You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বেরুবাড়ী

মেজর মোহাম্মদ শামসুল হক

১৯৭১। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এবং অতীব গৌরবোজ্জ্বল একটি বছর। একটি মহিমাজ্জ্বল অধ্যায়। একটি হিরন্ময় মাইলফলক। বহুদিন থেকে বাঙালি জাতি স্বাধীকারের আন্দোলনে দুর্বার গতিতে দুর্মর আবেগ নিয়ে এগিয়ে চলেছিল। আর উনিশশ’ একাত্তরেই তারা সশস্ত্র সংগ্রাম করে তাদের বিজয়ের লাল সূর্যকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বাঙালি জাতি তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন ও সাধনা নিয়মতান্ত্রিক পথে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭০ এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও অধিকার পেল না। বাঙালি জাতিকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খান সুপরিকল্পিতভাবে ১৯৭১ এর পঁচিশে মার্চের কাল রাতে ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর চালিয়ে দিল ট্যাংক, কামান। মেশিন গানের গুলীতে নৃশংসভাবে হত্যা করলো নিরীহ নিরস্ত্র লাখো বাঙ্গালি নারী, পুরুষ শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে। ফলশ্রুতিতে তৎকালিন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং অংশগ্রহণ করে মুক্তি সংগ্রামে। পরবর্তীকালে যথাসময়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমানের সগ্রামী আহবানে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন ই বি আর, ই পি আর, পুলিশ, ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যবৃন্দ। শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমিও অন্যান্য ছাত্রযুবকের ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় পাঠত্যাগ করে মসি ছেড়ে অসি ধরলাম হয়ে গেলাম মুক্তিযোদ্ধা। স্বজন ও সংসার পরিত্যাগ করে পাড়ি জমালাম সীমান্তের অপর পারে। গ্রাম গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে তখন হিংস্র হানাদার বাহিনী। তারা মেরে পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে বাড়িঘর মসজিদ মন্দির। এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত আট মাসে পাটেশ্বরীর যুদ্ধ, রায়গঞ্জের যুদ্ধ, জয় মনিরহাটের যুদ্ধ, সোনারহাটের যুদ্ধের মাঝদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত পিচ্ছিল বহু পথ পেরিয়ে এসেছি। “দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানাছলে। অশান্তির ঘুর্ণি সয়েছি জীবন স্রোতের পলে পলে। “ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী এলাকায় তখন তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধ আর যুদ্ধ। যুদ্ধই তখন আমাদের স্বর্গ, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের জীবন-মৃত্যু। রাতের বিদ্রি রজনীতে আকাশের গায়ে আমরা তখন কামানের গোলা আর মেশিনগানের গুলির আলোর ফোয়ারা দেখছি। গোলাগুলির শব্দের মাঝেই নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছি গুলি থেমে গেলে যেন হারিয়ে গিয়েছি। এমনি ভয়ঙ্কর আনন্দময় চলার পথে ছয় নম্বর সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম কে বাশার এবং সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজ উদ্দিন আমাকে ডেকে আমার কোম্পানি নিয়ে আরো সম্মুখ পানে অগ্রাভিযান চালাবার আদেশ দিলেন। সেদিন ছিল ১৯৭১ এর ১৭ নভেম্বর। সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার আমাকে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই শুনে থাকবে খুব শীঘ্রই আমরা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা-নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলার দাঁত ভাংগা জবাব দিতে যাচ্ছি। বিভিন্ন কোম্পানিকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তোমার কোম্পানির দীর্ঘদিনের সংসাহসিকতাপূর্ণ তৎপরতায় আমি সন্তুষ্ট তাই আমি তোমার কোম্পানিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দায়িত্ব দিচ্ছি। অপারেশনাল ম্যাপ দেখিয়ে বললেন, তোমার কোম্পানি নাগেশ্বরীর ঠিক পূর্বপার্শ্বেই অবস্থান নিয়ে শত্রুদের উপর আঘাত হানবে। মনে রেখো নাগেশ্বরীতে পাকহানাদার বাহিনীর ঘাঁটি মজবুত। আক্রমণ হেনে তাদের ঘাঁটি গুড়িয়ে দিতে হবে। আদেশ বুঝে নিয়ে কোম্পানি হেডকোয়ার্টার সোনারহাটে ফিরে এলাম। আমার কোম্পানি অধিনায়ক ইরফান আলী খান এবং মাহফুজুর রহমান কে বুঝিয়ে বললাম। বলা বাঞ্ছনীয় আমার কোম্পানিতে তখন কোম্পানি প্লাস মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমার সহযোগিতার জন্য উপ অধিনায়ক ছিলেন দুইজন। আদেশ অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর রাত আটটার মধ্যেই আমরা দুধকুমার নদীর পূর্বপারে আমাদের কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলাম এবং পরবর্তী অভিযান সম্বন্ধে কিঞ্চিত আভাস দিয়ে বড় আকারের কয়েকটি নৌকা সংগ্রহের আদেশ দিলাম। স্থানীয় কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা খয়বর, রফিক, কাশেম ও অন্যান্য কয়েকজনকে নৌকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হলো। রাত সাড়ে দশটার মধ্যেই তারা বড় বড় পাঁচটি ছই বাঁধা নৌকা এনে হেলডাঙ্গা ঘাটে ভিড়িয়ে দিল। তখন পাঁচটি প্লাটুন চার নৌকায় তুলে আমিও একটিতে চড়ে বসলাম। আমার সংগে থাকলেন আমার কোম্পানি উপ অধিনায়ক মাহফুজুর রহমান ও ইরফান আলী খান। বলা বাঞ্ছনীয় আমীর আলী খান ও ইরফান আলী খান দিনাজপুরের ছেলে এবং সহোদর। ১৮/১৯ নভেম্বর রাত ১২ টায় আমরা নৌকা ছাড়লাম। আধ মাইল দূরত্ব রেখে ভাটির টানে নৌকা ছুটে চললো বেরুবাড়ী অভিমুখে। ঘন্টা তিনেক চলার পর আমার গাইড আমাকে বললো ডান পার্শ্বেই চরবেরুবাড়ী। তখন পেন্সিল টর্চ মেরে ঘড়ির দিকে দেখলাম রাত তিনটা বাজে। নদীর ডান তীরে নৌকা ভিড়াতে আদেশ দিলাম। তারপর চারটি নৌকা একত্রিত হওয়ার পর আমরা নৌকা থেকে অবতরণ করলাম। নদীর তীর থেকে প্রায় দুইশতগজ পায়ে হেঁটে বেরুবাড়ী গ্রামে পৌছালাম। হাড় কাঁপানো শীত। নভেম্বর মাস মাত্র পবিত্র রমযানের শেষ দিন। গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সেহরি খেয়ে বাড়ির লোকজন আগুন জ্বালিয়ে হাত পা সেঁকছে। অকস্মাৎ আমাদেরকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। প্রথমত তারা আমাদেরকে রাজাকার ভেবে বলেই ফেললো, এখনইতো আপনাদের লোক পেট্রোল করে গেল। পরে জানতে পারলাম তারা পাকহানাদার বাহিনী। তখন আমি জানালাম আমরা রাজাকার নই মুক্তিযোদ্ধা। একথা শুনে আরো ঘাবড়ে গিয়ে বললো, হায় আল্লাহ! আপনারা এসেছেন জানলেতো আর আমাদের রক্ষা নেই। এক্ষুণি পাক বাহিনী এসে পড়বে। আমি অভয় দিয়ে বললাম, আপনারা ভয় পাবেন না আমাদের সাথে থাকেন আমরা দেখবো ইনশাল্লাহ। তারপর কোম্পানি উপ অধিনায়ক মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন প্যাট্রলিং এ পাঠালাম নাগেশ্বরী অভিমুখে। ১৯ নভেম্বর সকাল বেলায় সূর্য উঁকি দিচ্ছে কুয়াশার আবরণ ভেদ করে। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাক কাক কা কা করে উড়ে গেল। কি যেন এক অশনি সংকেত দিয়ে গেল তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পশ্চিম দিকে গুলি বিনিময় শুরু হলো। ঘাঁটিতে সবাইকে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হতে বললাম। এমন সময় উত্তর পার্শ্বের গ্রাম থেকে ১০/১২ বছরের একটি বালক দৌড়ে এসে বললো, “গ্রামের উত্তর দিক দিয়ে পাক সেনারা এই দিকে আসছে”। সংগে সংগে পেট্রোল পার্টি পাঠালাম। গ্রামের উত্তর দিকে যেতে না যেতেই মুখোমুখি গুলি বিনিময় শুরু হয়ে গেল। তখন দক্ষিণ দিকে আরেকটি প্লাটুন পাঠালাম, সে দিকেও একই অবস্থা। তিন দিকেই তিনটি প্লাটুন সম্মুখ যুদ্ধে ফেঁসে গেল। ভাবলাম যদি নদী পথ শত্রু মুক্ত রাখতে না পারি তাহলে সদলবলে মৃত্যু অনিবার্য। কারণ আমাদের কাছে তখন না ছিল মেশিন গান না ছিল মর্টার কিংবা রকেট লাঞ্চার। পাক সেনাদের পক্ষ থেকে আসছিল কামানের ভারী গোলা, রকেট শেলিং এবং মেশিন গানের ঝাঁকে ঝাঁকে ফায়ার। নদীর ওপার থেকে সাপোর্ট ফায়ার দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি ঘাঁটি ত্যাগ করে আমার ব্যক্তিগত হাতিয়ার সাবমেশিন কার্বইনটি ও গুলীভর্তি দুইটি ম্যাগজিন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখন তিন দিকেই তুমুল যুদ্ধ চলছিল পাকসেনাদের সাথে আমার মুক্তি বাহিনীর অকুতোভয় গেরিলাদের। আমার গেরিলারা গুলি করতে করতে পিছিয়ে নদীর দিকে আসছিল। অপর দিকে পাকসেনারা গুলি করতে করতে তিন দিক থেকে নদীর পথ বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে নদীর দিকে এগুচ্ছিল। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল যে, কোনরূপে তিন দিক থেকে ওরা ঘেরাও করে ফেললে আমাদের পরাজয় যেন অনিবার্য। শক্রব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করে “জয় বাংলা” বলে| সাঁতার দিলাম খরস্রোতা দুধকুমার নদীতে। সাঁতার কেটে পূর্ব পাড়ে উঠে একটি কলার বাগানে গা ঢাকা দিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ের দিকে সাবমেশিন কার্বাইনের সাহায্যে গুলি চালালাম। কখনো সিংগেল ফায়ার কখনো অটোমেটিক ফায়ার। সংগে সংগেই কাজ হলো। শত্রু সেনারা এপার থেকে ফায়ারের আওয়াজ পেয়ে পশ্চাৎ অপসারণ করতে শুরু করলো। সেই সুযোগে আমার মুক্তি সেনারা নদীর দিকে বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু পিছন থেকে আসছিল কামান আর মেশিনগানের প্রচণ্ড গোলাগুলী। কামানের ভারী গোলা এসে পড়ছিল গগন বিদারী আওয়াজ করে। একটানা প্রায় পাঁচ ঘন্টা উভয় পক্ষের ব্যাপক হতাহতের পর আমাদের মুক্তি সেনারা যার যার মতো নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে হাতিয়ার পানিতে ছেড়ে দিয়ে সাঁতরাচ্ছিল। অপর দিকে শত্রু পক্ষের কামান আর মেশিনগানের গোলাগুলি এসে নদীর পানিতেই আঘাত হানছিল। কিছু আবার এপারেও এসে পড়ছিল। মুক্তি সেনারা অনেকেই সাঁতরিয়ে তীরে উঠতে সক্ষম হলো অনেকেই ভাসতে ভাসতে চলে গেল। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমার জানা সম্ভব হলো না কে কুল পেলো আর কে দুধকুমারের অথৈ জলে চিরতরে হারিয়ে গেল। অপরদিকে পাকসেনারা নদীর ওপারের সেই বেরুবাড়ী গ্রামটি থেকে প্রায় ২০/২৫ জন নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে স্কুলের মাঠে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করলো এবং জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দিল চর বেরুবাড়ী গ্রামটি। গ্রামের মসজিদটিও বর্বরদের হাত থেকে রেহাই পেলো না। সেই দিন আমার সম্মুখেই শত্রুসেনারা যে ভাবে চর বেরুবাড়ী গ্রামের নিরীহ নিরস্ত্র নর-নারীকে নৃশংসভাবে ব্রাশ ফায়ার দিয়ে হত্যা করেছিল সেদৃশ্য আমি কোনো দিনই ভুলতে পারব না। আজও আমার চোখের সম্মুখে ভাসে চর বেরুবাড়ীর গ্রামের সেই লেলিহান শিখা এবং কানে ভাসে সেই প্রবীণ ব্যক্তিটির উক্তি “আপনারা এসেছেন জানতে পারলে পাক সেনারা আমাদের মেরে ও পুড়ে ভস্মীভূত করে দেবে”। সত্যি সেদিন ইয়াহিয়া খাঁ আর টিক্কা খার বাহিনীর হাত থেকে যেমন রক্ষা পায়নি অসহায় নারী-শিশু ঠিক তেমনি মসজিদ মন্দিরও। সন্ধ্যায় অন্ধকারে কয়েকজন হাতিয়ার হারানো মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পেলাম। অতঃপর গ্রামের কিছু লোককে নিয়ে নদীতে ডুবে কিছু হাতিয়ার উদ্ধার করলাম। পরদিন ২০ নভেম্বর ১৯৭১। রমজানের ঈদ। হৃদয় ভরা বেদনা দিয়ে ঈদের চাঁদকে এবারের মতো বিদায় জানিয়ে আমার হারিয়ে যাওয়া সূর্য সৈনিকদেরকে খুঁজতে থাকলাম। খুঁজতে খুঁজতে বহুভাটিতে এক চরে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বশির ও সামাদের লাশ পাওয়া গেল। সেই চরে তাদের মরদেহ সমাহিত করা হলো। তারপর যুদ্ধ বিধ্বস্ত চর বেরুবাড়ীতে পাওয়া গেল আরো তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ। পাওয়া গেল আমার ব্যাগ বহনকারী বালকটিকে। দেশ স্বাধীন হলে লেখা পড়া করে যে মানুষ হতে চেয়েছিল সে লাশ হয়ে পড়েছিল কাশবনের মাঝে। ওর হাতে ধরা ছিল আমার ব্যাগটি। যাতে থাকতো আমার নোট বই ও কোম্পানির জন্য আনা রেশন মানি। চর বেরুবাড়ীর প্রাণে বেঁচে যাওয়া কয়েকজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁরা পাকবাহিনীকে ২০/২৫টি লাশ নিয়ে যেতে দেখেছে। আহত দেখেছে ৫০/৬০ জনের মতো। সকাল বেলা খবর পেয়ে বুক ভরা শুভেচ্ছা নিয়ে এগিয়ে এলেন কচাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মি. রুস্তম আলী। আমাকে জীবিত পাওয়ার আনন্দে বুকে | জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। কারণ তার সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ও গভীর বন্ধুত্ব ছিল। বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে তিনি এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। ২১ নভেম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে সাক্ষাৎ করে জানলাম, আমার পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, ১৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন এবং ৩০টি হাতিয়ার নদীতে হারিয়ে গেছে। অপর দিকে শত্রুপক্ষের কমপক্ষে ২৫ জন নিহত, আহত পঞ্চাশের উর্ধে। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন “হাতিয়ার যা লাগে আমি দেব, তোমার সৈনিক তুমি খুঁজে বের কর”। তারপর খোজ খবর নিয়ে জানলাম ফুলবাড়ি, বালারহাট এলাকার কিছু মুক্তিযোদ্ধা চলে গেছে দিনহাটায় তাদের আপনজনের কাছে। অতঃপর আমি তোক পাঠিয়ে, তাদেরকে অতিসত্ত্বর ফিরে এসে কোম্পানিতে যোগদানের অনুরোধ জানালাম। খবর পেয়ে ওরা সাবসেক্টর হেডকোয়ার্টারে সাহেবগঞ্জে ফিরে এল। তার সাথে আরও জনা পঞ্চাশেক নতুন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাসহ এক কোম্পানির উর্দ্ধে জনবল নিয়ে আমি পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। সেই দুর্দিনে আমাকে সার্বক্ষণিক বন্ধুত্ব ও সাহচর্য দিয়েছিলেন রুস্তম সাহেব ও চর রহমানের কুটি স্কুলের শিক্ষক আজিজুর রহমান সাহেব। মতিউর রহমান মেম্বার সাহেব আমার কোম্পানিকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাইয়েছেন, অপারেশনে সহযোগিতা করেছেন। এদেশের স্বাধীনতায় এদের সবার কাছেই আমরা সমান ঋণী। এদের সাহায্য সহযোগিতা না পেলে দেশের ভিতরে এসে শক্ত ঘাঁটিতে হানা দেয়া আমাদের পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব হতো না। অতি সাম্প্রতিক কালে চর বেরুবাড়ীতে যোগাযোগ করে জেনেছি, যে ছেলেটি পাক হানাদারদের আগমনের সংবাদ দিয়েছিল তার নাম ‘এলাহী বখশ’ (১২) পিতার নাম গুইটা মুন্সি। পাক সেনারা সেই দিনই নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করেছিল। বন্দি বাংলাদেশের মাঝে শত্রু কবলিত মৃত্যু গুহায় থেকে ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কি পরিমাণ দরদ এদেশের মানুষের বুকে ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ সেই দিনের সেই শহীদ বালক ‘এলাহী বখশ’ ও তার মা-বাবা। বলা বাঞ্ছনীয়, আমার কোম্পানির একগাদা মাইন ও একুসিভসহ যে নৌকাটি পেছনে রেখে এসেছিলাম সেইটিও নদী পথে আসার সময় শত্রুর আক্রমণে পড়েছিল। যাত্রা বিঘ্নিত হলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সেদিন যুদ্ধে আমাদের হাল্কা মেশিন গান, মর্টার ও রকেট লঞ্চারগুলো পেছনে রেখে আসায় আমরা যুদ্ধ মুহূর্তে কাভারিং ফায়ার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। ফলশ্রুতিতে শত্রুসেনারা আমাদেরকে অতি সহজেই তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। উপরন্তু যথারীতি রেকি করে ঐ এলাকায় ও শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে অগ্রিম না জেনে আধুনিকতর অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত। শত্রুসেনাদের মুখখামুখি সরাসরি নদীর পশ্চিম পাড়ে অবতরণ করা আমাদের উচিত হয়নি। আমাদের উচিত ছিল নদীর পূর্বপাড়ে নেমে সেখান থেকে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করা এবং বিপদ কালের জন্য নদীর পশ্চিম তীরে অন্ততপক্ষে একটি নৌকা প্রস্তুত রাখা। একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও ভয় ও বিস্ময়ে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেদিন সময়মতো যেভাবে ক্ষুদ্র একটি সাবমেশিন কার্বাইনের ফাঁকা ফায়ার দিয়ে নদীর অপর পার থেকে শত শত শত্রু সেনাকে ঘাবড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম তা অনেক সময় জনবল ও অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সম্ভব হয়ে উঠে না।

মেজর মোহাম্মদ শামসুল হক জন্ম : ২ জুলাই ১৯৪৯, কুড়িগ্রাম। শিক্ষা: ফরকেট কেরামতিয়া হাই স্কুল, কুড়িগ্রাম এবং কারমাইকেল কলেজ, রংপুর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স এবং মাস্টার্স। বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা শেষে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আর্মি এডুকেশন কোর-এ যোগদান। ২০০১ সালে বয়সের কারণে অবসর গ্রহণ। মুক্তি সংগ্রামে কুড়িগ্রাম সহ মোট প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩টি।

রেফারেন্স – স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!