You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২২শে জানুয়ারী, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ৮ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার

গত রোববার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্ত হয়েছে। কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবলীতে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহতকরণ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে মুজিববাদের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্যে দুর্জয় শপথ উচ্চারণ করা হয়।
প্রস্তাবে একশ্রেণীর মেকী বিপ্লবীদের সমাজতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দলের সকল কর্মী, সরকার এবং দেশবাসীকে সতর্ক করে দেয়া হয় এবং সুসংগঠিত গণপ্রতিরোধ সৃষ্টি করে অংকুরেই এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়ার জন্যে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশের সকল স্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি সংগঠন ও সংস্থাসমূহের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-পাকিস্তানের ভূমিকায় উদ্বেগ পাঠান বেলুচদের সংগ্রাম সমর্থন, চীন সরকারকে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভ্রান্তনীতি পরিহার করার জন্য আহ্বান, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা প্রসঙ্গ ও অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন, দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি রোধ ইত্যাদি বিষয় প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের রয়েছে দীর্ঘদিনের সংগ্রামী ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় প্রাথমিক সংগ্রামে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে এবারে দ্বিতীয় স্তরের সংগ্রামে জয়যুক্ত হবার জন্যে সকলকে আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে।
অবশ্য এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, আওয়ামী লীগ কথায় ও কাজে সমন্বয় সাধন করতে বদ্ধপরিকর। তারই প্রমান হলো সভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় বঙ্গবন্ধুর বিদায় গ্রহণ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমি আর সভাপতি থাকতে পারি না। আমার নিজের প্রণীত গঠনতন্ত্রের প্রতি আমি অবমাননা করতে পারি না। এই গঠনতন্ত্রের প্রতি অবমাননার অর্থ হবে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা। কারণ আওয়ামী লীগ জনগণেরই।’
বঙ্গবন্ধুর কথার সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও বলবো আওয়ামী লীগ জনগণের। সুতরাং দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের উপর অর্পিত। কাউন্সিল অধিবেশনে যে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে শপথ বাক্য উচ্চারিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে তখনই যখন আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মী ও নেতা এগিয়ে আসবেন দেশের ও দশের খেদমত করার বাসনা নিয়ে। প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এক কথা নয়। প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও সাধনা।
আমরা আশা করবো, আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দ এদিকে লক্ষ্য রেখেই আগামী দিনগুলোতে এগিয়ে যাবেন।

জীবন রক্ষাকারী ঔষধ থেকেও নেই?

বেশ কিছুদিন ধরে জীবন রক্ষাকারী ঔষধের দুষ্প্রাপ্যতা সম্বন্ধে দেশের চলতি প্রায় সবগুলো পত্রিকাতেই সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়—ঔষধপত্রের অভাবে বহু অকাল মৃত্যুর খবরও আমরা পত্রিকান্তরের মাধ্যমেই জানতে পারছি।
সংবাদে প্রকাশ, জামালপুর শহর সহ পুরো মহকুমাতে জীবন রক্ষাকারী ঔষধের অভাবে জনগণ নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সেখানে অত্যাবশ্যকীয় ইনজেকশন, ট্যাবলেট, টনিক কিছুই পাওয়া যায় না। ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো ও এন্টাসিড ঔষধ সহ নিত্যব্যবহার্য নানাবিধ প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রের যোগান দিতে পারছে না। অথচ খোলা বাজারে অত্যন্ত চড়াদামে তা’ পাওয়া যায়।
এমনি খবর আসছে অন্যান্য অঞ্চল থেকেও। শ্রীমঙ্গল, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, মির্জাপুর, মুন্সীগঞ্জম ফরিদপুর, কাজিপুর, ভেড়ামারা, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা), বাসাইল, গোপালদী বাজার, মারিয়াকান্দি, পটুয়াখালী, নড়াইল ইত্যাদি সর্বত্রই ঔষধের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দিয়েছে এবং চিকিৎসা সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, জনজীবন আজ বহুমুখী বিপর্যয়ের মোকাবেলা করেই জীবন ধারণ করে আছে এবং কোনোমতে দিন কাটিয়ে যাচ্ছে। তার উপর যদি জীবনরক্ষাকারী ঔষধের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দেয়, তাহলে সাধারণ মানুষগুলো যে অধিকতর বিভ্রান্ত ও হতাশাজনিত বিক্রিয়ায় ভুগবে তাতে সন্দেহ নেই।
অথচ ঔষধ বাজারে নেই তা নয়। তাই তথাকথিত ন্যায্যমূল্যের দোকানে যে ঔষধ পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যাচ্ছে অন্যত্র। এবং স্বাভাবিকভাবেই বহুগুণ বাড়তি দাম দিয়ে তা ক্রেতাসাধারণকে কিনতেও হচ্ছে। ফলে ডাক্তারের ব্যবস্থামতো ঔষধ সরবরাহ করে রোগীর প্রাণ বাঁচানো অনেক ক্ষেত্রেই দুষ্কর হয়ে পড়েছে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক কৃত্রিম ও ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর এ পর্যন্ত দেশে প্রচুর ঔষধপত্র আমদানী করা হয়েছে। সেই সকল ঔষধপত্র প্রপীড়িত জনসাধারণ যেন অবাধে ও ন্যায্যমূল্যে পায় সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট মহল কাগজে কলমে সচেতনতার পরিচয় রেখেছিলেন। খোলা হয়েছিল বহু ন্যায্যমূল্যের দোকান। জীবন রক্ষাকারী যাবতীয় অত্যাবশ্যকীয় ঔষধপত্র সেখানে সরবরাহও করার কথা শোনা যায়। কিন্তু তারপরই দেখতে হয় ভেলকি। ন্যায্যমূল্যের শিকল কেটে ঊর্ধমূল্যের খোলা হাওয়ায় অতঃপর ঔষধগুলো গিয়ে হাজির হয়। আয়ের সীমিত টাকা দিয়ে সে ঔষধ কিনতে গিয়ে তখন ক্রেতাসাধারণ হিমশিম খায় এবং কতিপয় স্বার্থান্ধ কুচক্রীরা নধরকান্তি বাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
এমনকি হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয়গুলোতেও ঔষধের অভাব রয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। কোথায়ও বা অক্সিজেনের অভাবে জরুরী অস্ত্রোপচার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এর চেয়ে গুরুতর চিকিৎসা সংকট এবং অচলাবস্থা আর কি হতে পারে?
একদিকে ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের সৌজন্যে নানা দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাধির হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায়গুলো দূরে সরে যাচ্ছে। আর এজন্য কেউ না কেউ দায়ী তো বটেই। তাই প্রশ্ন রাখতে চাই জনজীবনের নিরাপত্তা ও সুস্থতার বিনিময়ে এইভাবে যারা মুনাফা লুটতে শুরু করেছে, তাদের রশি আর কতদিন ছেড়ে রাখা হবে?
কেন সরবরাহকৃত ওষুধ ন্যায্যমূল্যের দোকানে পাওয়া যায় না, কেন এই কৃত্রিম চিকিৎসা সংকট সৃষ্টি করে চিকিৎসাক্ষেত্রে অচলাবস্থার আমদানী করা হচ্ছে, কারা এজন্য দায়ী ইত্যাদি অনুসন্ধান করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট মহলকে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এখন আর শুধু কথায় কাজ হতে পারে না—এ কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত।

উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে

গত কয়েক মাস ধরেই একটি কথা শোনা যাচ্ছে। কথাটি পাটমন্ত্রী বলেছেন। এবারে চেয়ারম্যানও বলতে শুরু করেছেন। এরা দু’জনেই চটকলে বাড়তি শ্রমিকের জন্য সরকারকে যে লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে তাই বলেছেন।
বাংলাদেশ চটকল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান সম্প্রতি খুলনায় পাটমন্ত্রীর বক্তব্যের সুরে সুর মিলিয়েই বলেছেন যে, দেশের ৭৭টি চটকলে অন্যূন বাড়তি ২৫ হাজার শ্রমিক ও ৩ হাজার অফিসার কাজ করছেন। এদের বেতন বাবদ সরকারের বার্ষিক ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা লাগে। এর মধ্যে কেবল চটকলের বাড়তি শ্রমিকদের বেতনদানের জন্যেই ৬ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
স্পষ্টতঃই দেখা যাচ্ছে যে, সব দোষ নন্দ ঘোষের মতো বারে বারে বাড়তি শ্রমিক প্রসঙ্গটিই উত্থাপিত হচ্ছে। মন্ত্রী বা চেয়ারম্যানের কথার সত্যতাকে অস্বীকার না করেই এ প্রসঙ্গে আমরা দু’টো কথা বলতে চাই। চটকলে বাড়তি শ্রমিক আছে এটা ধরে নিয়েই যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, চটকলগুলোতে লাখ লাখ টাকা গচ্চা যাবার মূলে কি একমাত্র বাড়তি শ্রমিক, অন্য কোনো কারণ নেই?
ধরা যাক, যদি চটকলগুলোর শতকরা ৭৫ ভাগ অবাঙালী কর্মচারী চলে যাবার পর যে স্বল্পতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করা যেতো, অধিকাংশের স্বল্পতার জন্য চটকলগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত না হতো, যদি নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু থাকতো, যদি দুর্নীতিবাজ প্রশাসকদের উচ্ছেদ করা যেতো, যদি অযোগ্য অপদার্থ উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিদায় করা যেতো তাহলে কি হতো? তাহলে কি বাড়তি শ্রমিক প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হতো?
এই তো গত পরশু স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘আদমজী জুট মিলে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অযত্নে নষ্ট ও পাচার হচ্ছে।’ নিশ্চয়ই এই যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া বা পাচার হওয়ার পেছনে শ্রমিকরা নেই। থাকার কথাও নয়। একই সংবাদে আদমজী জুট মিলের শ্রমিকরাই তো বলেছেন যে, উপরোক্ত মেশিনপত্র সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের বেকারত্ব ঘুঁচে অধিক উৎপাদনের পথ প্রশস্ত হতো এবং অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতো। কিন্তু এদিকে নজর দেওয়ার মতো কেউ আছেন বলে শ্রমিকরা মনে করেন না।
এরপরও কি বলা যাবে যে, বাড়তি শ্রমিকদের জন্যে গচ্চা যাচ্ছে? তাই আমাদের বক্তব্য হলো, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে না চাপিয়ে আসল সমস্যা সমাধানের জন্যে পাট মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসা উচিত। আর সেটাই হবে সবচেয়ে সময়োচিত কাজ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!