কসিরউদ্দিন তালুকদার
কসিরউদ্দিন তালুকদার ১৮৯৯ সালের ১৭ জুলাই বগুড়া জেলার দুপচাপিয়া থানার মহিষমুণ্ডা গ্রামে জন্ম নেন। তার বাবা নকিবউল্লাহ তালুকদার ছিলেন একজন জমিদার। তাঁর মায়ের নাম ফিরমন নেছা। বাবা নকিবউল্লাহ তাকে আদর করে ‘কসির মিয়া’ বলে ডাকতেন। কসিরউদ্দিন তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন স্থানীয় সােনামুখী হাই স্কুলে। তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে দুটি বিষয়ে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আই, এসসি, পাস করেন। তিনি ১৯২৯ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. বি. এস. ডিগ্রি লাভ করেন। কসিরউদ্দিন তালুকদার ১৯৩০ সালে বগুড়া শহরে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। তিনি বগুড়ার থানা রােডে ‘দি ইউনাইটেড মেডিক্যাল স্টোর’ নামে একটি ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফার্মেসি সংলগ্ন চেম্বারেই তিনি রােগী দেখতেন। কসিরউদ্দিন তালুকদার অচিরেই এলাকার একজন সফল চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃতি পান। গরিব মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা এবং বিনামূল্যে ওষুধ দিতেন বলে তিনি ‘হামার গরিবের ডাক্তার হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন কসিরউদ্দিন। তিনি ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বগুড়ায় লােকাল বাের্ডের সদস্য এবং ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ওই লােকাল বাের্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। লােকাল বাের্ড ও ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পর ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি বগুড়া ও পাবনা জেলার প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদের (বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল) সদস্য বা এম, এল, সি, ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বগুড়া জেলা বাের্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কসিরউদ্দিন ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার ব্যবস্থাপক সভার (বেঙ্গল অ্যাসেম্বলি) সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি এবং জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ডক্টরস অ্যাসােসিয়েশন বগুড়া জেলার সভাপতি ছিলেন। মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও কসিরউদ্দিন ছিলেন বেশ উদার মনের মানুষ। উত্তরবঙ্গের অক্সফোর্ড খ্যাত বগুড়া আজিজুল হক কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ওই কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সৌখিন গায়ক ও আবৃত্তিকার ছিলেন। কসিরউদ্দিন, একসময় মঞ্চনাটকেও অভিনয় করতেন। বগুড়া শহরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তিনি ছিলেন এক উদার পৃষ্ঠপােষক। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বগুড়ায় থাকাকালে তার বাড়িতে অনেকবার অতিথি হয়েছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও তার বগুড়ার বাড়িতে এসেছিলেন। নিজের ছেলেমেয়েদের তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালন করেছিলেন। প্রকৌশলী বা স্থপতির কোনাে পাঠ না নিয়েই বগুড়া শহরের বাদুড়তলায় সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পিত নকশায় ও তত্ত্বাবধানে ১৯৪১ সালে নির্মাণ করেন ‘হােয়াইট হাউজ’ নামের বাড়ি, যা এখনও স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন হিসাবে ধরা হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বগুড়ায় অসহযােগ আন্দোলন সংগঠনে কসিরউদ্দিন তালুকদারের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। অসহযােগ আন্দোলনের সময় তার নেতৃত্বে এক বিশাল মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে শহরের সাত মাথায় এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয় যাতে তিনি সভাপতিত্ব করেন। সভায় তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “এ দেশকে স্বাধীন করতেই হবে।” এরপর বগুড়া আলতাফুন্নেসা খেলার মাঠে এক সর্বদলীয় জনসভা হয়। লােকে লােকারণ্য খেলার মাঠ। শেষ বক্তা ছিলেন কসিরউদ্দিন তালুকদার।
সেই বক্তৃতাতেও তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। ( ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে যারা আহত হন, তাদের চিকিত্সা এবং যুদ্ধ শুরু হলে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসায় তিনি আত্মনিয়ােগ করেন। একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল রংপুর থেকে বগুড়া শহরের উত্তর প্রান্তে আসে। জনগণের প্রতিরােধের মুখে কয়েকদিন পর তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বগুড়া শহর ছিল মুক্ত। এরপর পাকিস্তানিরা বগুড়া দখল করে। কসিরউদ্দিন তালুকদার তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ৬ এপ্রিল গােপনে বগুড়া শহর ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি মহিষমুণ্ডা চলে যান।
২২ এপ্রিল থেকে বগুড়া শহরে পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নৃশংসতা বেড়ে যায়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বাদুড়তলায় কসিরউদ্দিন তালুকদারের বাড়ি ‘হােয়াইট হাউজ’ এবং থানা রােডে তার ডিসপেন্সারিতে আগুন ধরিয়ে দেয়, আসবাবপত্র তছনছ করে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। মে মাসের ৩ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে কসিরউদ্দিন তালুকদার বগুড়া শহরের নিকটবর্তী ঘােড়াগরি গ্রামে আত্মগােপন করে ছিলেন। এখানে তিনি শহর থেকে নিয়ে আসা আহত মানুষদের চিকিৎসা করেছেন। মে মাসের ২১ তারিখে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। শহরের বাড়িতে ফিরে আসেন।
মে মাসের ২৯ তারিখে সকালবেলা দুজন পাকিস্তানি সেনা তার বাড়িতে আসে। তারা তাকে জানায় যে, কোনাে এক তদন্তের ব্যাপারে তাকে থানায় যেতে হবে। তিনি তাদের সঙ্গে থানায় যান। সকাল ১০টার দিকে একটি জিপ গাড়িতে করে তাকে বাসায় নিয়ে এসে তার বাড়িতে তল্লাশি চালানাে হয়। এরপর পুনরায় তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহরের দক্ষিণে মাঝিড়া ক্যান্টনমেন্টের শেষ সীমানায় একটি কাঁচা মসজিদের পাশে আরও ১১ জনের সঙ্গে তাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে স্থানীয় লােকজন এসে কসিরউদ্দিন তালুকদারের শেরওয়ানীর টুকরা ও টুপি দেখে চিনতে পারে এবং সেখানেই তাকে আলাদা করে কবর দেয়।
তাঁর বড় মেয়ে গীতিকার জেব-উন-নেসা জামালের রচনা থেকে জানা যায় :… ২১ মে তিনি বগুড়ায় ফিরে যাচ্ছেন শুনে গ্রামবাসীরা যখন মিনতি জানাল : ডাক্তার সাহেব, আপনি বগুড়ায় যাবেন না, পাকসেনারা আপনাকে মেরে ফেলবে। … আব্বা বিচলিত হলেন না, ভয় পেলেন না। তার মতাে নিরপরাধ বৃদ্ধকে ওরা মারবে না- এই বিশ্বাস বুকে করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে গরুর গাড়িতে বগুড়া রওনা হয়ে গেলেন। এর পরের ঘটনা এই। বগুড়ায় পৌছাবার আট দিন। যেতে না যেতেই জিজ্ঞাসাবাদের এক প্রহসনের পর আধা ঘণ্টার মধ্যেই হানাদার বাহিনীর লােকেরা বগুড়ার ৮ মাইল দক্ষিণে মাঝিড়ার এক বধ্যভূমিতে একটি পুরােনাে কবরের মধ্যে ফেলে তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। স্থানীয় লােকেরা তাদের অতি পরিচিত ডাক্তার সাহেবকে চিনে ঐ পুরােনাে কবরেই তাকে সমাহিত করলেন। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) কসিরউদ্দিন তালুকদারের মেয়ের জামাই মাসুদ আলম সিদ্দিকী থানায় খোজ নিয়ে জানতে পারেন, মুসলিম লীগের ডা. মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেদিন ডা. কসিরউদ্দিন তালুকদারকে তুলে আনা হয়েছিল। ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালের জনসভায় বিলি করা একটি হ্যান্ডনােট দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, হ্যান্ডনােটের কারেকশনটি উনি করেছেন কিনা? উনি বলেন, “হ্যা, কারেকশন আমার করা।” এরপরই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ছাত্রজীবনেই ১৯২৩ সালে রাজশাহীর সৈয়দ মীর মেহের আলীর মেয়ে সৈয়দা জেয়াউন্নাহার খাতুনের সাথে তার বিয়ে হয়। তার স্ত্রী ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত বগুড়া মিউনিসিপ্যালিটির একমাত্র নারী কমিশনার ছিলেন। কসিরউদ্দিন তালুকদারের সাত ছেলেমেয়ে ছিল। প্রথম সন্তান জেব-উন-নেসা জামাল লেখক ও গীতিকার ছিলেন। সবার ছােট মেয়ে আঞ্জুমানআরা-বেগম বাংলাদেশের স্বনামধন্য গায়িকা। আরেক মেয়ে মাহবুব আরা ছিলেন। রেডিও-টেলিভিশনের শিল্পী। বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ তার অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কসিরউদ্দিন তালুকদারের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এছাড়া কসিরউদ্দিন তালুকদারের নামে বগুড়া থানা রােডে। ডিসপেন্সারি সংলগ্ন রাস্তার নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল একবার। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা