সুবেদার খলিলুর রহমান সদরঘাট কাপড়ের বাজারের নীরব নিথর রাস্তা ধরে সদর ঘাট মিশনের চৌরাস্তার সম্মুখে সর্বত্র বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষের লাশ দেখে। নবাবপুরের দিকে অগ্রসর হলেন। সুবেদার খলিলুর রহমান এবং তার সাথী দু’জনের। কারাে গায়ে পুলিশের পােশাক ছিল না। তারা সাধারণ পােশাকে দায়িত্ব পালন। করছিলেন। কাপড়ের বাজারের চারিদিকে রূপমহল সিনেমা হলের সম্মুখে ও সর্বত্র বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষের ইতস্তত: ছড়ানো বীভৎস লাশ দেখতে পান, এর মধ্যে বহু যুবতী মেয়ের ক্ষত বিক্ষত লাশ ছিল। ১৯৭১ সালের মে মাস। রাজার বাগ পুলিশ লাইনে পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী পুলিশ এসে গেলে, পাঠান রিজার্ভ ইন্সপেক্টর কুকুরের মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলতে থাকে “যাও শালা লোগ শােয়ার কা বাচ্চা হামারা ব্যারাক ছােড়াে, হামারা আদমী আগিয়া শালা লােগ, ভাগ।” একথা বলার সাথে সাথে বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা পােশাক পরিচ্ছদ, আসবার পত্র সবকিছু ব্যারাকের বাইরে ফেলে বাঙ্গালী পুলিশদের বের করে দেয়। বাঙ্গালী পুলিশরা অসহায় এতিমের মত পােশাক পরিচ্ছদ কুড়িয়ে নিয়ে লাইনের আস্তাবলে, বারান্দায়, গাছের নিচে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজার বাগ পুলিশ লাইনে যােগদান করার পর সুবেদার খলিলুর রহমান দেখেছেন পাঞ্জাবী সেনারা মিলিটারী ট্রাকে ও জীপে করে প্রতিদিন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের, ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বালিকা, যুবতী মেয়ে। ও সুন্দরী রমনীদের ধরে আনতে থাকে। অধিকাংশ বালিকা, যুবতী মেয়ের হতে বই খাতা দেখা যেত। প্রতিটি মেয়ের মুখ মন্ডল ছিল বিষন্ন। বিমর্ষ ও বিপদময়। মিলিটারী জীপে ও ট্রাকে যখন এভাবে যুবতী মেয়েদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আনা হতাে, তখন পুলিশ লাইনে হৈ চৈ পড়ে যেত; পাঞ্জাবী, বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ জীভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সম্মুখে এসে মেয়েদের টেনে হেচড়িয়ে নামিয়ে নিয়ে তৎক্ষনাৎ দেহের পােশাক পরিচ্ছদ কাপড় চোপড় খুলে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে উলঙ্গ করে বাঙ্গালী পুলিশের সামনেই মাটিতে ফেলে কুকুরের মত ধর্ষণ করতাে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে সকল যুবতী মেয়েদের সারাদিন নির্বিচারে ধর্ষণ করার পর রাতে চালাতে অবিরাম নির্যাতন। বাঙ্গালী পুলিশরা কোয়ার্টারে এসে মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনে রাতে অকস্মাৎ সবাই ঘুম থেকে ছেলেমেয়ে সহ জেগে উঠতেন। সেই ভয়াল ও ভয়ঙ্কর চিৎকার কান্নার রােল ভেসে আসতাে বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, তােমাদের পায়ে পড়ি, আমাদের বাঁচাও, পানি দাও, এক ফোটা পানি দাও পানি পানি, পানি! হেড কোয়ার্টার অফিসের উপর তলায় বাঙ্গালী পুলিশদের প্রবেশ করা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। দিনের বেলায় পুলিশ লাইনে ব্যারাকের আওয়াজের জন্য উপরতলা থেকে নির্যাতনের বন্দীদের আওয়াজ শােনা যেত না। সন্ধ্যার পর বাঙ্গালী পুলিশ তাদের নির্দিষ্ট কোয়াটার থেকে তাদের আর্তনাদ শুনতে পেত। সন্ধ্যার পর পাক সেনারা বিভিন্ন প্রকারে বন্দীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যেত। আর লােহার রডের উপর ঝুলন্ত বালিকা যুবতী নারী ও রূপসী রমনীদের উপর চলতাে অবিরাম ধর্ষণ, নির্মম অত্যাচার। বন্দীদের হাহাকারে বাঙ্গালী পুলিশেরা অনেক সময় দিশেহারা হয়ে যেত। অনেক সময় প্রতিবাদ করতে চাইতাে। কিন্তু পাঞ্জাবী সৈন্য ও পাকিস্তানী পুলিশের তুলনায় বাঙ্গালী পুলিশদের শক্তি মােকাবিলা করার উপায় ছিল না।
Source: নরহত্যা ও নারী নির্যাতনের কড়চা ১৯৭১ – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
ছবিটি হবিগঞ্জের আঙ্গুরা খাতুনের। পাকিস্তানি আর্মি তার গ্রামে গেলে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে। সে আর কোনদিন ফিরে আসতে পারেনি। (প্রতীকী হিসেবে যুক্ত হল)