকবান শিক্ষক তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। অর্থ সংগ্রহ, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সংবাদ, খাদ্য, বস্ত্র এবং ওষুধ সরবরাহের মাধ্যমে তারা সাহায্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন বেগম সুফিয়া কামাল :
অন্ধকার রাত । হঠাৎ বাড়ির পেছন থেকে চাপা স্বরে ডাক এলাে, ‘আপা”, গিয়ে। দেখি মাথায় চালের বস্তা, পরনে লুঙ্গি, গেঞ্জি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে এক লােক। ঠাহর করে দেখি আমাদের গিয়াসউদ্দিন, পাশের বাড়ির দেয়াল টপকে খাদ্যের যােগান এনেছে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য।
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের নির্ভীক চেতনা ও প্রতিবাদী বাচনভঙ্গির উদাহরণ হিসাবে একটি ঘটনার বর্ণনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানি বিমান বাংলাদেশে আক্রমণের সময় ব্রিটিশ শাসনাধীন একটি দেশকে তেল নেওয়ার জন্যে ব্যবহার করছে, এরকম একটি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কাছে যখন প্রতিবাদ জানাতে যান, তখন সে দলে গিয়াসউদ্দিনও ছিলেন। এ সময়ে গিয়াসউদ্দিনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে তার সহপাঠী ও সহকর্মী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন : একাত্তরে মার্চে ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছে প্রতিবাদ করতে গেছেন শিক্ষকরা। পাকিস্তানি উড়ােজাহাজ বাংলাদেশে আসার পথে তেল নিচ্ছে ইংরেজদের। আয়ত্তাধীন একটা দ্বীপ থেকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তরুণ ইংরেজ কর্মচারী বললেন, “না তেল দেওয়া হচ্ছে না।” আরও বললেন, “আমরা পাকিস্তানের ইন্টারন্যাল ম্যাটারে নাক গলাতে যাবাে না কিছুতেই।” কিন্তু গিয়াসউদ্দিন বললেন, “পাকিস্তান যদি বলে তােমরা তেল সরবরাহ করতে সম্মত না হয়ে। পাকিস্তানের ইন্টারন্যাল ম্যাটারে হস্তক্ষেপ করছ, তবে?” এ কথা শুনে অফিসারটি হকচকিয়ে গিয়েছিল। … আমরা ভীত থাকতাম, সর্বদাই ভয় পেতাম, গিয়াসউদ্দিন ভয় পেত না। সে নির্ভয় ছিল। গিয়াসউদ্দিন আহমদের ছােট ভাই এবং সে সময়ে দেশের একমাত্র এফ, আর, সি, এস, নিউরােসার্জন রশিদউদ্দিনকে প্রায়ই জোর করে নিয়ে যাওয়া হতাে ঢাকা সি, এম, এইচ.-এ যুদ্ধাহত ও মাথায় আঘাত পাওয়া পাকিস্তানি সেনাদের চিকিৎসার জন্যে। রশিদউদ্দিন অত্যন্ত গােপনে, গিয়াসউদ্দিনের সহযােগিতায় আহত মুক্তিযােদ্ধাদেরও চিকিৎসা করতেন।
সেপ্টেম্বর মাসে আলতাফ মাহমুদ ও কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হন। এদের মধ্যে ডা. রশিদউদ্দিনের চিকিৎসাধীন মুক্তিযােদ্ধাও ছিলেন। এ ঘটনার পর ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ডা. রশিদউদ্দিন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি গিয়াসউদ্দিনই তাকে ডেমরা ঘাটে দিয়ে আসেন। ভাই-বােনরা তখন তাকেও ভারতে চলে যেতে বার বার অনুরােধ করেন। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাওয়ার মানুষ নন গিয়াসউদ্দিন। দেশে তখন অনেক কাজ তার। প্রতিদিন সন্ধ্যায় খাকি প্যান্ট-শার্ট পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন গিয়াসউদ্দিন। ছয় ফুটের মতাে লম্বা, গৌরবর্ণের এই মানুষটিকে হঠাৎ দেখলে বিদেশি মনে করে ভুল হতাে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি খবর নিতেন কার ঘরে। খাবার নেই, কার জামা-কাপড় নেই, কার শীতের গরম কাপড়ের প্রয়ােজন, কে অসুস্থ ইত্যাদি। শুধু খোঁজ নিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। এর-ওর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন। তারপর সেসব দিয়ে তার সহকর্মীদের, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে দিতে চেষ্টা করতেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জীবন চালানাের জন্য ন্যূনতম খরচের টাকা জোগাড় করতেন। এসব তৎপরতার কারণেই হয়ত তিনি চোখে পড়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদার অথবা তাদের অনুগত দালালদের।
নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখ, বেলা আড়াইটার দিকে হঠাৎ করেই পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী ঢুকে পড়ে মহসীন হলে। ধরে নিয়ে যায় হলের দারােয়ান, সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং মহসীন হলের তকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. ওয়াদুদুর রহমান, হাউস টিউটর জহুরুল হক ও গিয়াসউদ্দিন আহমদকে। তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রমনা থানায়। বন্দিদের বার বার প্রশ্ন করা হতে থাকে আর। সাথে চলতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। গিয়াসউদ্দিনের বিপক্ষে কোনাে প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে তখন ছেড়ে দেয় পাকসেনারা। পরের দিন আবার তাদের যেতে হয় রমনা থানায়। পরের দিনও জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের। এ ঘটনার পর আরও বেপরােয়া হয়ে ওঠেন তিনি। অনেক বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী গিয়াসউদ্দিনকে উপদেশ দেন যে তিনি যেন নিজের বাড়িতে না থাকেন। গিয়াসউদ্দিন বলেন, “আমি তাে কারও শত্রুতা করিনি, আমার আবার কী হবে?” এ সময় তার প্রিয় শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ও তার পরিবারকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেবার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন।
১৪ ডিসেম্বর হলের পানির পাম্প নষ্ট হয়ে যায়। একটানা কারফিউয়ের কারণে মিস্ত্রি আসতে পারছিল না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন নিজে গিয়েছিলেন হলের পানির পাম্প ঠিক করতে। এ সময়ই ক্যাম্পাসে একটি মাইক্রোবাস ঢােকে। আলবদর বাহিনীর তিন-চার জন ইউনিফর্ম পরা সদস্য একে একে ঢুকে যায় শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টারগুলােতে। গিয়াসউদ্দিনকে বাসায় না পেয়ে তারা তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। পরে মহসীন হলের পানির পাম্পের সামনে থেকে চোখে গামছা বেঁধে তাকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। সে সময় তার পরনে ছিল একটি চেক লুঙ্গি ও গায়ে স্লিপিং স্যুটের শার্ট। অথচ এদিন ছােট ভাইবােনদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, শেলফে বইয়ের ভেতর বাংলাদেশের পতাকা আছে। কীভাবে আনন্দ করবি ঠিক কর।” স্বাধীনতার আনন্দ দেখে যেতে পারলেন না তিনি নিজে। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি আবিষ্কৃত হয় শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমি। মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের এই বধ্যভূমিতে ৪ জানুয়ারি কাপড়-চোপড় দেখে শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের গলিত লাশ শনাক্ত করা হয়। গিয়াসউদ্দিন আহমদ অবিবাহিত ছিলেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!