You dont have javascript enabled! Please enable it! 1962.07.08 | বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র | পল্টন | ৮ জুলাই ১৯৬২ - সংগ্রামের নোটবুক

পল্টনের বিশাল জনসভায় ভাষণ
৮ জুলাই ১৯৬২
পল্টন

ভায়েরা আমার, দীর্ঘ ৪ বছর পরে আবার পল্টন ময়দানে আপনাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। এই ৪ বছরের ব্যবধানে ও অনভ্যাসে বক্তৃতা ভুলিয়া গিয়াছি। সুতরাং আজ আর কী বক্তৃতা করিব। অনেক দিন পর দেখা হইলে একে অপরকে বলে কেমন আছেন? আপনারা বলিয়াছেন কেমন আছেন। আমিও বলিয়াছি কেমন আছেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ৪ বছরে দেশের অবস্থা কী হইয়াছে? দুর্নীতি ডাবল মার্চ করিয়া চলিয়াছে কিনা? জিনিসপত্রের দাম আজ কোথায় উঠিয়াছে? দেশ সেবার আজ কী হাল হইয়াছে? সে কথা নাই বা বললাম। দেশে মার্শাল ল জারী হবার পর পরই ১৯৫৮ সালে জেলে গিয়াছি। আবার এই সেদিনও জেল হইতে বাহির হইলাম। কিন্তু আমরা ছাড়াও আজ অসংখ্য নেতা ও কর্মী জেলে আছেন। জেলের মধ্যে তাহাদের বন্দী জীবন কাটিতেছে। আর তাহাদের স্ত্রী পুত্র অভাবের তাড়নায় রাস্তায় ভিক্ষা করিতে নামিয়াছেন। আর যাহারা চক্ষু লজ্জায় রাস্তায় নামীতে পারেন নাই তাহারা আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের কাছে হাত পাতিতেছেন। সরকার রাজবন্দীদের ফ্যামিলি ভাতা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। বন্দীদের দৈনিক ভাতা ২ টাকা করিয়া দিয়াছেন। তার পরে আছে সেল, আছে এক জেল হইতে আরেক জেলে বদলি। বক্তৃতা আর কী করিব? দেশ ব্যাপী আজ আওয়াজ উঠিয়াছে শহীদ-ভাসানী ও অন্যান্য রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যেসব ব্যাক্তি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্য হইয়াছেন তাহারা এই দাবী তুলিয়াছেন। সবাই মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলিয়াছেন রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। তবু আজ তাহারা মুক্তি পান নাই। তবুও আজ তাহারা কারাগারের অন্তরালে।

যে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর জন্য এই পাকিস্তান কায়েম হইয়াছে, যে কাউয়ুম খান সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেসের সঙ্গে সংগ্রাম চালাইয়াছেন, যে খান আব্দুল গফফার খান আজীবন দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছেন তারা সবাই আজ কারাগারে বন্দী। আর যেসব সরকারী কর্মচারী আজীবন বিদেশীর গোলামী করিয়াছেন আজ যাহাদের আঙ্গুল ফুলিয়া কলাগাছ হইয়াছে এদেশে আজ তাহাদেরই রাজত্ব। আজ তাহাদের জানা উচিৎ দেশ শাসন করিতে হইলে দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, জনসাধারণের প্রতি দরদ থাকা চাই।

জুলুম করিয়া দেশ শাসন চলেনা। গত ১৫ বৎসরে কত দেখিলাম। শেষ পর্যন্ত দেখিলাম চট্টগ্রামের জাকির হোসেন কে। আজ অভিযোগ করা হয় পরিষদে শাহেদ আলী হত্যার জন্য দেশে মার্শাল ল হইয়াছে। জিজ্ঞেস করি রাওয়ালপিণ্ডির প্রকাশ্য জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খানকে যখন গুলি করিয়া হত্যা করা হইল তখন দেশে মার্শাল ল হইল না কেন? এমন কি আজও সেই লিয়াকত হত্যার বিচার হইল না।

তবে কেন শাহেদ আলী হত্যার অজুহাতে দেশে মার্শাল ল জারী করা হইল? ভাই সব, আজ আমাদের বুঝিতে হইবে সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠিবে না। ৪ বৎসর ধরিয়া মার খাইতেছি। একবার জেল একবার বাহির। মাত্র জেলের বাহিরে আসিয়া দেখি ঘরের দুয়ারে টিকটিকি, বাহিরে টিকটিকি, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাই – সেখানেও টিকটিকি। সর্বত্রই টিকটিকি। (অস্পষ্ট)

শুধু কি তাই, ছাত্রনেতা আব্দুস শহীদ আজ ১৪ বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত। কাজী আব্দুল বারীর চলিয়াছি ১০ ঘা বেত। তার বাবা রাজনীতি করিতেন। তাদের আজ (অস্পষ্ট) করিয়া রাখিয়াছেন জাকির হোসেন।

হাসিব না কাঁদিব না মাটির মধ্যে ঢুকিয়া যাইব, কিছুই বুঝিনা। কিন্তু আমি বলি আমরা ভোট চাইনা। নির্বাচনে দাঁড়াইতে চাইনা। আমাদের মৌলিক অধিকার ফেরত দাও। আমাদের কথা বলার অধিকার ফেরত দাও। গত ১৪ বৎসর ধরিয়া আমাদের যা লুট করিয়াছ ফেরত দাও। দেশের ৯ জন ভদ্রলোক দাবী করিয়াছেন এই শাসনতন্ত্র চলিবে না। দেশের প্রতিনিধিদের লইয়া শাসনতন্ত্র তৈরি করিতে হইবে। ইহাই আমাদের দাবী। ইহাই সমগ্র পাকিস্তানবাসীর দাবী।

এই সভায় আমরা শহীদ-ভাসানী-কাউয়ুম-গফফার খানের মুক্তি চাই। মুক্তি চাই দেশের সকল রাজনৈতিক বন্দীর। সরকার জোর করিয়া তাহাদের জেলে রাখিলে ভুল করিবেন। কত লোককে তাহারা জেলে দিবেন? আজ দেশের লোকের জেলের ভয় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। সাভারে নতুন জেল তৈরি হইতেছে তাহাও আমরা জানি। তবু বলিব, ইহাদের ছাড়িয়া দিন। ইহারা কে তাহা আপনারাও জানেন, আমরাও ইহাদের চিনি। ইহাদের যদি জেলে রাখিতে চান আমরা জেলের বাহিরে থাকিতে চাই না। শুধু দেশবাসীকে জানাইতে চাই এই ৪ বৎসরের ইতিহাস। মারের আর নির্যাতনের ইতিহাস।

একদিন সকালে উঠিয়া শুনিলাম রাজধানী করাচী হইতে রাওয়ালপিণ্ডি হইতেছে। করাচীকে পশ্চিম পাকিস্তানে মিশাইয়া দেওয়া হইতেছে। অথচ করাচী আমাদেরই টাকায় তৈরি। করাচী হইতে রাজধানী যদি স্থানান্তরিত করিতে হয় তবে উহা ঢাকায় আনা হউক।

Reference:
দৈনিক আজাদ, ৯ জুলাই ১৯৬২

বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক