মার্চ-থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ কারারুদ্ধ সংবাদপত্র
হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ
সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩
‘আমি পুরোদস্তর প্রেস সেন্সরশীপ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব সিদ্ধান্ত অনুসরণে শীগগীরই সামরিক আইন বিধি জারি হবে……..। ঘোষণাটি ছিল মত পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের। পাক হানাদার বাহিনী বর্বর দস্যুর মতো শ্বাপদের হিংসতা নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরত্র বাঙালীর উপর একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে তার প্রায় কুড়ি ঘন্টা পর কালো কুত্তায় আসক্ত মাতাল ইয়াহিয়া পাক বেতারে নিজেদের সাফাই গেয়ে বক্তৃতা দিল। ঘোষণা করলো— দেশে কোনরকম রাজনৈতিক তৎপরতা চলবে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। পাকিস্তানের তথাকথিত সংহতি, অখন্ডতা ও নিরাপত্তার জিগির তলে ইয়াহিয়া খা বললো —এর নিশ্চয়তা বিধান করা সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্য। তাই তাদের কর্তব্য পালন এবং সরকারী কতৃত্ব পূর্নপ্রতিষ্ঠার সে নির্দেশ দিয়েছে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে প্রেস সেন্সরশীপ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাকিস্তানী শাসকচক্রের এবারের এই নয়া প্রেস সেন্সরশীপের হেকমত বয়ান করে ২৬শে মার্চ করাচী ডেটলাইনে জারি করা হলো ইয়াহিয়ার ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি। এতে বলা হলো— (ক) পাকিস্তানের অখন্ডতা বা সংহতির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনা বা সমালোচনার ঝোক (খ) সামরিক শাসন প্রয়োগ, তা চালু বা অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনার ঝোঁক (গ) জনসাধারণের মনে আতংক বা হতাশা সষ্টির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঝোঁক বা মতলব (ঘ) সশস্ত্র বাহিনী (অর্থাৎ সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী) পুলিশ ও সরকার এবং তার কোন সদস্যের। বিরদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অসন্তোষ সৃষ্টির ঝোক বা তার মতলব (ঙ) পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কিংবা কোন অঞ্চলের বিরদ্ধে অথবা, পাকিস্তানে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণীর নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঝোঁক বা মতলব (চ) ইসলাম ধর্মের প্রতি আক্রমণাত্নক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ঝোঁক বা মতলব (ছ) কায়েদে আজমের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবমাননা বা তার ঝোক সম্বলিত কোন কিছু কোন ব্যক্তি সংবাদ পত্র বা অন্য কোন কাগজে বা দলিলে মুদ্রণ বা প্রকাশ করতে পারবে না। ৭৭ নম্বর সামরিক বিধিতে আরো বলা হলো—কোন ব্যক্তি সংবাদপত্রে বা কাগজে বা অন্য কোন দলিলে এমন কিছু মুদ্রণ বা প্রকাশ করতে পারবে না। যার মধ্যে পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক দল কিংবা কোন নেতা অথবা কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চেষ্টার ঝোক রয়েছে। আইনে আরো বলা হলো —সরকার নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আগে পেশ না করে এবং কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র না নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনা, ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন রাজনৈতিক বিষয় প্রকাশ করা যাবে না এই কাননের খেলাফ হল সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হবে । মোদ্দা কথা হলো—সংবাদপত্রের সার্বিক কণ্ঠবোধ। শুধু এই ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি নয়, এরপর নাজেল হতে লাগলো। একের পর এক সামরিক আইনের আদেশ। যেন একচেটিয়া ভয়াল শ্বাপদ, কোন কোন আলোকে আপাত দৃষ্টিতে নির্বিবাদী মোহান্ত বলে মনে হলেও প্রত্যেকটি বিধি ও আদেশ ছিলদেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের বিবেকী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যে একেকটি নখরযুক্ত থাবা । এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোপানীর আমলে ১৭৯৯ সালের মে মাসে আইন জারি করেছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি । আইনটি ছিল পত্রিকায় প্রকাশিতব্য সব খবর আগে কোম্পানী কতৃপক্ষের সেক্রেটারীর কাছে পাঠাতে হবে । সেক্রেটারী সেসব খবর পরীক্ষা করে দেখবেন। যেসব খবর এবং খবরের যেসব অংশ তিনি পছন্দ করবেন না তা তিনি বাতিল করে দেবেন। অনুমোদিত খবর ছাড়া অন্য কোন খবর ছাপা যাবে না। ক্যালকাটা গেজেট, হরকরা, ইন্ডিয়া গেজেট প্রভৃতি পত্রিকা তখন এদেশ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদক ইংরেজ। কিন্তু যেসব খবর তারা ছাপতেন তা সবসময় কোম্পানী কর্তৃপক্ষের পছন্দ হতো না। মাঝে মাঝেই কোম্পানী কর্তৃপক্ষের অাঘাতে ঘা পড়তে লাগলো। তাই জারি হলো সেন্সরশীপ বিধি। সতেরো বছর পর লর্ড হেস্টিংস এই আইন প্রত্যাহার করলেন। কিন্তু তাই বলে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ও তার প্রচেষ্টা বন্ধ হলো না। এদেশে বোধকরি সেই থেকে সেন্সরশীপ শুরু হয়। এবং তারপর বহুবার বহুভাবে এদেশে সংবাদপত্রের কণ্ঠকে রোধ করার জন্যে আরোপিত হয়েছে বিধিনিষেধ । ১৯৪৭ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাসে বহুবার বহুভাবে আরোপিত হয়েছে বিধিনিষেধ । তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, ছাপা খানা বাজেয়াফত করা হয়েছে, সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করা হয়েছে, তাদের উপর চালানো হয়েছে নির্যাতন, জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চে আবার তারই পুনরাবৃত্তি হলো। কিন্তু এবারের পরিপ্রেক্ষিত অনেক অনেক ব্যাপক এবং তাই কণ্ঠরোধের জন্যে বিস্তৃত্ব থাবা অনেক বেশী ভয়াল। এবারের প্রচেষ্টা একটি সংগামী জাতির সার্বিক স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে। হানাদার পাক শাসকদের এই সেন্সরশীপের বিধি কার্যকর করার জন্যে (ওদের ভাষায় সংবাদ পত্রকে এই বিধি পালনে মদদ দেয়ার জন্যে) বসানো হলো সেন্সরশীপ হাউস। সব খবর, সম্পাদকীয় এবং প্রকাশিতব্য অন্যান্য নিবন্ধ—সব পাঠাতে হবে সেন্সরশীপ হাউসে পরীক্ষার জন্যে। মার্চের পর কয়েক মাস গোটা সংবাদপত্রের (অবশ্য সব পত্রিকার নয়) ডামি শীট পাঠাতে হতো এই সেন্সরশীপ হাউসে। ওখান থেকেই পাস করে দেয়া হলেই তবে তা পত্রিকায় ছাপানো যাবে। স্মর্তব্য, সেন্সরশীপ বিধি চাল হয়েছিল সারা পাকিস্তানের জন্যেই। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে ওটা ছিল নিছক একটা উল্লেখ মাত্র। ওখানে সেন্সরশীপ হাউস বসেনি। বসেছে পূর্ব পাকিস্তানে কারণ সমগ্র মামলা হলো পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার জন্যে সংগ্রাম শুরু করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সমগ্র পত্রপত্রিকা এই বিচিছন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে, এদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে চিৎকার করেছে। অতএব ওদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা পূর্ব পাকিস্তানেরও দুয়েকটি পত্রিকা নিয়ে ছিল না। এদের একটি হলো— সংগ্রাম। জামাতে ইসলামীর মুখ পত্র। এর পরিচালকমন্ডলী থেকে সাংবাদিক ও প্রশাসনিক কর্মীদের (দুয়েকজন ছাড়া সবাই ছিল জামাতে ইসলামীর সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। অতএব সংগম নিয়ে কোন ভাবনা নেই। ঢাকার আরেকটি বাংলা দৈনিক ও ইংরেজী দৈনিকের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানিয়েছেন হানাদার পাকিস্তানী দের। ন্যাশনাল প্রেসট্রাস্টের করাচী- ঢাকা সংস্করণের ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদক কার্যনির্বাহী হলেন অবাঙালী-পাকিস্তানের তাবেদার । কিন্তু, এই তিনটি পত্রিকার সাংবাদিকরা তো (এক জন ছাড়া) আর তাবেদার নন। হামিদুল হক চৌধুরী নাকি টিক্কা খানের সঙ্গে এক বিশেষ বৈঠকে বলেও ছিলেন—আমি আমার পত্রিকার স্টাফদের বিশ্বাস করি না। এই দুই পত্রিকার সাংবাদিকদের তাই দুটো খড়গ মাথার উপর ঝালিয়ে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয়েছে। একটি—হানাদার সামরিক শাসকদের খড়গ, এবং আরেকটি—হামিদুল হক চৌধুরীর খড়গ। অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তানে সেন্সরশীপ হাউস কিভাবে কাজ করেছে, সাংবাদিকদের কিভাবে কাজ করতে হয়েছে সে সর্ম্পকে