ক্যাপ্টেন আমাকে ১ ঘণ্টার মধ্যে ১০০ হিন্দু ধরে আনতে নির্দেশ দেয়।
ক্যাপ্টেন সব শুনে বললেন তােমার বাঙ্গালীরাই তােমার শত্রু আমরা কি করবাে। তারাই তােমার বিরুদ্ধে বলেছে।
জানা যায়, তখন অনেক প্রশাসক পাকসৈন্যদের নৃশংস হামলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকদেরকে নানাভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করেছেন। উদাহরণত, সাবেক বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা দীনেশ চন্দ্র দেবনাথ, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি যখন সাবজজ পদে রংপুর জেলায় কর্মরত ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় চরদের নিয়মিত প্রকাশ্য-গােপন হুমকির মধ্যে প্রতিনিয়ত জীবন হারানাের শঙ্কায় দিনাতিপাত করেছিলেন, তখন রংপুর সদরের এসডিও এবং স্বয়ং জেলা প্রশাসক১৩ তাকে বারবার সতর্ক করেছিলেন এই মর্মে যে, সাব-জজ হলেও তিনি যেহেতু হিন্দু এবং পাকসৈন্যদের হত্যাযজ্ঞের প্রথম ‘টার্গেট’, সেহেতু প্রাণ বাঁচাতে তিনি যেন সপরিবারে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। স্বপ্রণীত কতকথা কত স্মৃতি গ্রন্থে দীনেশবাবু উল্লেখ করেছেন: “প্রতি সন্ধ্যায়ই কিছুক্ষণ এস, ডি, ও (নাম খন্দকার শরীফ উল ইসলাম) সাহেবের সঙ্গে একান্তে আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা হয়। তিনি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং পরম হিতৈষী। প্রতিদিন কোথায় কি হয় না হয় সব খবরাখবর দেন। সবকথা শেষে এ কথাগুলােও মনে করিয়ে দেন, বলেন, ‘দাদা কাজটা ভালাে করলেন না। আপনে এ সাধারণ কথাটা বুঝেও কেন বুঝতে চান না যে আপনারা আর্মির এক নম্বর শত্রু, আর আওয়ামী লীগাররা দু-নম্বরে। রংপুর টাউনে একটিও উল্লেখযােগ্য হিন্দু ও নেই, এক এ্যাডভােকেট পাখী মৈত্র ছাড়া । পাখী বাবু আছে চলে যাওয়ার উপায় নেই বলে। অত্যধিক বয়স এবং মেদবহুল শরীরের কারণে তিনিও প্রায় চলৎ শক্তিহীন অবস্থায় একা বাসায় পড়ে আছেন। (ঐকে পরে পাকবাহিনী হত্যা করে) বৌদি আর কৃষ্ণাকে (দীনেশবাবুর কন্যা) সিতাই বর্ডারের কাছে রেখে এসেছেন (পাকবাহিনীর চাপে পরে তাদেরকেও তার কাছে আনতে হয়েছিল), ভালো করেছেন, এখনও সময় আছে আপনি চলে যান। ভাবছেন আপনি চলে গেলে আপনার ছেলে মেয়েরা ঢাকা থেকে যদি এখানে চলে আসে, তবে তাদের কি উপায় হবে। সে দায়িত্ব আমার, আপনি থাকলে যা করতেন, না থাকলেও আমি তাদের জন্য কম কিছু করবাে না। আমি বলেছিলাম স্থানীয় মুসলিম নেতারা যে আমাকে থাকতে বলেন, অভয় দেন। আর্মি অফিসার নাকি তাদের বলেছেন, আমার কোনাে ভাবনার কারণ নেই। স্থানীয় নেতাদের তাে আমার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল বলেই মনে হয়। তিনি বলেছিলেন স্থানীয় নেতারা সবাই আপনার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল এ-বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই, কিন্তু আর্মি অফিসাররা অনবরত বদলী হচ্ছেন। তাদের কে কবে কার কাছে কি বলেছিলেন তার উপর কি নির্ভর করা চলে? আর্মিদের সব মিটিংএ আমার যেতে হয়। তাদের পলিসি অনবরত বদলায়। আর্মির মেজাজ আমি যতটুকু বুঝি আপনার কিছুতেই এসব শােনা ভরসার উপর নির্ভর করে থাকা চলে না। আপনি যে রাতে একা বাসায় থাকেন এটাও এ সময়ে উচিত নয়। যে কোনাে রাতে বিপদ হতে পারে।”১৪
এখানে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সদর এসডিও নিজেও যে ব্যক্তিগতভাবে খুব নিরাপদে ছিলেন, তা মােটেও নয়। এসম্বন্ধে দীনেশবাবু লিখেছেন: “এস.ডি.ও, সাহেবের কথায় ও আচরণে মনে হতাে তিনি আওয়ামী লীগ এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ মিটিং (জেনারেল নিয়াজী পাবনা সদর মহকুমায় সমস্ত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানদের ডেকে যে মিটিং করেছিলেন তাতে এসডিও-ও উপস্থিত ছিলেন) করে এসে তিনি একেবারে মুষড়ে পরলেন। তিনি তখনও বাসায় একা, পরিবার খুলনায়, বাসায় আনতে সাহস পান না। আমাকে বলেছিলেন, দাদা আপনাকে কত করে বললাম চলে যান, গেলেন না; এখন ইচ্ছে করলেও আর যাওয়ার উপায় নেই। আল্লাই জানেন আমাদের ভাগ্যে কি আছে।” ১৫ যদিও সত্য যে, শেষপর্যন্ত দীনেশবাবুর পক্ষে আর দেশ ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি, তবে ইতােমধ্যে তাকে নামকা-ওয়াস্তে হলেও ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল পরে অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই স্বধর্মে ফিরে যান)। জানা যায়, এসডিও দীনেশবাবু তার পরিবারকে দেশত্যাগের জন্য যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের পরামর্শেই- তিনিই এসডিওকে বলেছিলেন দীনেশবাবুকে সতর্ক করতে, দীনেশবাবু যেটা পরে জানতে পারেন। তাঁর কথায়: “জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলাে আমার অফিসের কাছেই। তাদের আমার চেম্বারে একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলাম ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলােতে, পেয়ে গেলাম তাঁকে। তিনি আমাকে দেখে চমকে উঠলেন, বললেন, এখনও আপনি আছেন? এস.ডি.ও সাহেব কি আপনাকে কিছু বলেননি? বলেছেন, সবই বলেছেন, তবু যাওয়া হয়নি।”১৬ সিভিল সার্ভিস অফিসারদের এজাতীয় ভূমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ অষ্টম খণ্ডে বিধৃত টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালাম আজাদের আত্মজবানিসূত্রে জানা যায়: “১৬ই এপ্রিল টাঙ্গাইলের১৮ ডি, সি, জালাল আহমদ সাহেব এবং এস, পি, নুরুজ্জামান সাহেব আসেন লুঙ্গীপরা অবস্থায়। সব ঘটনা বলেন এবং ২/৩ দিন থাকেন আমার ওখানে গােপনে। ওঁদের বন্ধু ছিলেন টাঙ্গাইলের জনাব ‘আযম খান। ওঁর সাথে আলাপ করে ঠিক করা হয় কাজে যােগ দেয়ার। আযম খান গাড়ী নিয়ে এসে নিয়ে গেলেন। এই খবর পাক গােয়েন্দা বিভাগ জেনে ফেলে আযম খানের বাড়ী ঘিরে ফেলে। ওঁদের তিন জনকে ব্যাপক মারধাের করে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়। ঢাকাতে কয়েকদিন অত্যাচার করে জবানবন্দী নিয়ে তিন জনের জবানবন্দী এক হওয়ায় তারা ছাড়া পান। প্রতিটি ষ্টেটমেন্টে আমার কথা ছিল। এমনকি আযম খানকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম সেটিও পাক কর্তৃপক্ষের হাতে গিয়েছিলাে। আমি সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ওঁরা মুক্তি পেয়েছেন শুনে শান্তি পেলাম। ডি, সি, ও এস, পি, ৩০শে এপ্রিলের দিকে কাজে যােগ দেন।/ ১০ই মে ডি, সি’র ওখানে সভাতে পাক ক্যাপ্টেনের কথাগুলি বললেন। সভা শেষে ডি, সি, সাহেব গােপনে আমাকে ডেকে বললেন সাবধানে থেকো আর হিন্দুদেরকে বলাে সাবধানে থাকতে, পূজাগুলাে এখন বন্ধ রাখতে বলাে- বাচলে অনেক কিছু করতে পারবে। আমি সে মােতাবেক রাত ১০ টায় পৌছে সবাইকে ডেকে এ খবর দেই; তারা সেইমত সাবধানতা অবলম্বন করে।/ ভাের রাতে প্রচুর গুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়ীতে সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। দেখলাম পাক সেনারা তিন দিক থেকে নাগরপুর আক্রমণ করেছে-অত্যাচার চালাচ্ছে। আমরা গেলাম ক্যাপ্টেনের কাছে, ক্যাপ্টেন বললাে তুমিই সেই ম্যাজিস্ট্রেট যে জামুর্কীতে আমার বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা পাঠিয়েছিলে। তুমিইতাে গতকাল হিন্দুদেরকে পালিয়ে যেতে বলেছ। আমি চুপ থাকলাম। ক্যাপ্টেন আমাকে খুব গালাগালি করলাে, সে-ই কিছু কিছ হিন্দু ধরে এনে বেয়ােনেট চার্জ করতে লাগলাে। আমার খবর শুনে রাতেই অধিকাংশ হিন্দু পালিয়ে গিয়েছিলাে। ফলে বহু লােক সে দিন বেঁচে যায়।
ক্যাপ্টেন আমাকে ১ ঘণ্টা সময় দেয় যে এর মধ্যে ১০০ হিন্দু এনে দিতে হবে। নইলে একটি বুলেট তােমার জন্য বলেই এক চড় মারে। আমি এ্যাডামেন্ট হয়ে বেশ কথা কাটাকাটি করলে ক্যাপ্টেন নরম হয়ে আমাকে গাড়ী করে নিয়ে যায়। থানায় গিয়ে দেখলাম ৮/১০ জন নিরীহ লােককে হত্যা করার জন্য রেখেছে। আমি ওরা ঝাড়ুদার বলে ওদেরকে বাঁচাই। ডাঃ কাশেম (ডেন্টিষ্ট) এবং ম্যারেজ রেজিষ্টার আমার বিরুদ্ধে টিক্কা খাঁর কাছে দরখাস্ত করেছিলাে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করার। ঐ দিন পাক সেনারা সামনে যাদেরকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। থানায় যেতে গিয়ে রাস্তার বিভিন্ন স্থানে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। বাজার ঘাট, বাড়ী-ঘর সব ওরা লুট করে নেয়। আমাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন চলে যায়। আধ ঘণ্টা পরে ডেকে পাঠায়। যাওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন আমার বুকে রিভলবার ধরে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে মারধাের শুরু করে। সেখানে ২০/২৫ জন হিন্দু লােকদের শুইয়ে রেখেছে দেখলাম। চারদিকে সিপাইরা বেয়ােনেট উচিয়ে ঘিরে ধরলাে। আমার বিরুদ্ধে চার্জ দিলাে আমার বাড়ী থেকে নাকি ৬ রাউণ্ড গুলি ছুড়েছে পাক সেনাদের উপরে। অনেক কাকুতি করে ১ মিনিট বলবার সুযােগ পাই। বেশ কিছুক্ষণ পাকিস্তানের পক্ষে মিথ্যা-সত্য বলে ক্যাপ্টেনকে কনভিন্স করি। ক্যাপ্টেন সব শুনে দেখে আমার সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলে তােমার বাঙ্গালীরাই তােমার শত্রু আমরা কি করবাে। তারাই তােমার বিরুদ্ধে বলেছে। থানাতে গেলে ২৫/৩০ জনকে গুলি করার আদেশ দেয়। আমি বললাম এরা সবাই কৃষক এদের মেরে কি করবে? ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু মার দিয়ে দুই জন বাদে সবাইকে ছেড়ে দেয়। আমার বাড়ীর সবাই বেঁচে যায়। পাক সেনারা চলে গেলে আমি অজ্ঞান হয়ে পডি। কয়েক ঘণ্টা পর আমার জ্ঞান ফেরে। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে সেবার বেঁচে গেলাম।/ ২৮শে মে মুক্তিবাহিনী নাগরপুর আক্রমণ করে। আমার ওখানে ওয়ারলেস সেট ছিল সেটি নিয়ে যায়। কাশেম ডাক্তারকে (দালাল) ধরে হত্যা করে। ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার পালিয়ে যায়। আমি পালিয়ে টাঙ্গাইলে চলে যাই পাক সেনাদের ভয়ে। নারী ধর্ষণ, প্রজ্জ্বলন ধ্বংস পাক সেনারা করেছে।”
Reference: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা, কাবেদুল ইসলাম, pp. 134-137