সন্দ্বীপের মুজাফফর আহমদ
অমিতাভ গুপ্ত
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মিলিত হয়ে নিজ নাম বর্জন করে পদ্মা নাম নিয়েছে। এই পদ্মা আবার কত নদীকে নিজের মধ্যে মিলিয়ে বাংলাদেশের চাদপুরের কাছাকাছি প্রায় এক সমুদ্রে পরিণত হয়ে নাম নিয়েছে মেঘনা। মেঘনা গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল পর্যন্ত মেঘনা নদীর মোহনা বিস্তৃত। এই মোহনায় সাগরে ভাসমান একটি ছোট্ট দ্বীপের নাম সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপ বাদশাহী আমলের একটি পরগনা। প্রশাসনিক ব্যাপারে দ্বীপটি আগে নোয়াখালী জেলায় ছিল। বঙ্গ-বিভাগের কয়েক বছর তা চট্টগাম জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হাজার বছর আগেও যে এই দ্বীপে মানুষের বসতি ছিল ভোটালিকরা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।
বাংলাদেশের এই সন্দ্বীপেই মুসাপুর গ্রামে বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোনও এক সোমবার মুজাফফর আহমদ ভূমিষ্ঠ হন। খুব দরদ্র পরিবারে জন্মগহণ করায় তাঁর শৈশবে বা বাল্যকালে কখনও জন্মদিন পালিত হয়নি। তাই তাঁর জন্মের সঠিক তারিখ মুজাফফর সাহবের জানা ছিল না । ‘তার মায়ের মুখে তিনি যা শুনে ছিলেন সে অনুযায়ী তিনি বাংলা ২০১৬ সালের ২১শে শ্রাবণ বা ইংরাজি ১৮৮৯ সালের ৫ই আগস্ট তারিখে তার জন্মদিবস বলে ধরে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কম(অস্পষ্ট) মুজাফফর বৃদ্ধ বয়সেও বলে তিনি হয়তো কিঞ্চিৎ ভুল থেকে (অস্পষ্ট)। কিন্তু তাতে কি এসে যায়?
মুজাফফর আহমদের পিতার নাম মনসুর আলী আর মায়ের নাম চূনা বিবি। তা’র পিতামহের নাম মুহাম্মদ কায়েম আর মাতামহের নাম ইরশাদ আলী ঠাকুর। এই নামটি ইরশাদ আলী ছিল না, আরশাদ আলী ছিল তা নিয়ে বরাবরই মুজাফফর সাহেবের মনে কিছুটা খটকা ছিল। একই আরবী শব্দের উচ্চারণ-ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মানে হয়। মাতামহকে তিনি কোনও দিন চোখে দেখেননি। মুজাফফর সাহেবের জন্মের বহু বছর আগেই তিনি ইন্তেকাল করেছিলন। কমরেড মুজাফফর তার বাল্যস্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলতেন যে সন্দীপে, চট্টগ্রামে এবং সম্ভবত আরাকানেও মুসলমানদের মধ্যে ঠাকুর পদবীব চলন আছে। আলাওলের (আল আউয়াল ?) কাব্যে সৈয়দ মাগন ঠাকুরের নামোল্লেখ আছে। মুসলিমদের মধ্যে ঠাকুর পদবী সম্ভবত খানিকটা আভিজাত্যের চিহ্ন। তাই মুজাফফর সাহেবের নানা পরিবারে কিঞ্চিৎ আভিজাত্যের দাবী ছিল। তিনি বলতেন আমাদের সন্দীপের মতো ছোট জায়গায় কোন পরিবারের নামে একটি কিংবা দুটি তৌজি থাকলেই সে-পরিবার আভিজাত বলে গন্য হতেন।
১৮২৭ ধৃস্টাব্দে (১২৩৪ বঙ্গাব্দ) মুজাফফর আহমদের বাবা জন্মেছিলেন অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় মনসুর আলী সাহেব ত্রিশ বছর বয়সের পরিণত যুবক। সন্দীপে সে সময় কোন ইংরেজী স্কুল তো থাকতেই পারে না, বাংলা স্কুলও ছিল না। তাই মুজাফফর সাহেবের পিতা এর-তার কাছে বাংলা পড়েছিলেন আর কিছু প্রবাসী ভাষাও তিনি শিখেছিলেন। তবে বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দিয়ে তিনি মুক্তারী পাস করেছিলেন। সন্দীপের আদালতেই তিনি আইনের ব্যবসা করতেন। কমরেড মুজাফফর তার মা বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। তার জন্মের সময় পিতা মনসুর আলী সাহেব ৬২ বছরের বৃদ্ধ। কাজেই মুজাফফর সাহেবের শিশু-বয়সে তার বাবা বার্ধক্যের জন্য আদালতে যাওয়া একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন, যদি মনসুর তালী সাহেবের সম-ব্যবসায়ী অর্থাৎ আইনজীবি সহকর্মীরা প্রায় সকলই যথেষ্ট ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, তবুও কোন কারণে তিনি এ বিষয়ে সফল হতে পারেননি। ‘তাই মুজাফফর সাহেবের শৈশবে ও বাল্যে তাদের পরিবারের দায়িত্ব ছিল অবর্ণনীয় । তিনি নিজেই তার আত্মচরিতে লিখেছেন : স্কুলের সামান্য বেতন জোগানোর সামর্থও আমার বাবার ছিল না।’
সেকালে সন্দীপ অঞ্চলে মুসলিম শিশুদের প্রথম পাঠ শুরু হতো আরবীতে । আনুষ্ঠানিক ভাবে মুজাফফর সাহেবকে দিয়েও কুরআনের একটি বাক্য উচ্চারণ করিয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষার সুত্রপাত করা হয়েছিল। কিন্তু আরবী তার পরিচয় করিয়ে কেবলমাত্র স্বরচিহ্নের সাহায্যে শিশুদের কুরআন পড়ানোর যে রীতি ছিল মুজাফফর সাহেবের বেলায় তা পালিত হয়নি। কুরআনের বাক্যটি তাঁকে দিয়ে একবার মাত্র উচচারণ করানোর পরই তার বাবা মনসুর আলী সাহেব বাজার থেকে মদনমোহন তর্কালংকারের শিশু-শিক্ষার প্রথম ভাগ একখানা কিনে এনে নিজেই ছেলেকে অ আ ক খ পড়িয়ে ছিলেন। মুজাফফর সাহেব বন্ধ বয়সেও বেশ গর্বের সঙ্গে বলতেন আমার বাবা নিশ্চয়ই প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন—সেকালে’ও আমাদের মত গোড়া মুসলিম পরিবারে। তিনি শুরু থেকেই অ আ ক খ পড়িয়ে তিনি আমাকে বাংলা বর্ণ মালা শিখিয়েছিলেন।’ মুজাফফর সাহেব যখন সন্দীপ মধ্য ইংরাজি স্কুলে (১৯০২ সালে এই স্কুলের নাম সন্দীপ কার্গিল হাইস্কুল হয়েছে) বাংলা উচ্চ প্রাথমিক শ্রেণীতে পড়ছিলেন তখন তার পড়া ছেড়ে দিতে হয়। তিনি ছিলেন শিশু আর স্কুল ছিল তাদের মুসাপুর গ্রাম থেকে অনেক দূরে। এছাড়া, আগেই লিখেছি যে স্কুলের সামান্য বেতন দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্যও সে সময় তার বৃদ্ধ পিতার ছিল না। তাই শিশু মুজাফফর স্কুল ছেড়ে দেওয়ায় তাদের দারিদ্র পীড়িত পরিবারের কেউ তেমন কেন হায়-আফসোস করলেন(অস্পষ্ট)। বাড়ীতে বসেই তার দিন বৃথা কেটে যাচ্ছিল। সে সময় তাদের পরিবারে তেমন কোন চাষ হতো না যে তিনি তার কাজে লেগে থাকবেন।
সেকালে মুসলমান প্রধান সন্দীপে মোল্লা-মৌলবীর অভাব ছিল না—সম্ভবত এখনও নেই । গ্রামে গ্রামে ছিল পারসী-আরবী পড়ানোর ছোট ছোট মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় পড়ার খরচও ছিল খুব কম। বাড়ীতে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে মুজাফফর সাহেবের ভাল লাগছিল না। তাছাড়া তিনি বাল্যের সীমা ছাড়িয়ে কৈশোরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলেন। তাই তিনি অন্যান্যদের দেখাদেখি এক রকম প্রায় নিজেই মাদ্রাসায় পড়াশনা শক্ত করে দিলেন। ইরানের কবি সাআদীর গুলিস্তান ও বন্তান’ অনেকখানি পড়ে ফেললেন, পড়লেন কিছু আরবী ব্যাকরণ, আর সরে পড়া আরম্ভ করেছিলেন কবি জামীর কাব্য ইউসুফ ও জুলায়খা’। এটা ১৯০৫ সালের কথা। এ বছর ৭৮ বছর বয়সে অশক্ত দেহে তাঁর পিতা মনসুর আলী পরলোক গমন করলেন। এই বছরই অর্থাৎ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের জন্য দেশে প্রবল আন্দোলন। এ সময় (অস্পষ্ট) বছরের কিশোর মুজাফফর আহমদের প্রবল বাসনা হলো যে তার মাদ্রাসার পড়া ছেড়ে দিয়ে ইংরেজী স্কুলে পড়বেন। তাঁর তিন বড় ভাই ছিলেন। —মহব্বত আলী, মকবুল আহমদ ও খুরশীদ আলম। পেশায় ‘তারা ছিলেন যথাক্রমে উকিলের কেরানী, শিক্ষক ও জমিদারী এস্টেটের কর্মচারী। কলকাতা মাদ্রাসায় শিক্ষাগ্রত মকবুল আহমদ সাহেব খুলনা জেলার মোরেলগঞ্জ থানার এক গ্রামে শিক্ষকতা করতেন। তিনি মাঝে মাঝে ছোটভাই মুজাফফরকে সামান্য অর্থ সাহায্য করতেন । মুজাফফর সাহেব সন্দীপ থেকে মোরেলগঞ্জের গ্রামে মকবুল সাহেবকে চিঠি লিখে তার ইচ্ছার কথা জানালেন। কিন্তু বড় ভাইর কাছ থেকে তিনি কোন সাড়া বা উৎসাহ পেলেন না। এ সময় মুজাফফর আহমদ নোয়াখালী জেলার স্থলভাগে বামনীর আখতারিয়া মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। বড় ভাইদের থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে তিনি এক দিন অভিমান করেই হোক তা জেদ” করেই হোক নোয়াখালী থেকে বাকেরগঞ্জ জেলার উদ্দেশ্যে যাত্রা বলেন। বৃদ্ধ বয়সেও কমরেড মুজাফফরের বেশ মনে পড়তো যে পাতাব-হাট স্টীমার স্টেশনে মাত্র একটি পয়সা কম পড়ে যাওযা তিনি বরিশালের টিকিট কিনতে পারছিলেন না। তখন একজন হিন্দু আদালত – চাপরাশি দয়াপরবশ হয়ে তাকে একটি পয়সা দিয়েছিলেন । মুজাফফর সাহেব প্রথমে পিরোজপুর মহকুমার বামনা নামে গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পায়ে হেটে বাকেরগঞ্জ জেলার বহু জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়ালেন। বরগুনায় তিনি কয়েকদিন ছিলেন, শেষে পৌচেছিলেন আমতলী থানার অধীন বুড়িরচক নামে গ্রামে। এসব এলাকা ছিল নদীখাল-বিলে ভরা। স্থানীয় মানুষেরা ছোট-বড় নৌকায়, বেশীর ভাগ নিজেদের নৌকায় যাতায়াত করতেন। নদী পার হওয়ার দরকার হলে কোন পথিক মাঝিদের – ডেকে অনুরোধ করলেই তারা পয়সা না নিয়েই নদী পার করে দিতেন।
বুড়ীরচক গ্রামে এক মোটামোটি অবস্থাপন ব্যক্তির বাসায় থেকে মুজাফফর সাহেব ছোট বড় ছেলেদের অ আ ক খ পড়ানো শুরু করে দিলেন। আলিফ গাজী ও নীল গাজী দুই ভাইয়ের নামে লোকে বাড়িটিকে আলিফ-নীল গাজীর বাড়ী বলত। এরা ছিলেন সম্পূন কৃষক পরিবার।
কমরেড মুজাফফর আহমদ ‘তার আত্মকথায় লিখেছেন : বাকেরগঞ্জ জেলার নিরক্ষর গ্রামগুলিত নোয়াখালী জেলা হতে অশিক্ষিত লোকেরা এসে সেই সময় এইভাবে বিদ্যা ও অবিদ্যা দান করতেন। মুজাফফর সাহেবের পরিকল্পনা ছিল যে বাকেরগঞ্জে শিক্ষকতার কাজ করে কিছু, পয়সা রোজগার হলে ওই জেলারই কোন হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি আধুনিক ইংরাজী শিক্ষা গ্রহণ করবেন। বুড়ীরচক গ্রামে তিনি প্রায় অজ্ঞাতবাসেই ছিলেন। কিন্তু একদিন মুজাফফর সাহেবের আগ্রজ মৌলবী মকবুল আহমদ সাহেব নানাসূত্রে খোঁজ-খবর করে ওই গ্রামে এসে আলিফ-নীল গাজীর বাসায় উপস্থাপিত হলেন। তিনি ছোটভাইকে অনেক বুঝিয়-সুজিয়ে, বুড়ো মা কান্নাকাটি করছেন ইত্যাদি বলে মুজাফফরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। কথা দিলেন বাড়ী চল, সন্দীপের হাইস্কুলেই তোমাকে পড়তে দেব ।
১৯০৬ সালের মার্চ মাসে মুজাফফর সাহেব সন্দীপ কাগির্ল হাইস্কুলের নীচের দিকের কলাসে ভর্তি হলেন যদিও তখন তার বয়স সতের। কমরেড মুজাফফর তার আত্মচরিতে বেশ কৌতুককরে মন্তব্য করেছেন ঃ সৌভাগ্যের বিষয় এই হোল যে বাচ্চা ছেলেরা আমাকে তাদের ক্লাসে বসতে দিল এবং আমার মাথায় চাটি মেরে তাদের ক্লাস হতে বার করে দিল না। আমি বাংলা তাদের চেয়ে অনেক ভালো জানতাম বলে তারা নিজেদের মধ্যে আমাকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।’ বাংলা ভাষার প্রতি মুজাফফর সাহেবের অনুরাগ বালক বয়স থেকেই এত প্রবল ছিল যে তিনি নোয়াখালী জেলার মাদ্রাসায় পড়ার সময়ও কখনও বাংলার চর্চা ছেড়ে দেননি। বাংলা বই পেলেই তিনি পড়তেন, বাংলা দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক কাগজ পেলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত না পড়ে নিবত্ত হতেন না। কলকাতা থেকে প্রকাশিত নানা বাংলা মাসিক সাময়িকী পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ পড়েই মুজাফফর সাহেবের মনে ইংরাজি পড়ার ঝোঁক চেপেছিল। তিনি তখন বিশেষভাবে পড়তে চাইতেন মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস। ইংরাজি ভাষাতেই এই ইতিহাস অধ্যয়ণ করার সুবিধা ছিল বেশী। সন্দীপের এস এম আবদুল আহাদ সে সময় কলকাতায় কলেজে পড়াশুনা করতেন। বয়সে তিনি মুজাফফর সাহেব চেয়ে তিন-চার বছরের বড় ছিলেন। আহাদ সাহেবের ছিল গভীর পাঠ-পন্থা এবং কোন কোন বাংলা পত্রপত্রিকায় তিনি লিখতেনও। মুজাফফর আহমদ সন্দীপের হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর জনাব আবদুল আহাদ তাকে একদিন বললেন : ‘কমপক্ষে একটা ইংরেজী ভাষা তো শিখনু যাতে সৈয়দ আমীর আলীর এ শর্ট হিস্টরী অব সারাসেন্স এবং দি স্পিরিট অব ইসলাম পড়ে অনায়াসে বুঝতে পারেন। কমরেড মুজাফফর নিজেই তার আত্মকথায় বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে কলংকিত বলে আমি কিছুতেই পড়তে চাইতাম না।’ কিন্তু, আহাদ সাহেবই নাকি তাকে দিয়ে এই উপন্যাসগুলি পড়িয়ে ছেড়েছিলেন।
১৯১০ সালে মুজাফফর সাহেব সন্দীপ কার্গিল হাইস্কুল থেকে নোয়াখালী জেলা স্কুলে চলে যান। ইতিমধ্যে তার জীবনে একটি গুরত্বপর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সেই যে তিনি বরিশালে অজ্ঞাতবাসে চলে গিয়েছিলেন ‘তার শাস্তি স্বরপ ১৯০৭ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর তখন তার মুরব্বিরা বিয়ে দিয়ে দেন, যদিও কমরেড মুজাফফর নিজেই লিখেছেনঃ ‘কিন্তু বিয়ে আমায় কোন দিন ঘর-সংসারের আওতায় বাঁধতে পারেনি।’ (কয়েক বছর আগে পাকিস্তান আমলে মুজাফফর সাহেবের পত্নী বেগম হাফেজ আহমদ সন্দীপই ইন্তেকাল করেছেন।
১৯১৩ সালে ২৪ বছর বয়সে মুজাফফর আহমদ নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাটিকলেশন পরীক্ষা পাস করলেন। কমরেড মুজাফফর নোয়াখালী জেলা স্কুলে তার সহপাঠীদের সম্পর্কে মতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন যে তাদের ক্লাসে সর্বশেষ্ঠ ছাত্র ছিলেন অবিনাশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি পরে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য গ্রেফতার হয়ে ডেটিনিউ বা রাজবন্দী হয়েছিলেন। তাঁর অন্যান্য সহপাঠীদের মধ্যে খুরশীদ আলম সাহেব প্রথমে সাব-ডেপুটি, পরে প্রমোশন পেয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্টেট হয়েছিলেন। খবীরউদ্দিন আহম্মদও মুজাফফর সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বি এ পাস করে তিনি স্কুল সাবইন্সেপেক্টরের চাকরী নিয়েছিলেন। এবং ক্রমে রিজিওনাল ইন্সপেক্টর অব স্কুলস পর্যন্ত হয়েছিলেন। মুজাফফর সাহেবের বামপন্থী ও বিপ্লবী রাজনীতি তাঁর সরকারী চাকুরে বন্ধুদের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, কিন্তু খবীর উদ্দীন সাহেব তাকে কোনও দিন এড়িয়ে চলেননি। কমরেড মুজাফফর বলতেন যে তার এক মাত্র কন্যা মোসাম্মৎ আফিফা খাতুন যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলেন তখন খবীর সাহেব তাদের খোঁজখবর নিতেন সব সময়ে।
১৯১৩ সালে মুজাফফর সাহেব সন্দীপ থেকে চুচুড়ায় এসে হুগলী মোহসিন কলেজে আইএ কলেজপ ভর্তি হলেন, কিন্তু ওখানে ম্যালেরিয়া জরে আকান্ত হয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হলেন বঙ্গবাসী কলেজে। তখন থেকেই তিনি কলকাতা মহানগরীর বাসিন্দা ।
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চতুর্দিকে জলবেষ্টিত একটি দ্বীপের একটি অখ্যাত গ্রামে ও অজ্ঞাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও মুজাফফর আহমদ দেশ-দেশান্তরে হয়েছিলেন খ্যাত ও স্মরণীয়। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তার মনীষা, তার খ্যাতি হয়ে উঠেছিল উজ্জল থেকে উজ্জলতর। সন্দীপের মূসাপুর গ্রামের মনসুর আলী-চূনা বিবির ছোট ছেলে মুজাফফর আহমদ সুবিশাল ভারতীয় উপমহাদেশে হয়েছিলেন এক রূপকথার নায়ক, ইতিহাসের এক কিংবদন্তী। কাজী নজরল ইসলামের ‘ধূমকেত’ পত্রিকায় মুজাফফর আহমদ নিয়মিত লিখতেন ‘দ্বৈপায়ন’ ছন্দনামে। সন্দীপের মানুষ হিসেবেই সম্ভবত তিনি দ্বৈপায়ন নামটি গ্রহণ করেছিলেন। সমুদ্রবেষ্টিত এই দ্বীপের মানুষের নিত্যসহ – চর প্রাকতিক ঝড়ঝঞ্জা ও প্লাবন। প্রতিকুল অবস্থা ও কঠিন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সংগামের অনমনীয় দৃঢ়তা মুজাফফর আহমদ নিঃসন্দেহে জন্মসূত্রেই লাভ করে ছিলেন।
সন্দীপের মুসাপুরের মজাফফর আহমদ তার অনন্য সাধারণ প্রতিভা, অতুলনীয় সততা ও নিষ্ঠা এবং বলিষ্ঠ বিল্পী আদর্শে পরবর্তী জীবনে সন্দীপের গন্ডি ছাড়িয়ে, নোয়াখালীর আওতা ছড়িয়ে, এমনকি সারা বাংলাদেশেরও সীমানা ছাড়িয়ে সব ভারত উপমহাদেশের শোষিত ও বঞ্চিত জনতার শুধু যে পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতে প্রগতিশীল বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা, কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠীত, মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের দক্ষ সংগঠক, সর্বহারার মুক্তি সংগ্রামের পৃথিকৎ এবং একজন অতি উচ্চমানের লেখক ও সাহিত্য সংস্কৃতি সেবী।
পার্থিব অর্থে মুজাফফর আহমদ আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু, তার মত মহান পুরুষের মৃতু্য নেই। নিঃসন্দেহে এক মৃত্যুহীন প্রাণের ফর। কমরেড মুজাফফর দীর্ঘ জীবি হোন!
কমরেড় মুজাফফর আহমদ অন্তরঙ্গ স্মৃতিকথা
মাহফুজউল্লাহ
বৃটিশ – ভারতে কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফফর আহমদ পরলোকগমন করেছেন। পরিণত অথাৎ চরাশি বছর বয়সে এই মত অত্যন্ত স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এই মত এমন এক জীবনের অবসান ঘটিয়েছে, যে জীবন ভারতের কনিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত—দীর্ঘদিন যার সাহসী উপস্থিতি প্রগতিশীল বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী ও নেতৃত্বকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
মুজফফর আহমদের এই মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও একেবারে স্বাভাবিক নয়। স্বাভাবিক নয় এই কারণে যে এই মৃত্যু বহু স্মৃতিকথা, জীবনালেখ্যর জন্য দেবে। আগামী দিনগুলোতে তাঁর এই মহাপ্রয়ণকে সশ(অস্পষ্ট চিত্তে স্বরণ করবেন অগুণতি সংগ্রামী মানুষ ।
মুজাফফর আহমদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুধু আদর্শগত নয়, আত্মিকও। সে কারণেই এই অন্তরঙ্গ স্মৃতি কথা । মুজাফফর আহমদের জীবনকে এই স্মৃতি, কথায় চিত্রিত করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় তার গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করা। মুজাফফর আহমদ বলত : রাজনৈতিক কর্মী রাজনীতি তার সমগ্র জীবনের সাধনা। রাজনীতির কারণে মুজফফর আহমদ পারিবারিক বন্ধনকে ত্যাগ করেছেন, জীবনের মোহকে অস্বীকার করেছেন।
রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও, জীবনের কাছ থেকে দূরে সরে যাননি তিনি। জীবন অর্জনের এক অদ্ভুত স্পৃহা এই মানুষটিকে সারা জীবন সতেজ রেখেছে। তাই জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন তিনি।
যে সময়ে যে পরিবেশে এবং যে পারিবারিক গন্ডির মধ্যে মুজফফর আহমদের জন্ম– সেখান থেকে এমন একজন মানুষ বেরিয়ে আসবেন, একথা কল্পনা করা কষ্টসাধ্য। ১৯২০ সালের দিকে মুজফফর আহমদ স্থির করলেন আর সাহিত্য সমিতি নয়। এখন হতে রাজনীতিই হবে আমার পেশা। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব তখন সারা দুনিয়ায় এক আলোড়নের সৃষ্টি করেছে শ্রমিক কৃষকদের “মুক্তি আন্দোলনে আতোৎসর্গ করবার জন্য উৎসাহী করেছে বহু যুবককে । কিন্তুু যে পরিবার থেকে মুজফফর আহমদ এসেছেন সে পরিবার সনাতনী পবিবাব। সে পরিবার প্রচলিত প্রথা ও নিয়মকানুনে বিশ্ববাসী এখনো সে পরিবারের যারা আছেন তারা প্রচলিত মূল্যবোধকে নিয়ে বেচে আছেন। সে পারিবাবিক ঐতিহ্য একমাত্র ব্যতিক্রম মুজফফর আহমদ। তাই তার আক্ষেপ ও আমার পরিবারের কেউ এলো না রাজনীতিতে। আমার বড়াে আশা ছিলো কেউ আমার পথে আসবে।’
রাজনৈতিক জীবনে মুজফফর আহমদ যে প্রতিকুলতায় গৌরবের অধিকারী হয়েছন তার অধিকাংশই অনেকের জানা। জীবদ্দশায় বর্ণাঢ্য জীবনের এক অংশকে পত্তিকাকারে প্রকাশ করেছেন তিনি। সে বই (আমার জীবন ও ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি) শুধু তার আত্মজীবনী নয়, মূলত ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাস। তার জীবন ও ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি এমন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত যে, কোনটিকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাস, তিনি যখন লিখতে শুরু করেছেন তখন, মনে ভয় ছিল, হয়ত সে বই তিনি শেষ করে যেতে পারবেন না। মৃত্যু তার কর্মকে ভঙ্গ করবে। এ কারণেই দুঃখ ‘করে চিঠি লিখেছিলেন ‘বড় দেরীতে আমি আর একখানি বই লেখায় হাত দিয়েছি। অর্থ্যাৎ যতটুকু লিখছি ততটুকু সঙ্গ সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এ সত্তকের গান দিয়েছি তার জীবন ও ভারতে কম্যুনিস্ট পার্টি ! জীবনে কুলোবে কিনা জানিনে। একটা জয়াখেলা আরম্ভ করেছি। হয়তো প্রকাশকদের বহু টাকা ডুবে যাবে। একজন মানুষ কত খানি সৎ হলে এ স্বীকারোক্তি সম্ভব, এ উক্তি তার প্রমাণ। একদিকে প্রকাশকদেব অর্থ বিনিযোগ অন্য দিকে জীবনের পরিসমাপ্তির ভয়। জীবন যে তার শেষ হয়ে এসেছে এ উপলদ্ধি তার হয়েছিল। তাই এ বছরের প্রথম থেকেই আপনজনদের কাছে পেলে জড়িয়ে ধরতেন। বলতেন ‘আমি হয়তো আর বেশী দিন বাঁচবো না। তোমরা কি আমার কাছে থাকতে পারো না ? মৃত্যুর আগে একবার যদি নিজ বাড়ী সন্দীপে যেতে পারতাম। দেশের বাড়ী থেকে অনেক দূরে, আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন তিনি। অথচ টানা পরনে ভুগছেন। একদিকে দেশের জন্য মমতাবোধ, অন্যদিকে আশ্রয়স্থলের জন্য টান। এ পরিস্থিতিতে একই মানুষ লিখতে পেরেছেন-সন্দীপে যে ঝড় আর বন্যা হলো তার বিস্তৃত খবর দিও। কাগজ পড়ে তো মনে হয় সন্দীপ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।’—তুমি লিখেছ দেশ কি আমার পক্ষে বিমতির অতলে ডুবে গেছে ? আমার ওপরে তুমি অন্যায় করছ। আমি কোনো কিছু ভুলিনি। দেশ ভাগ হওয়ার আগে আমি তোমাদের দেশে রাজনীতি করেছি। কিন্তু আমার জীবনের বিরাশি বছর পাঁচ মাসের মধ্যে আমি প্রায় ৫৯ বছর কলকাতায় কাটিয়েছি। যখন খেতে পাইনি, তখন কলকাতা আমায় খাইয়ে বাচিয়ছে। কলকাতার প্রতি আকর্ষণ হবে না আমার ? এই আকর্ষণ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাকে ধরে রেখেছে কলকাতায়। পরিস্থিতি স্থির হলে হয়ত নিজ দেশেই থেকে যেতেন। দেশ ভাগের পর সেজন্যে এখানে এসেছিলেনও। কিন্তু হলিয়া জারী হওয়ায় আসা আর সম্ভব হয়নি। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে মুজফফর আহমদের যোগাযোগ বহু দিনের। ধরতে গেলে নজরুল ইসলাম তারই আবিষ্কার। নজরুল জীবনের ওপর যা তার বই কাজী নজরুল ইসলাম ও স্মৃতিকথা একখানি প্রামাণ্য পন্থা। এই স্মৃতিকথা নিজে সফী জুলফিকার হায়দার এর সঙ্গে তার মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। হায়দার সাহেব তার সম্পর্কে কিছু আশোভন মন্তব্যও করেছিলেন। সে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন- হায়দার সাহেবের লেখাটা আমি দৈনিক পাকিস্তানে পড়েছি। তারাই একখানা কাগজ পাঠিয়েছিলেন। কথাটা হচ্ছে এই যে, আমি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা নাম দিয়ে একখানা পুস্তক লিখেছি। পুস্তকখানা ছাপা হওয়ার পরই যুদ্ধ বেধে যায় । পাকিস্তানে বোধ হয় দু পাঁচখানার বেশী বই যায়নি। এ পুস্তকের শেষ ভাগে আমি হায়দার সাহেবের নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছি। ভাষা ভালো হলেও লেখায় সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণতা ফুটে উঠেছে। বড় সাম্প্রদায়িক মন তার আমার সম্বন্ধেও ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। কয়েক বছর তিনি সত্যিই নজরুলের অনেক সেবা করেছেন । তিনি নিজে সেটা ফলাও করে করে বলেন এবং চান যে অন্যরাও তাই করুন। আমার পুস্তকে তার সেবার স্বীকমতি যথেষ্টই আছে। কিন্তু, তার মন তাতে ভরেনি। কিন্ত আমার যে তার বেশী ভাষার জোর নেই। গোল বেধেছে আরও একটি ব্যাপার, নিয়ে। নজরুলের গত জন্মদিনে কে বা কারা আমার লেখার হায়দার সাহেব সম্পর্কিত অংশটা কপি করে পূর্ব পাকিস্তানের অনেকগুলি কাগজে ছেপে দিয়েছেন। ‘আমি ঘনক্ষরেও ততু কিছু জানতাম না। আমার তখন ৭৭ বছর বয়স। এত বড় লেখা কপি করে এতগুলি কাগজে পাঠাবার ধৈর্য আমি কোথায় পাব? আমি তার নাম বিকৃত করিনি। আরবী শব্দ জুলফিকারের অভিধান সম্মত উচচারণ করেছি আমি। নিজের নামের আগে নিয়ে কেউ সফী লেখেন ? তার পারিবারিক পদবী নয়। আমি কি নিজের নামের আগে। নিজে কমরেড লিখি। আমি ২ শামাদের আন্দোলনের লোকদের কমরেড, বাইরের লোকে কমরেড আমি নই। আমি ‘দৈনিক পাকিস্তান’ কাগজে খানিকটা লিখে পাঠিয়েছি। আমি ভারতবর্ষের লোক আমার লেখা পাকিস্তনের কাগজে ছাপানো সম্ভব কিনা জানিনে । পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের পক্ষে অগ্রগতি তার খবরাখবর রাখতেন মুজফফর আহমদ। অন্তত জ্ঞান সাধনা এই মানুষটির সারা জীবনের এক নেশা। চোখে যখন ছানি পড়েছে, পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে, তখন একজন তাকে পড়ে শুনিয়েছে। জ্ঞান সাধনা ছিল বলেই সবকিছু, খবর রাখতেন। সে জন্যেই লিখতে পেরেছিলেন— ফিজিক্স তো সারা দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। তোমার বিপ্লব কেন ফিজিক্সের ভিতর দিয়ে আসবে না ? ফিজিস্কের লেবরটারিতে একান্ত গবেষণা করাইতে হবে প্ৰকৃত দেশপ্রেমিকের কাজ। ঝড়, তুফান, বন্যা ও জলোচ্ছাস প্রতি বাংলাদেশকে ধংস করে দিচ্ছে। ঝড়ের উদ্ভব কোথায় হয়েছে বিজ্ঞান জানতে পারে। সৃষ্টির সংকেত যখন বিজ্ঞান পেয়ে যায় তখন তাকে অংকুরে বিনষ্ট করার উপায়ও বিজ্ঞানকেই আবিষ্কার করতে হবে। আমি এসব ভালো বুঝি । তোমরা বিজ্ঞানের ছাত্র। তোমাদেরই এটা বুঝতে হবে । তোমাদের স্টেট কি এমন লেবরোটরি স্থাপন করতে পারে না। যার ভিতরে এ বিষয়ে কিছু সংখ্যক বৈজ্ঞানিক নীরবে গবেষণা করে। যাবেন ? তোমাদের বিজ্ঞানের ওপর অত্যাধিক মেধা আছে বলেই আমার মতো অবৈজ্ঞানিকের মনেও এসব চিন্তার উদয় হয়। এ চিন্তা কি একেবারেই হাস্যকর ? যে মানুষ জীবনে সুখী পারিবারিক জীবন গ্রহণ করেননি সে মানুষে পরিবারের টানে দেশের টানে ব্যাকুল হয়েছেন। উনি হয়েছেন। পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের কাছে তার যেসব চিঠিপত্র রয়েছে সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় আপনজনদের খবর জানার জন্য তিনি কত উদ্গিব ? তার দুঃখ তার আত্মীয় পরিজনেরা তাকে ভুলে গেছে—কলকাতায় বিরাশি বছর চার মাস বয়স্ক এক বৃদ্ধ এখনও বেচে আছে। তাকে তোমার মামারা ভুলে গেছে। আমি কোথাও থেকে খবর পাচ্ছিলাম না । কত লোকে কাছে গিয়েছি অর্থাৎ কত লোককে ডেকে বলেছি। ২৩শে তারিখ মুক্তাদিরের বাসার ঠিকানার জরুরী টেলিফোন বন্ধ করে আজও যোগাযোগ হয়নি। এইমাত্র বুকিং ক্যানসেল করে দিলাম । যেদিন প্রথম ডাক চলাচল হলো সেদিন কাদিরক একখানি পত্র লিখেছি। কোনো উত্তর নেই। যে মানুষ নিজে জীবনের ছন্ন ছাড়া ভাবে সকল স্বীকারোকিত করছেন, সে মানুষ বলেছেন, তোমার মায়ের মুখে হয়তো শুনে থাকবে ? আমি একজন ছন্ন ছাড়া লোক। অত্মীয় স্বজনদের নিকট হতে বহু দূরে সরে গিয়েছি। তবুও ওয়াজিদের শিশু বলে তাকে কোলেপিঠে করেছি। অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয়ে যাওয়ায় কলকাতায় দাঁড়িয়ে থেকে তার বিয়েও দিয়েছিলেম । প্রথমে আফিফার মেয়ে রুবি লিখেছিল যে ওয়াজিদে ক্যান্সাৱ হয়েছে বলে চিকিৎকরা সন্দেহ করছেন। সেদিনই তার দ্বিতীয় পুত্র রবি কদিন পরে লিখেছিল যে ডাক্তাররা ক্যানসার বলেই নিশ্চিত হয়ছেন। সেদিনই বুঝেলাম একটা নিষ্ঠুর খবর আমি পাব। কিন্তু, এত তাড়াতাড়ি যে খবরটা পাব তা ভাবতে পারিনি। ক্যানসার হওয়ার কারণ বৈজ্ঞানিকরা আজো করতে পারেনি। এই কারণে এই রোগের ঔষধ তৈরি হয়নি। তুমি হয়তো জানো না তোমার খালু ইলিয়াসও এই রোগেই মারা গিয়েছিল। সব কিছু জেনে বুঝেও আমার মনটা বড় ভারাকৃত হয়ে আছে। মনটাই বড় অদ্ভুদ জিনিস। শিশু ওয়াজিদকে কেবলই মনে পড়ছে।
যে মানুষ তার আতীয়স্বজনদের জন্য এত উদ্গিব্ন এত ব্যথিত সে মানুষ কিভাবে তার স্ত্রীকে ভুলে থাকলেন। বিয়ের ক দিন পরই কার্যতঃ তার পারিবারিক জীবনের ইতি হয়েছিল । তার মতে-বিয়েটা তাকে অনেকটা জোর করেই করানো হয়েছে । তার স্ত্রী ও তার মৃত্যুর সঙ্গে একটা অদ্ভুত যোগাযোগ রয়েছ। কারো মৃত্যুর সময়ই আপনজন বলতে কেউ কাছে ছিলেন না । তার স্ত্রী যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন স্বামীর উপেক্ষার জন্যে আক্ষেপ করেছেন, নীরবে অশ্রু বর্ষণ করেছেন। অপরদিকে কমরেড মুজফফর আহমদও যে একেবারে স্ত্রীর কথা ভাবেননি, এমন নয়। তিনি বলেছেন বিয়ের পরই তার প্রতি আমার একটা বিতৃঞা এসে যায়। এমন নয় যে তার মমতায় কোন খাদ ছিল । তবুও কেন জানি তাকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই বলতে গেলে বাড়ী থেকে প্রায় পালিয়েছি। পরে এ নিয়ে মনোবিজ্ঞানের বই পড়েছি। জানতে চেয়েছি কেন এমন হল ? দেখলাম মনোবিজ্ঞানের এ ধরনের বিতৃষ্ঞার একটা বিশ্লেষণ রয়েছে। একটা সুস্থ পারিবারিক জীবনকে তিনি কখনো খাটো করে দেখেননি। তাই লিখেছেন কানাইয়ের কথা বলেছি। সেই আমার সব কিছু করে । আমি অক্ষম – অসমর্থ । কানাইয়ের ২৪ বছর বয়স। গোঁ ধরেছে, ১লা এপ্রিল তারিখে বাড়ী যাবে। জওয়ান ছেলেমেয়েদের মিলনে কি করে বাধা দিই বলতো ? দেশ আসবার জন্য মুজফফর। আহমদ ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। অথচ দেশে আসবার সময় তাকে এ যে কত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সে খবর অনেকেই জানে না। এ জন্যে দুঃখ করে লিখে – ছিলেন–আমি ঢাকা যেতে চাই একথা তোমাকেও আমি লিখেছিলাম। আসলে তোমাকে লেখার পরে কাদিরকে লিখেছিলাম । ৩০শে জুন পর্যন্ত মেয়াদ থাকলে এইরকম একটা অস্থায়ী অনুমতির জন্য আমি আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে লিখেছিলাম। এই অনুমতি দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। তবুও আমার ব্যাপার কেন তা ভারত গবর্নমেন্টকে পাঠালেন এবং তারা তা আটকে দিলেন জানিনে। এখানে তা খবর হিসাবে কাগজে ছাপা হয়েছে। আশ্চর্য এই যে বাংলাদেশের কাগজে খবরটা ছাপা হয়নি। মোটের ওপরে আমার আর বাংলাদেশে যাওয়া হলো না। কাদিরকে লিখেছিলেন যে এই নিয়ে আমি লেখালেখি করব। পরে ইচ্ছা করেই তা করলাম না। এটা বুঝেছি যে আমার সম্বন্ধে তোমরা নিরুত্তাপ। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নজরে এখবরটি একেবায়েই পড়ল না, এটা কেমন কথা।’
আন্দোলন, সংগঠন এসব ছিল তার জীবনের লক্ষ্য । তাই যারাই সংগঠনের কাজে নিয়োজিত তাদেরকে তিনি উৎসাহিত করেছেন-‘তোমরা দু ভাই ছাত্র – সম্মেলনের কাজে বিশেষ খেটেছ, তোমার বড় ভাই মাহবুব ছাএ – ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে, এসব সত্যই সুখবর । জীবনে সংগঠনের অভিজ্ঞতা লাভ করা একান্তই প্রয়ােজন। তোমাদের বহিওর জীবন এবার শুরু হলো । ঘরের কোণে বসে শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়া কোনো জীবন নয়।
জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি প্রায় চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। শেষ বারের মতো প্রকাশ্যে জনসমক্ষে উপস্থিত হয়েছিলেন ৬৬ সালের মে দিবসে। জীবনের শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে যখন তিনি অবসর জীবন-যাপন করছিলেন তখনও চুপ করে থাকেননি। কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ডের রচনা প্রায় শেষ করে এনেছিলেন । থাকতেন পার্টি হাউসে। চলতেন পার্টির পয়সায় । কিন্তু পার্টির নিয়ম – শৃংঙ্খলা কখনো ভাঙেননি । তাই শেষ পর্যন্ত পার্টি ফান্ডে চাঁদা দান অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি মনে করতেন–শৃংঙ্খলাই যদি মেনে চলতে না পারলাম তাহলে এ রাজনীতি গ্রহণ করলাম কেন? (অস্পষ্ট )
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1973.12.28-mujaffor-bichitra.pdf” title=”1973.12.28 mujaffor bichitra”]