সংক্ষিপ্তভাবে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমি বলবো। আমরা সাংবাদিকরা কিভাবে কাজ করেছি। ত্তারও মোটামুটিভাবে একটি চিত্র তুলে ধরবার চেষ্টা করবো। সেন্সর কর্তারা মৌখিক ও লিখিত ভাবে সংবাদপত্রে প্রেস এডভাইস পাঠাতো, গাইড লাইন পাঠাতো। ডিসেম্বরের চুড়ান্ত পর্যায়ের সংগ্রাম শুরুর আগ মূর্হুতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান দশরক্ষা আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরনো প্রেস এডভাইস পদ্ধতিই আবার নূতনভাবে পাঠিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর পদে সামরিক টিকার বদলে বে সামরিক আবদুল মোত্তালিব মালিক কে দায়িত্ব গ্রহণের দুদিন আগে ১লা সেপ্টেম্বর প্রধান সামরিক শাসনকর্তা ইয়াহিয়া খাঁ ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি পূনর্গঠন করে জারি করেছে ৮৯ নম্বর সামরিক বিধি । পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের কততাধীন দুটি তথ্য দফতর ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকায় যে তথ্য দফতর ছিল তার থানীয় অধিকৃত ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের একজন যুক্ত সচিব বা জয়েন্ট সেক্রেটারী। তার অধীনে ছিল রিজিওনাল ইন ফরমেশন ডিপার্টমেন্ট (যা পিআইডি নামে পরিচিত ছিল) ডাইরেক্টরেট অব ফিমস এন্ড পাবলিকেশন্স এবং রিজিওনাল পাবলিকেশন্স অফিস। যুগ্ন সচিবের অধীনে পিআইডি বা আঞ্চলিক তথ্য দফতরের প্রধান। ছিলে ডিআরআই বা ডিরেক্টর অব রিজিওনাল ইনফরমেশন্স। তার পরবর্তী পদে ছিলেন একজন ডেপুটি প্রিন্সিপ্যাল ইনফরমেশন অফিসার। প্রাদেশিক তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল চলচিত্র নির্মাণ ও প্রকাশনা সেলসহ আরেকটি আলাদা তথ্য বিভাগ। তথ্য সচিবের অধীনে এই বিভাগের প্রধান ছিলেন একজন ডিরেকটর বা পরিচালক। তার পদমর্যাদা ছিল এই মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ন সচিবের । ২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি জারি করার পর সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের কার্যক্রম নিয়ত্রণ এবং এসব ক্ষেত্রে সরকারী নীতি সর্ম্পকে বক্তব্য পরিবেশনার দায়িত্ব আরেকটি দফতরের ঘাড়েও বর্তালো। তার নাম ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স, সংক্ষেপে আইএসপিআর বা প্রতিরক্ষা বাহিনীর আন্ত সার্ভিসেস জনসংযোগ বিভাগ। ঢাকায় এই বিভাগের জনসংযোগ অফিসার ছিলো মেজর সালেক। আর এই বিভাগের স্থানীয় উধর্বতন নীতি নিধারক ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। কার্যত এই আইএসপিআর বা মেজর সালেক বা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী হয়ে দাঁড়ালো সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের মুখ্য নিয়ন্ত্রক। মার্চে হানাদারদের ক্র্যাকডাউনের পর এই মুখ্য নিয়ন্ত্রকগোষ্ঠী সব সময় চেষ্টা করেছে কেন্দ্রনীয় ও প্রাদেশিক ‘মতথ্য দফতরের কর্মচারীদের এই নিয়ন্ত্রণ কাজে ভাগীদার করার জন্যে। ২৬শে মার্চের পর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো হানাদার শাসকদের সেন্সরশীপ হাউস। ডিসেস্বর পর্যন্ত এই সেন্সরশীপ হাউস নানাভাবে নানা পদ্ধতিতে কাজ করেছে। মার্চ থেকে ডিসেস্বর পর্যন্ত এই সময়কালকে মোটামোটি ৩টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। তা হলো—১। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়কাল, ২। জুলাই থেকে সেপ্টেবর-অক্টোবর পর্যন্ত সময়কাল এবং ৩। অক্টোবর থেকে চুড়ান্ত পরাজয় পর্যন্ত সময়কাল। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়কালের কথা বলছি। ২৫শে মার্চের রাতে হানাদারদের ক্র্যাকডাউনের পর অধিকৃত ঢাকার অব রব সাংবাদিকরা আবার যখন কাজে যোগ দিতে বাধ্য হলেন, যখন পত্রিকাগুলো তিন চারদিন বন্ধ থাকার পর আবার প্রকাশনা শুরু। হলো তখন সামরিক চক্রের কাছে প্রশ্ন দাড়ালো, কাদের মাধ্যমে তারা কাজ চালাবে। প্রাদেশিক তথ্য বিভাগের উপর তাদের ভরসা নেই। কেন্দ্রীয় তথ্য দফতর বা পিআইডি সম্পর্কেও একই চিত। এখানেও বাঙালী কর্মচারী ওখানেও প্রধানত বাঙালী কর্মচারী। অথচ বাঙালী ছাড়া উপায় নেই। ঢাকায় একটি উর্দু এবং দুটি ইংরেজী পত্রিকা ছাড়া আর সব পত্রিকা প্রকাশিত হচেছ বাংলায়। অতএব বাঙালী কর্মচারীদেরই কাজ করতে বাধ্য করো এবং পাক শাসকদের বশদ বাঙালী কর্মচারী খুজে বের করো । সেন্সরশীপ হাউস বসলো সেগুনবাগিচার নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবনের পিআইডি অফিসে। মেজর সালেক খবরদারী করছে সব কার্যক্রমের। মেজর সালেক তথা রাও ফরমান আলীর নির্দেশে কাজ করতে হচেছ পিআইডি কর্মীদের হানাদারদের আস্থাভাজন ডেপুটি প্রিন্সিপ্যাল ইনফরমেশন অফিসার কফিল আহমদ তখন ছিলেন চট্টগ্রামে। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। তখন আমরা সাংবাদিকরা শুনতাম, মেজর সালেকের অন্যতম প্রধান দোসর হিসেবে কাজ করছেন কফিল আহমদ। তখন আরো শুনেছি, আরো তিনজন বাঙালী অফিসারের উপর হানাদার সামরিক শাসকেরা যে কোন কারণেই হোক আস্থা রাখতো। তাদের একজন ইন্তেকাল করেছেন। সংবাদপত্রের প্রত্যেকটি খবর, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়, অন্যান্য নিবন্ধ অনুমোদনের জন্যে পাঠাতে হতো এই সেন্সরশীপ হাউসে। এমনকি পঠা মেকআপ করার পর সেই ডামী শীটও অনুমোদনের জন্যে সেন্সরশীপ হাউসে বেশ কিছুদিন পাঠাতে হয়েছে। সেন্সরশীপ হাউস এসব প্রকাশিতব্য খবর অনুমোদন করে দিলেই তবে তা পত্রিকায় ছাপা যেতো। ৭৭ নম্বর সামরিক বিধির আওতায় পড়ে এমন কোন বিষয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামান্যতম ঝোঁক থাকলে তা বাতিল করা হতো। পিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জন্য ছিল সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন। সেই অনুসারে তাদের কাজ করতে হতো। এর পরেও বিভিন্ন খবরের ভাষ্যতা যদি বাংলা হয়—অনুবাদ করে সামরিক কর্তাদের পড়ে শোনাতে হতো। মেজর সালেক সেন্সরশীপ হাউসে যেত সন্ধ্যায়। তবে তা প্রতিদিন নয়। মাঝে মাঝে একদিন দিন বাদ পড়তো। মেজর সালেক তদারকীর জন্য যেতেন। বেতার ও টেলিভিশনে প্রতিদিন। তার একদিন দিনের প্রত্যক্ষ অনপথিতিতে অবশ্য কাজের হেরফের হতো না। কারণ, পি আইডি কর্মীদের জন্যে রাখা আছে পিণ্ডির কেন্দীয় দফতর এবং স্থানীয় আইএসপিআর-এর নির্দেশ। সংবাদ সরবরাহ সংস্থা এপিপি সম্পর্কে এ প্রসঙ্গে কিছু বলার প্রয়োজন রয়েছে। হানাদার সামরিক সরকার সরকারী সংবাদ, দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রার্থিত ভাষ্য, বিবিধ বক্তব্য ইত্যাদির প্রায় সবগুলোই পরিবেশন করতে সংবাদ সংস্থা এপিপির মাধ্যমে। উদ্দেশ্য জনগণকে ধোকা দেয়া । ভাবখানা ছিল এই—সরকার তো আর নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছে , সাংবাদিকরা যা দেখছে যা শুনছে তাই লিখছে। বলাবাহুল্য, এপিপি পরিবেশিত সংবাদ ছিল সরকারের অনুমোদিত সংবাদ। সংবাদপত্রসমূহকে তাই এপিপি পরিবেশিত সংবাদ আর সেন্সর বা অননুমোদনের জন্যে পাঠাতে হতো না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, পিআইডি অফিসে মার্চ পরবর্তী সময়কালে সেন্সরের কার্যকম পরিচালিত হতো বলে আমি একে সেন্সর উল্লেখ করেছি। একটি আলাদা সেল হিসেবে পূর্ণাঙ্গ একটি সেন্সরশীপ চালু করা হয় আরো এ পরে—জুলাই মাসে। কিন্তু, পূর্ণাঙ্গ হোক আর অপূর্ণাঙ্গ হোক, পিআইডি কর্মীদের কাজ ছিল সেই একই—সেন্সরের কাজ। প্রেস এডভাইস প্রথাও চালু ছিল প্রথমাবধি। সংবাদপত্রসমহে মৌখিক প্রেস এডভাইস ছাড়া লিখিত গাইড লাইনও পিআইডি দফতর থেকে পাঠানো হতো। তবে জুলাই মাস থেকে তা আরো সবিন্যস্ত করা হয়। এমনি করেই চলতে লাগলো। সেন্সরের জন্যে কপি যাচ্ছে ফটো যাচ্ছে। দু দণ্ড প্রতাপে চলছে হানাদার সামরিক শাসকদের সংবাদপত্রের উপর প্রার্থিত নিয়ন্ত্রণ। কোন সংবাদপত্রের ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে সামরিক বিধির অন্যথাচারণ করে। তবু এর মধ্যেও যদি কেউ অন্যথাচারণের পরোক্ষ কোন ঝোকও দেখায় তার প্রতি নেমে আসে ওয়ার্নিং। ডেকে নিয়ে করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ কিংবা মে মাসের প্রথম নাগাদ পিআইডি সংবাদপত্রসমূহকে জানাল সব কপি পাঠাবার দরকার নেই। যেগুলো প্রয়োজনীয় (কথাটিতে তারা কি বোঝাতে চেয়েছিলেন জানা নেই) এর গুরুতপূর্ণ সে সব কপি পাঠালেই চলবে। কত পক্ষ আশা করছেন, আপনারা (অথৎ সংবাদপত্রসমূহ) আইনের প্রতি অনগত আছেন এবং অনগত থাকবেন। জানি না, পিআইডির এটা কোন লিখিত এডভাইস ছিল কিনা। তবে আমাদের ওখানে (সেসময় আমি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান—আজকের দৈনিক বাংলাকে চাকরী করতাম) এই খবরটি জানিয়েছিলেন আমাদের কার্যনির্বাহী সম্পাদক। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের বার্তা সম্পাদক, চীফ রিপোর্টার এবং বিশেষ করে সহকারী সম্পাদকদের বলে ছিলেন—পিআইডি থেকে যাই বলা হোক, আমাদের রিস্ক নেয়া উচিত হবে না। যেটাই একটু খটমটে মনে হবে সেটা তো পাঠাবেনই, অন্যান্যগুলোও পাঠিয়ে দেয়া ভালো। আর সময়টা এখন এ, ইনটেলিজেন্টলা ইনডাইরেক্টলী কোন কিছু লেখাও অনুচিত। জুন মাস পর্যন্ত এভাবে চললো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ততদিনে আরো দুর্বার হয়ে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হানাদারদের মেরুদন্ডে ত্রাসের চপড় লাগানো শুরু করেছে। হানাদার শাসকরা দেশে নরম্যালসি পূর্নপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে যতই চীৎকার করুক না কেন বুক মেলাতে পারছে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন বশুবদ সাংবাদিক এনে তাদেরকে নিয়ে নরম্যালসির চেস্টা লিখালেও হানাদাররা দাড়ে পানি পাচেছ । পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগী জনগণ ফিরে আসছে, অভ্যর্থনাকেন্দ্রে তাদের প্রচার সমাদর করা হচ্ছে হত্যাকার খবরে অধিকৃত এলাকার জনগণ যেমন বিভক্ত হচ্ছে না, তেমনি বিভৃান্ত হচ্ছে না বিশ্ববাসী। বিশ্বের সংবাদপত্র – সমূহে হানাদারদের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে রিপোর্ট ও সম্পাদকীয় । যুধিকত পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া আর সবগুলোকেই ধরে বেধে কাজ করাতে হচ্ছে। কিছু কিছু সংবাদে মোটিভের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ তাদের ধর্য যাচ্ছে না, কারণ পিআইডি থেকেই ওসব খবর অনুমোদিত হয়েছে। হানাদার শাসকরা স্থির করল ঢাকায় এবার আরো সুবিন্যস্তভাবে পূর্ণাঙ্গ সেন্সরশীপ হাউস চালু করতে হবে। জান মাসের দ্বিতীয়ার্ধে এ ব্যাপারে একটি বৈঠক বসল। সভাপতিত্ব করল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। বৈঠকে বলা হল, একটি আলাদা সেল হিসেবে সেন্সরশীপ হাউসকে গঠন করা হবে। এবং এর প্রধান হবেন প্রাদেশিক তথ্য বিভাগের পরিচালক। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক তথ্য বিভাগের পরিচালক ছিলেন জনাব আরশাদুজ্জামান, (বর্তমানে আলজিরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত)। অপূর্ব এক সাহসিকতার পরিচয় তিনি সেই বৈঠকে দিলেন। তিনি বললেন, আমি সারাজীবন বিদেশী দূতাবাসে কাজ করেছি। প্রেস এটাচ হিসেবে কাজ করেছি। সে সব দেশ প্রেস সেন্সরশীপ আমি দেখিনি। আমি জানি না প্রেস সেন্সরশীপ কি জিনিস। অতএব এই সেলের প্রধান আমি হতে পারবো না । ঘটনাটি জানানো হলো পিন্ডিকে। পিন্ডি বললো, কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য দফতরের মারফত আর সেন্সরের কাজ করানো যাবে না। একটা আইওয়াস দরকার। প্রাদেশিক তথ্য দফতরের কাউকে এই সেলে আসতে হবে। অবশেষে প্রাদেশিক তথা দফতরের অপর একজন উচ্চপ্রধদস্থ অফিসার এই সেন্সরশীপ হাউসের প্রধান হলেন। তাঁর নাম আমি উহ্য রাখছি । নবগঠিত এই সেরে তিনি হলেন প্রধান– প্রেস সেন্সরশীপ অথরিটি। পিআইডি দফতরের একটি কক্ষে এই সেলের অফিস বসলো। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক তথ্য দফতরের কর্মদের নিয়ে গঠিত হলো সেল । চব্বিশ ঘন্টাই তা খোলা কবে -~-পালক্রমে ডিউটি। ব্যবস্থা হলো লগৰৰ (অস্পষ্ট) এবং সীলমোহরের। প্রত্যেকটি আইটেম লগৰকে (অস্পষ্ট) এন্ট্রি হবে। কোনটা অনুমোদিত এবং কোনটা বাতিল হলো তার উল্লেখ থাকবে। অনুমোদিত আইটেমের গায়ে সীলমোহর মেরে লিখে দেয়া হবে— পাসড অথবা ইয়েস। আর বাতিল সংবাদের গায়ে দাগ পড়বে না। জুলাই মাস থেকে সেভাবে কাজ শুরু হলো । একাত্তরের সে সময়ে শুনতাম, নবগঠিত এই সেলের কর্মকর্তা তিনজন লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করতেন। এই তিন মোহান্ত হলো—১। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল এম চৌধুরী, ২। প্রাদেশিক তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হমায়ন ফয়েজ রসুল এবং ৩। আইএসপিআরএর মেজর সালেক। শুনতাম, সেই কর্মকতা অনেক সময় ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতেন । মেজর সালেকের সঙ্গে আলাপ না করে তিনি সরাসরি আলাপ করতেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে। জুলাই মাসের শেষের দিক থেকে এই কর্মকর্তার সঙ্গে মেজর সালেকের মনকষাকষি শুরু হয় । আইএসপিআর -এর বক্তব্য, খামোখা আইজি বা তথ্য সচিবের সঙ্গে আলাপ কেন? সব জিনিসই নিয়মমাফিক হওয়া উচিৎ। সব সময় জেনারেল সাহেকে বিরক্ত করা কেন ? মেজর সালেকই তো খেদমতে হাজির আছে। পরে ঠিক হলো, সেন্সর অথরিটি মেজর সালেকের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নেবেন। হানাদার শাসকরা কয়েক সহ যেতেই দেখতে পেলো, সেন্সরশীপ সেল পূর্নগঠনের পর যে মরতবা তারা আশা করেছিল নি তা যেন তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তারা সংবাদ প্রকাশ করতে দিচ্ছে না এবং পত্রিকাও বিরোধী কোন সংবাদ ছাপাচেছ না। কিন্তু ও পর্যন্তই। পৃথিবীর সবাই বলছে, পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্র এখন কারারুদ্ধ। পাকিস্তানের ঝান্ডাকে উচু রাখার জন্যে দুয়েকটি পত্রিকা ছাড়া আর কোন পত্রিকা স্বতঃপ্রবৃত হয়ে কিছু লিখছে না। বয়স্ক ফকিফোকড় গলিয়ে কিছু রিপোর্টিং স্টোরী বেরোচ্ছে যাতে নাকি ইংরেজিতে অনেক কথা বলা হচেছ। সংবাদপত্রকে ধরা যাচেছ না। তারা বলছে এগুলো সেন্সরশীপ হাউস থেকে পাস করা হয়েছে। মেজর সালেক একদিন সেন্সর শীপ হাউসের কয়েকজন কর্মীকে বললো,কুছ কুছ পাবলিক রিলেশন ভী তো করনে পরেঙ্গা। কিছু কিছু জনসংযোগের কাজতো আপনাদের করতে হবে। আরেকটি কথা, এমএলআর ৮৯ আপনাদের পুরোপুরি ইয়াদ রাখতে হবে । কর্মীদের মধ্যে থেকে একজন বললেন, আমাদের যে দায়িত দেয়া হয়েছে আমরা তা পালন করছ, কি’ত, জনসংযোগ আমরা করবো কি করে? উল্লেখযোগ্য একটি প্রসঙ্গ এখানে বলা দরকার। সামরিক বিধি আর প্রেস সেন্সরশীপের কঠিন নিগড়ে থেকেও সেন্সরশীপ হাউসের কর্মীরা (দুয়েকজন ছাড়া) বহু ফিচার স্টোরী, নিউজ স্টোরী এবং অন্যান্য সংবাদ কঠিন ঝুকি কাধে নিয়ে অনুমোদন করে দিয়েছেন, যেসব স্টোরীতে পরোক্ষভাবে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে সমন্যত্র রাখা এবং সংগ্রামে সাফল্যের ইঙ্গিত রয়েছে। দেশের সার্বিক স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে এটা হয়তো কিছু নয়, কিন্তু তখন অবরোধ পরিবেশে এই সাফল্য ইঙ্গিতের সুযোগ দেয়া এবং ইঙ্গিত দেয়াটিই অনেক বড় বলে মনে হতো। মনে হতো– আমাদের প্রতিবাদ ও সংগমের কণ্ঠস্বর এখনো স্তব্ধ হয়নি। জুলাই পরবর্তী সময়ের প্রেস এডভাইস প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে রাখা দরকার। এর আগে প্রেস এডভাইস টেলিফোনে আসতো, তা আমাদের মোঁখ নিয়ে দেয়া হতো (অন্তত আমাদের অফিসে—দেনিক পাকিস্তানে) । কপি অনুমোদনের জানা পাঠাতে হতো পিআইডি দফতরেপ্রেস এডভাইস পাঠাতে মেজর সালেক ও পিআইডির ভারপ্রাপ্ত এ কী। জুলাই মাস থেকে দেখাতে পেলাম, প্রেস এডভাইসগুলোর পেয়েছি তা ছিল প্রধানত হানাদার কবলিত পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রিক হানাদার শাসকগোষ্ঠীর প্রার্থিত ও প্রদত্ত অধিকাংশ খবরই সংবাদপত্রগুলোতে পরিবেশন করা হতো সরকার। নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা তৎকালীন এপিপির মাধ্যমে। সংবাদ সংস্থার খবর মানেই অননুমোদিত সংবাদ । সেন্সর সকর্তারা পত্রিকাকে বলতো ওসব খবর ভালো করে ছাপাও। প্রমিনেন্ট হেডিং দাও ইত্যাদি। } থেকৈড়া নির্দেশ আসতো.. { পশ্চিম পাকিস্তানী, পত্রিকার এসব খবর পরিহার করাই ভালো। এতেও যখন কাজ হলো না, তখন ১৩ই জুলাই প্রেস এডভাইস এলো— পশ্চিম পাকিস্তানী পত্রিকার কোন খবর সেন্সর কতপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ছাপা যাবে না। জুলাই মাসে প্রর্বতিত সেন্সর কার্যকমকে আবার নতুন করে বিন্যাসের ব্যাপরে চিন্তাভাবনা শুরু হলো। সেন্সর হাউসের কর্মকর্তা রিপোর্ট দিলেন, সেলের কর্মীদের উপর পুরোপুরি বিবাস স্থাপন করা যাচ্ছে না। অতঃপর তৃতীয় পর্যায়। অক্টোবর মাস নাগাদ (কিছু আগে পরে হতে পারে, সঠিক তারিখ বলতে পারছি না) সেন্সর হাউসের খবরদারীর জন্যে পিণ্ডি থেকে ঢাকায় এলো পাকিস্তান সরকারের চীফ প্রেস এডভাইসার আমানুল্লাহ সরদার। ঢাকায় সরদার সাহেব থেকে গেলেন তার দায়িত সম্পাদনের জন্যে। তার কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রণালয় আরো দুজনকে পাঠালেন। এদের একজন হলেন কম্যান্ডার জামিল, অপরজন এহসানুল হক। কম্যান্ডার জামিলের জন্মস্থান ছিল ভারতের যুক্ত প্রদেশ এবং এহসানুল হকের ছিল পূর্ব পাঞ্জাব। কিন্তু পরে এই দুজনকে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়া হলো। হানাদার শাসকরা সন্দেহ করছিল, এই দুজন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছেন। জুলাই (তিন) থেকে ডিসেম্বরে প্রদত্ত কতিপয় প্রেস এডভাইসের ভাষ্য নীচে তুলে দিচ্ছি— ১০ই জুলাই, ১৯৭১ রাওয়ালপিন্ডি থেকে নাথিয়াগলি গমনকারী হেলিকপ্টার সংক্রান্ত কোন খবর পত্রিকায় ছাপা যাবে না । ১৩ই জুলাই, ১৯৭১। ১। রাজনৈতিক নেতৃবন্দের ৩(ক) অান্তঃআরব সংঘর্ষ সম্পর্কে কোন খবর ছাপা যাবে না, (খ) মরক্কোর বাদশাহর বিরদ্ধে কোন খবর ছাপা যাবে না। ৪। পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে যে খবর প্রকাশিত হচেছ তা পুনঃ মুদ্রণের ব্যাপারেও আগে অনুমতি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর মানেই—পব পাকিস্তানের জন্যে অটোমেটিক্যালি ক্লিয়ারড নয়। ৫। কাউকে চাবকানো হচেছ অথবা ফাসিতে ঝোলানো হয়েছে এ ধরনের ভীতি উদ্রেককারী কোন ছবি তা দেশী হোক কিবা বিদেশী হোক— পত্রিকায় ছাপানো যাবে না। ৬। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট রাজী আছেন অথবা পূর্ব পাকিস্তানে অভ্যধনা কেন্দ্রসমূহে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক গ্রহণে তিনি সম্মত এ ধরনের কোন খবর ছাপা যাবে না। ১৯শে জুলাই, ১৯৭১। বিস্ফোরণের খবর ছাপা যাবে না। কোন ছবি যাবে না। সরকার প্রদত্ত খবর ও ছবি ছাড়া (যদি প্রদান করা হয়) এ সম্পর্কে অন্য কোন খবর বা ছবি ছাপা যাবে । এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্যায়ে আরো বিস্তত ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য জানানো হবে। জুলাই, ১৯৭১ ‘সঠিক তারিখটি আমার ডায়েরীতে লেখা নেই, তবে এটা জুলাই মাসে দেয়া হয়) ঃ আগে ‘তথাকথিত’ লিখেও অর্থাৎ উল্লেখ করেও এখন থেকে নিম্নলিখিত শব্দগলো লেখা যাবে না—মুক্তিফৌজ, মুক্তিবাহিনী, গণবাহিনী।
(অস্পষ্ট)
(চার) প্রেস এডভাইসগুলো ছিল নানা জাতের। যেমন, (১) কখনো প্রেস এডভাইস আসতো আগাম। তাতে বলা হতো এইএই ধরনের কোন সংবাদ দেয়া যাবে । (২) কখনো প্রেস এডভাইস আসতো কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। বলা হতো, ও ধরনের কোন সংবাদ পত্রিকায় ছাপা যাবে না। (৩) কখনো প্রেস এডভাইস আসতো পত্রিকায় কেন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর। বলা হতো, এ ধরনের কোন সংবাদ পত্রিকায় আর দেয়া যাবে না । (৪) কখনো এমন সব প্রেস এডভাইস আসতো যার শানে নুজুল উদ্ধার করাই ছিল দূরুহ, কখনো এমন সব প্রেস এডভাইস আসতো যার সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা প্রবাহের সংযোগ নেই, (৫) কখনো এমন কোন সংবাদের ব্যাপারে প্রেস এডভাইস এসেছে, যা পরবর্তী পর্যায়ে সাড়া জাগানো। আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়েছে। আবার এমনও দেখা গেছে, এই পত্রিকায় এমন এক প্রেস এডভাইস পাঠানো হয়েছে যা অন্যকোন পত্রিকায় দেয়া হয়নি। জুলাই-ডিসেম্বরে প্রদত্ত হানাদার পাক শাসকদের প্রেস এডভাইসের কয়েকটি সম্পর্কে আমি সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি। জুলাই মাসে প্রথম যে প্রেস এডভাইসের ভাষ্যটি লিখিতভাবে বার্তা বিভাগের টেবিলে রাখা হলো তা ছিল । ‘আজ রাওয়ালপিন্ডি থেকে নাথিয়াগলি গমনকারী হেলি কপ্টার সংক্রান্ত কোন খবর পত্রিকায় ছাপা যাবে না—১০ই জুলাই, ১৯৭১। বার্তাবিভাগের টেবিলে প্রেস এডভাইসটি দেখে প্রথমে আমরা হতবুদ্ধি। পিন্ডি-নথিয়াগলি কি হলো ? কিসিঞ্জার সাহেবের কোন ব্যাপার নয়তো? আজকের কাগজেই খবর বেরিয়েছে, কিসিঞ্জার সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, বিশ্রামের জন্যে তিনি পিন্ডি থেকে নাথিয়াগলি গেছেন। তবে কি কিসিঞ্জার সাহেব……..? শুরু হলো পত্রিকার অফিসে অফিসে জল্পনা কল্পনা। এত দিন আমরা যেসব প্রেস এডভাইস পেয়েছি তা ছিল প্রধানত হানাদার কবলিত পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রিক। হানাদার শাসকগোষ্ঠীর প্রার্থিত ও প্রদত্ত অধিকাংশ খবরই সংবাদপত্রগলোতে পরিবেশন করা হতো সরকার। নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা তৎকালীন এপিপি’র মাধ্যমে। সংবাদ সংস্থার। খবর মানেই অননুমোদিত সংবাদ। সেন্সর কর্তারা পত্রিকাকে বলতো সব খবর ভালো করে ছাপাও। প্রমিনেন্ট হেডিং দাও ইত্যাদি। এছাড়া নির্দেশ আসতো, নরম্যালসি’র উপর ভালো ভালো খবর ও ছবি ছাপাও ; শান্তি কমিটির অমক অমক নেতার খবরটি প্রমিনেন্ট করো; কর্তৃপক্ষ অমক অনুষ্ঠানের ভালো। কভারেজ আশা করেছেন; অমুক তমুক খবর ছাপা যাবে না ইত্যাদি। সর্বোপরি সেন্সরশীপ হাউসে পাশ করিয়ে নেয়ার জন্যে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, অন্যান্য নিবন্ধ পাঠানো হচেছ। এমনি সময়ে এলো পিন্ডিনাথিয়াগলি সংকত প্রেস এডভাইস। সংগত কারণেই পত্রিকা অফিসগুলোতে জল্পনা-কল্পনার তুমুল ঝড় উঠলো, তার পরিসমাপ্তি হলো ১৫ই জুলাই, সারা পৃথিবীকে চমকে দেয়ার মতো একটি খবরের মাধ্যমে । ১০ই জুলাই’র এই প্রেস এডভাইসটি আগপিছ, ব্যাপক ঘটনা ও বিস্তৃত, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সংশ্লিষ্ট ছিল—সে কারণেই এই প্রেস এডভাইসটির মানে নজল সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে বলা প্রয়োজন। ২রা জুলাই ঢাকার সংবাদপত্রে রয়টার পরিবেশিত একটি খবর প্রকাশিত হলো। ওয়াশিংটন ডেটলাইনের পয়লা জুলাইর খবর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর হেনরী কিসিঞ্জার তাঁকে ছাড়া পাঁচ সদস্যের একটি সরেজমিনে তদন্তের মিশন নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানের সফরের উদ্দেশ্যে আজ ওয়াশিংটন ত্যাগ করছেন। ওয়াশিংটন ফেরার পথে ডক্টর কিসিঞ্জার প্যারিস যাবেন। সেখানে তিনি ভিয়েতনাম শান্তি আলোচনায় নিয়োজিত মিঃ ডেভিড বসের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। ১২ই জুলাইয়ের মধ্যে দেশে ফিরে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সানলিমেন্টে অবস্থিত (অস্পষ্ট) IMPORTANT NOTICE (NOT FOR PUBLICATION) PRESS ADVICE SYSTEM INTRODUCED The Defence of Pakistan Rules, 1971, which never come into force, prohibit certain prejudicial acts, publication and communitions in order to deny the enemy Information likely to assist him. These rules are obligatory and have to be followed by all. For the convenience of the Press, which has a vital role to play in the prosecution of War, the Government of Pakistan have decided to introduce a system of Press Advice. Arrangements for Press Advice have been made at the headquarters of the Central Government, Provincies Governments and each district, of which the Press should taka full advantage. (AMANULLA SARDAR) CIS Chief Press Adviser to the Government of Pakistan, Press Information Department Rawalpindi. 25-11-71.
To, (1) All Newspaper Editors in Pakistan. (2) All accredited Pakistani Correspondents/ through Ly.Chief Press Advisers.
ধ্বংস করছে কারা
কষ্ট পাচ্ছে কারা
পুল ধ্বংস করে মানুষ ও পণ্য চলাচলে বিঘ্ন ঘটালে কষ্ট পাবে কারা?-জনসাধারণ। রেল রাস্তা উড়িয়ে দিয়ে মানুষ ও খাদ্য চলাচল বন্ধ করলে মারা পড়বে কারা? জনসাধারণ বিদ্যুৎ সরবরাহ নষ্ট করে কলকারখানা বন্ধ করলে এবং শ্রমিকরা কাজ না পেলে কষ্টে পড়বে কারা ?—জনসাধারণ আর
এই সব কষ্টের জন্য দায়ী কারা ?—ভারত ও তার দালালরা। এ সব দুষ্কার্যের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণই কষ্ট পাবে। অতএব, জনসাধারণের নিজেদের স্বার্থেই এই সব দুষ্কার্য রোধ করা প্রয়োজন। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর পুনর্বাসন কার্যসহ দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতা পুর্নোদমে চালু করার জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা মঞ্জুর করেছেন। আসুন, এ সকল কার্যে আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে সক্রিয়ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করি। হিন্দুস্থান ও হিন্দুস্থানী দালালরা আমাদের ধংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজে, পূর্ণ সহযোগিতার দ্বারাই আমরা তাদের এই দুরভিসন্ধি বানচাল করব।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1973.12.18-bichitra-1.pdf” title=”1973.12.18 bichitra”]