You dont have javascript enabled! Please enable it! এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান - সংগ্রামের নোটবুক
এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান
শিক্ষাবিদ আবু নাসের মােহাম্মদ মুনীরউজ্জামানের জন্ম যশাের জেলার কাচেরকোল গ্রামে ১৯২৪ সালে। যদিও তাদের পৈতৃক বসত মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার তারাউজিয়াল গ্রামে। তার বাবা মৌলভী মােহাম্মদ মুসা ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (কয়েকটি সূত্রে তাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে)। তার মা শামসুন্নেছা খাতুন ছিলেন ঝিনাইদহ জেলার বিখ্যাত কাঁচেরকোল জমিদার বাড়ির মেয়ে।  মুনীরউজ্জামান ১৯৩৪ সালে বেণীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি নড়াইল হাই স্কুল থেকে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। মুনীরউজ্জামান ১৯৪২ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আই, এসসি. পাস করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ‘অল ইন্ডিয়া এডুকেশন বাের্ড তার প্রশংসাপত্রে ‘এক্সিলেন্ট শব্দটি উল্লেখ করে। এরপর ১৯৪৪ সালে তিনি বি, এসসি, অনার্স (গণিত) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে এম, এসসি, (পরিসংখ্যান) ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। ১৯৪৮ সালে প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতি বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পরবর্তীতে পরিসংখ্যান ও সংখ্যাতথ্য বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি মিশ্রণে গবেষণার কাজ আরম্ভ করেন। তিনি এ সময় কলকাতা পরিসংখ্যান ও সংখ্যাতথ্য বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এই ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আজও তাকে স্মরণ করা হয়। এরপর তিনি ভারত সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি মুনীরউজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান ক্যাডার সার্ভিসের (পিএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাকে শিক্ষা থেকে সরিয়ে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বিভাগে বদলি করে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে চাননি বলে সেই চাকরিতে যােগ দেননি। পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানাের জন্য তিনি ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ সাল। পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে তখন দুটি বিভাগ একসাথে ছিলপরিসংখ্যান ও সংখ্যাতথ্য এবং কৃষি। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান দুটিকে আলাদা। মন্ত্রণালয়ে ভাগ করার প্রস্তাব দেন। ১৯৫২ সালে তিনি বাণিজ্য বিভাগে অতিরিক্ত শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন। এরই মধ্যে ১৯৫০ সালে ড. কাজী মােতাহার হােসেনের সার্বিক সহযােগিতায় এবং যৌথ উদ্যোগে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। মুনীরউজ্জামানের একান্ত প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে পরিসংখ্যান, সংখ্যাতথ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও ইনস্টিটিউট’ (আই. এস. আর. টি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পরিসংখ্যান বিভাগ ও ইনস্টিটিউট ছিল তার প্রাণ। বর্তমানে এই ইনস্টিটিউটের নাম রাখা হয়েছে ‘পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ । মুনীরউজ্জামানের প্রস্তাবে এবং সার্বিক সহযােগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যুরাে অব ইকনােমিক্স’।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানকে ব্যুরাে অব ইকনােমিকসের আজীবন সদস্য নির্বাচিত করে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরাে’।  ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে তিনি পরিসংখ্যান বিভাগে রিডার পদে যােগ দেন। মুনীরউজ্জামান ১৯৬৭-১৯৭১ পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে বিজ্ঞান অনুষদকে দ্বিতীয় দফায় ঢেলে সাজানাের কাজে হাত দেন। কিন্তু সে কাজ তিনি শেষ করতে পারেননি। তার স্বপ্ন ছিল পরিসংখ্যান বিভাগ ও পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে গােটা দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, পরিকল্পনা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে আন্তর্জাতিক বিশ্বের গণযােগাযােগের কাজ আধুনিক পদ্ধতিতে দ্রুততার সাথে পরিচালনা করা।
অসম্ভব সৃজনী ও উদ্যমী শক্তির অধিকারী ছিলেন মুনীরউজ্জামান। তাঁর গবেষণা মূলত পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, গণিত ও বাণিজ্য নিয়ে। পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণার জন্য ভারত সরকার তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। তাছাড়া পদার্থবিদ্যার উপর তাঁর বহু গবেষণা রয়েছে। তিনি সার্থকতার সাথে ইলেক্ট্রো এটম নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা চালিয়েছেন। উচ্চতর গণিতের ‘লগ’-এর একটি বড় অংশের আবিষ্কারক হিসাবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘লগ পাইওনিয়ার’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তার বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল অক্সফোর্ড-কেমব্রিজসহ ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ৩২টি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহ করেছিলেন। এইসব গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৭০ সালে আন্তর্জাতিক নােবেল কমিটি মুনীরউজ্জামানকে নােবেল প্রতিযােগিতার চূড়ান্ত পর্বের জন্য মনােনীত করে। তাকে গবেষণার পূর্ণাঙ্গ নথি ও পাণ্ডুলিপি জমা দিতে সুপারিশ করে। ১৪ আগস্ট ১৯৭১ ছিল তাঁর গবেষণার পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি জমা দেবার তারিখ। কিন্তু তিনি আর সেসব জমা দিতে পারেননি।
অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান ছিলেন নিষ্ঠাবান ধার্মিক, একই সাথে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মানবিক একজন মানুষ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। এজন্যে তার নামে পাকিস্তান সরকার হুলিয়া জারি করেছিল এবং পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থা তার বাসায় হামলা চালিয়েছিল। মুনীরউজ্জামান। অনেক এতিম ছেলেমেয়েকে লালন-পালন করেছেন। অনেককে লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি দিয়েছেন, অনেক মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ডের অধীনে সপ্তম শ্রেণির বীজগণিত বইয়ের লেখক ও সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান।
তিনি ছিলেন সৌম্য ও শান্ত স্বভাবের। সাদা শার্ট ও সাদা প্যান্টের সাথে কালাে টাই ব্যবহার করতেন। প্রতিদিন একই ধরনের পােশাকেই তাঁকে দেখা যেত। তাঁর একজন ছাত্র ও পরে তার সহকর্মী ড. নূরুল ইসলাম জানিয়েছেন, মুনীরউজ্জামান। অদ্ভুতভাবে পরীক্ষা নিতেন। পরীক্ষার আগে ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বলতেন, তােমাদের পরীক্ষার প্রশ্ন তােমরাই করবে। ছাত্ররা নিজেদের মতাে করে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দিত। তিনি ওইসব প্রশ্নপত্র থেকে বেছে একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন। তিনি বলতেন, যে ভালাে প্রশ্ন করতে পারে, সে ভালাে উত্তর দিতে পারে। ক্লাসে তিনি যখন অঙ্ক করাতেন, তখন হঠাৎ করেই হয়তাে খেয়াল করলেন যে অঙ্কটি ভুল হয়েছে। তখন ছাত্রদের বলতেন, অঙ্কটা ভুল হয়েছে, কিন্তু তােমরা এটাও লিখে রাখ। তাহলে তােমরা বুঝতে পারবে কোথায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরিসংখ্যানে গভীর পাণ্ডিত্যের কারণে ছাত্রদের তিনি পড়াতে পারতেন সহজ ও বােধগম্য ভাষায়। গল্পের মতাে করেই তিনি অঙ্ক পড়াতেন।
অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের আরও তিনজন সদস্যের সাথে নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরুর পর মুনীরউজ্জামান প্রথমে জহুরুল হক হলের (সাবেক ইকবাল হল) উত্তরে একটা বাংলােতে থাকতেন। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার ৩৪ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় চলে আসেন। এই ভবনের নিচতলার বাসিন্দা ছিলেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ৪৮ নম্বর ভবনের সামনে এসে একটি হ্যান্ডমাইকে তিনজন শিক্ষকের নাম ঘােষণা করে এবং তাদেরকে বেরিয়ে আসতে বলে। এই তিনজন শিক্ষক হলেন পরিসংখ্যান বিভাগের এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, দর্শন। বিভাগের গােবিন্দচন্দ্র দেব। যদিও গােবিন্দচন্দ্র দেব তখন সেখানে থাকতেন না।
পরপর তিনবার এভাবে নাম ঘােষণা করার পর, পাকসেনারা একটু অপেক্ষা করে কেউ বেরিয়ে আসছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু যখন দেখল কেউ বেরিয়ে আসছে না, তখন পাকসেনাদের একটি দল সরাসরি উঠে যায় ওই ভবনের তৃতীয় তলায় অর্থাৎ ৩৪/ই নম্বরের ফ্ল্যাটে। পাকসেনারা লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলে। সেই শব্দে। মুনীরউজ্জামান এগিয়ে যান। পাকসেনাদলের প্রধান তার নাম জানতে চাইলে তিনি নিজের পরিচয় দেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধরে টানতে টানতে নিচের তলায় সিড়ি ঘরে। নিয়ে যাওয়া হয়। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান এ সময় তার ছােট ভাই নবাবকে ডাকেন। তার ডাক শুনে ছােট ভাই অ্যাডভােকেট শামসুজ্জামান নবাব ঘরের দরজা খুলতেই পাকসেনারা সে ঘরে ঢুকে নবাব, মুনীরউজ্জামানের বড় ছেলে এ, কে, এম, আকরামুজ্জামান, ভাগ্নে সৈয়দ নাসিরুল ওহাব মঞ্জুরকে ধরে নিয়ে যায় এবং একতলার সিঁড়ি ঘরে বন্দি করে। এখানেই তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়।  অধ্যাপক জামানের ছােট ছেলে আবু মুসা ম, মাসুদউজ্জামানের কথা থেকে জানা যায়, অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানকে পাকসেনারা মাটিতে বসতে বলে।
কিন্তু তিনি মাটিতে বসতে অস্বীকৃতি জানান। তখন পাকসেনারা তাঁর পায়ে বেয়নেট দিয়ে। আঘাত করে। এরপরই মুনীরউজ্জামানকে মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। তারপর একে একে গুলি করে শামসুজ্জামান, আকরামুজ্জামান এবং সৈয়দ নাসিরুল ওয়াহাবকে। বুকে গুলি লাগলে চারজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানসহ অন্য সবার মৃতদেহ জগন্নাথ হলের গেটের বাইরে গাছতলায় সারাদিন ফেলে রাখা হয়। পরদিন সন্ধ্যায় তার লাশ অধ্যাপক গােবিন্দচন্দ্র দেবসহ অন্যদের সাথে জগন্নাথ হলের মাঠে একটি গর্তে গণকবর দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের কবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। মুনীরউজ্জামানের স্ত্রীর নাম সৈয়দা মাহমুদা জামান। এই দম্পতির বড় ছেলে আকরামুজ্জামান (একাত্তরে শহীদ), একমাত্র মেয়ে লুলু নাসরিন, ছােট ছেলে আবু মুসা ম. মাসুদউজ্জামান (জাকারিয়া মাসুদ)।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা