ABC চ্যানেলে দেয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার (বাংলায়)
বিদেশি টেলিভিশন সাংবাদিক পিটার জেনিংস এবং লুই শেক’কে দেয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার
ঢাকা, ১৩ মে ১৯৭২
মার্কিন ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (এবিসি) কর্তৃক গৃহীত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটি ১৫ মে ১৯৭২ সারা যুক্তরাষ্ট্রে’টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের সাথে ১৯৭২ সালের ১৩ মে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত দীর্ঘ টিভি সাক্ষৎকারের পূর্ণ বিবরণ নিয়ে দেওয়া হলো :
প্রশ্নকর্তা : জনাব ভুট্টোর সাথে আপনার বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে কী?
বঙ্গবন্ধু : আপনারা জানেন, শ্রীমতী গান্ধী ও জনাব ভুট্টো বৈঠকে মিলিত হয়ে তাদের দুইদেশের সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এই ব্যাপারে আমার মতামত অত্যন্ত স্পষ্ট। জনাব ভুট্টোকে সর্বাগ্রে বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করতে হবে। তিনি যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন, তার উচিত এক্ষুণি এই বাস্তব সত্যকে মেনে নেওয়া, আর তাহলে, তার সাথে বাংলাদেশ ওপাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যাবলি আলোচনা করতে কোন আপত্তি থাকবে না।
প্রশ্নকর্তা : আচ্ছা এ পর্যন্ত আপনার ও ভুট্টোর মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন যোগাযোগ হয়েছে কিনা?
বঙ্গবন্ধু : প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রাখা সম্ভবপর নয়। জনাব ভুট্টোর বুঝা উচিত বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার অংশ আর বাংলাদেশ পাকিস্তান ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছে। এখন বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। এমনকি বিশ্বের চতুর্থ ভেটো ক্ষমতাধারী শক্তিও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।৭০টিরও বেশি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জনাব ভুট্টো বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করলে তার সাথে আলোচনায় বসতে আমার কোন আপত্তি থাকবেনা।
প্রশ্নকর্তা : এক্ষণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোন সমস্যাটিকে আপনি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
বঙ্গবন্ধু : বহু সমস্যা রয়েছে। তারা আমাদের ৪ লাখ নিরীহ মানুষকে আটক রেখেছে।তারা ওদের বন্দি শিবিরে নিয়ে অন্তরীণদশায় ফেলেছে। এ ছাড়া আরও বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। তারা যদি আলোচনা করতে চায়, তবে তারা তা করতে পারে।
প্রশ্নকর্তা : প্রধানমন্ত্রী, এখন ভারতে প্রায় ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দি রয়েছে, আপনি ওভারতীয়দের মতৈক্য ছাড়া তাদের ভারতীয়রা ছাড়বে না। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরে পাবার জন্য আপনারা অত্যন্ত উদগ্রীব ও আকুল। যুদ্ধবন্দি এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের মধ্যে যারা সত্যিই দেশে ফিরে আসতে চায়,এদের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের সম্ভাবনা কিছু আছে কী?
বঙ্গবন্ধু : যুদ্ধবন্দি-যুদ্ধবন্দিই, বেসামরিক নাগরিক বা সামরিক নাগরিক। তাদের লোকওএখানে রয়ে গেছে : অবাঙালি বা বিহারী ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী তথাকার লোক বাংলাদেশে রয়ে গেছে। যদি তারা এদের নিতে চায়, তাদের সাদর স্বাগত জানানো হবে। আমার কোন আপত্তি নেই এতে। আমি আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে বলেছি, এসব লোককে নিয়ে যাও এবং আমার লোকদের পাকিস্তান থেকে ছাড়িয়ে আনোযুদ্ধবন্দিদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। তাদের বিচার করা হবে। দুটি দিককে জট পাকিয়ে ফেলা ঠিক হবেনা।তারা বেসামরিক নাগরিক এবং এসৰ লোক বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। এরা আমার ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছে। তারা আত্মসমর্পণের পূর্বে কারফিউ জারি করে আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এগুলো ছিল ঠাণ্ডা মাথায় নরহত্যা। তারা আমার মানুষের ঘর ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছে।
প্রশ্নকর্তা : জনাব ভুট্টো যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে অতীব উদ্বিগ্ন, আর আপনি বলছেন,এখানে এদের বিচার করতে আপনি বদ্ধপরিকর।
বঙ্গবন্ধু : আমি সেটা করব। এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। আপনি নিজেই কী তাদের ওমনি যেতে দিতে পারেন? এরা যে ক্ষেত্রে ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছে,গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে, এমতাবস্থায় কোন দেশ কী এদের ছেড়ে দিতে পারত?
প্রশ্নকর্তা : জনাব, এমন কোন পথ আছে কী যে পন্থায় আপনি হয় সংখ্যার দিক থেকে(যেকোন সংখ্যক লোকের বিচার আপনি করতে পারেন, তাদের অনুপস্থিতিতে বা উপস্থিতিতে) অথবা অন্যভাবে যুদ্ধাপরাধী বিচার সম্পর্কে আপনার এখনকারভূমিকা রদবদল করতে পারেন?
বঙ্গবন্ধু : এটা বিস্তারিত আলোচনার প্রশ্ন।
প্রশ্নকর্তা : বিস্তারিত মানে?
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ, এটা বিশদ ও বিস্তারিত আলোচনার উপযুক্ত প্রশ্ন । অপরাধ সত্য যারাকরেছে, যারা দোষী, বিচার তাদের হবেই। নিরপরাধ যুদ্ধবন্দিদের বিচার আমি করব না। যারা ইচ্ছাপ্রবৃত্ত হয়ে পাইকারী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, আমার লোকদের খুন করেছে, আমার সব কিছু বিপর্যন্ত করেছে, আমার মেয়েদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। আমি তাদেরই বিচার করব। আমি বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ মেয়ে। খুঁজে পেয়েছি, যারা পাক সেনা দ্বারা নির্যাতিতা ও ধর্ষিতা হয়েছে। আপনিকিভাবে আশা করতে পারেন, আমি তাদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেব?
প্রশ্নকর্তা : ভারত সরকারের কাছে আপনি একটি তালিকা পেশ করেছেন জনাব, আমার বিশ্বাস আপনি যেসংখ্যক যুদ্ধবন্দির বিচার করতে চান, তদুপক্ষা বেশি লোকের নাম রয়েছে ওই তালিকায় । এ সংখ্যাটি ১,৪০০। এটা জনাব ভুট্টোকে এতই শঙ্কিত করে তুলেছে যে, তিনি বলেছেন, তাঁর দেশে এর প্রতিক্রিয়ায় এক কুজঝটিকা বয়ে যাবে। আপনি কী সংখ্যাটি কমানোর চেষ্টা করবেন?
বঙ্গবন্ধু ; দেখুন, এখনো তদন্ত চলছে। এটা ১,৪০০ হতে পারে, ১,০০০ হতে পারে,এমনকি ৫০০ও হতে পারে। তদন্তের উপরই সবকিছু নির্ভর করছে। যারা অপরাধী, যারা আগুন লাগিয়েছে, নরহত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, একমাত্র সেসব লোকেরই বিচার হবে, গ্রেপ্তারকৃত ৯৩,০০০ লোকেরই বিচার হবে না।
প্রশ্নকর্তা : আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রী, জনাব ভুট্টোও বলেছেন, কিছু লোক সত্যিই যুদ্ধাপরাধী আরতাদের বিচার হওয়া উচিত। আপনি কী মনে করেন এদিক থেকে জনাব ভুট্টোরসাথে আপনার কোনরূপ সমঝােতার সম্ভাবনা আছে?
বঙ্গবন্ধু : কীভাবে এটা সম্ভব? এখন পর্যন্ত বাস্তবতাকে মেনে নেবার সৌজন্যটুকুভদ্রলোকটির হলো না। তিনি নিজের সম্পর্কে ভাবছেন কী? আপনি দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকৃতি দিয়েছে, বন্ধুদেশ ভারত স্বীকৃতি দিয়েছে, ফ্রান্স স্বীকৃতি দিয়েছে এবং স্বীকৃতি দিয়েছে গ্রেটব্রিটেন। বিশ্বের প্রায় সকল বৃহৎ দেশ আমাদের স্বীকৃতি দান করেছে।“শেখ মুজিবের সাথে স্বীকৃতির প্রশ্নে আমি আলোচনা করতে চাই না”-এটা বলে ভুট্রো কী খেলা খেলতে চাইছেন? “স্বীকৃতির বিষয়টি সম্পর্কে” কথাটি দ্বারা তিনি কী বুঝাতে চাইছেন? আমি পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেই কিনা, তাও তো প্রশ্ন। কারণ, জনাবভুট্টো আর পাকিস্তান নাম দাবি করতে পারে না।
প্রশ্নকর্তা : আমি বলার আগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রধানমন্ত্রী, গত জানুয়ারি মাসে এইব্রডকাস্টিং কোম্পানির সাথে সাক্ষাৎদানকালে আপনি স্বয়ং বলেছিলেন, এমন সময় আসবে যখন অতীতকে বিস্মৃত হয়ে ভবিষ্যতের জন্য কাজে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এখন বাংলাদেশে প্রায় ৫০,০০০ দালাল কারাগারে অন্তরীণ রয়েছে, সম্ভবত একমাত্র ঢাকা জেলেই রয়েছে ১০,০০০-এর মতো। যুদ্ধবন্দিসহ এত বিরাট সংখ্যক লোকের বিচার আপনি কীভাবে করবেন, সেই অতীত না হাতড়ে?
বঙ্গবন্ধুঃ হাতড়ে? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১০ হাজার লোক আটক রয়েছে, এসব তথ্য আপনারপান কোথেকে আমি জানি না। আমি জানি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সব মিলিয়ে বন্দির সংখ্যা ৭,০০০-এর বেশি হবে না। আপনারা কোথায় এসব তথ্য পান, আমি জানি না। এসব কিছু জানার জন্য এখানে একটি গােয়েন্দা সংস্থা রয়েছেমনে হচ্ছে। আমি আপনাকে জানাচ্ছি, এমনকি দালালদের মামলাগুলোও তদন্ত কমিশন যাচাই করবে। বস্তুতপক্ষে, যারা নিরপরাধ, তদন্ত করে আমরা তাদের ছেড়ে দিচ্ছি। একমাত্র, যারা অপরাধবৃত্তি সংঘটনের জন্য দায়ী, তারাই বিচারের সম্মুখীন হবে। ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭১) রাতেও যে লোক এক ডাক্তারের গৃহে ঢুকে, তার স্ত্রীর সামনে ডাক্তারকে টেনে হেঁচড়ে এনে নির্মম অত্যাচার করে অমানুষিকভাবে হত্যা করেছে, আমি তাকে ছেড়ে দিতে পারি? তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমিই বা তাকে ক্ষমা করব কী করে? এসব লোকদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। তবে, আমার নিরীহ মানুষদের হত্যার জন্য পাকফেীজ যে সব লোককে ব্যবহার করেছে, কাজে লাগিয়েছে, আমি তাদের অবশ্যই ক্ষমা করে দিয়েছি। এতদুদ্দেশ্যে তাদের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র যোগানো হয়েছিল। আমি এ সব লোককে স্পর্শও করি নি। আমি তাদের বলেছি :“শান্তির অনুগত হও, বাংলাদেশের জন্য কাজ কর, এখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ কর। তোমাদের সাদরে বরণ করব।” এসব আমি কী করি নি?
প্রশ্নকর্তা : কথার মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এক্ষুণি আবার শুরুকরছি, (মি, মরিশাস জিজ্ঞাসা শুরু করলেন)। জনাব প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেছেন, এতদঅঞ্চলের শাস্তি অথবা একটি মতৈক্যের জন্য তাকে আপনার বিশ্বাস করতে হবে। আপনি কী ব্যক্তিগতভাবেভুটাকে বিশ্বাস করেন?
বঙ্গবন্ধু : আপনি এসব কল্পনাশ্রয়ী অনুমিত প্রশ্ন ছাড়তে পারেন জনাব? পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার উপর বিশ্বাসের প্রশ্ন নির্ভর করে। আমি একাকী এগুতে পারি না।
প্রশ্নকর্তা : মাফ করবেন, প্রধানমন্ত্রী, ওটা যে নিতান্তই অনুমাননির্ভর প্রশ্ন, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আপনি কী ভুট্টোকে বিশ্বাস করেন?
বঙ্গবন্ধু : তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন কী করেন না, এটা কোন প্রশ্ন নয়। এটা মুজিবুর রহমান ও মি, ভুট্টোর মধ্যে ব্যক্তিগত পারস্পরিক আস্থার কোন প্রশ্ন নয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এ-দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিনা। প্রশ্নকর্তা : যুদ্ধ অবসান এবং বাংলাদেশের মুক্তিলাভের পর আপনাকে ছেড়ে দেওয়া এবং দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে অনেকে ভুট্টোকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। অন্যেরা বলছেন, সে সময়ে তার সাথে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল আপনার। এটা কী সত্য?
বঙ্গবন্ধু : হ্যা, আমরা আলোচনা করেছি। আমরা অনেক কিছু আলোচনা করেছি। ভুট্টো যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন আমরা সর্বদাই আলোচনার জন্য প্রস্তুত। কেননা, আলোচনার মাধ্যমেই মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভব। প্রশ্নকর্তা : সমঝোতার জন্যই কী বিশ্বাস করা প্রয়োজন? বঙ্গবন্ধু : হ্যা, ভুট্টোকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে প্রথম স্বীকার করে নিতে হবে। আপনারা কেন আমাকে এ ধরনের প্রশ্ন করছেন-আমি বুঝতে অক্ষম। যিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি দেয় নি-তাকে আমি কী করে বিশ্বাস করতে পারি। জনাব ভুট্টো এখনও বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান অথবা পূর্ব বাংলারূপে আখ্যায়িত করছেন। তাঁর এভাবে কথা বলার কী অধিকার রয়েছে? যখন সে এইভাবে ব্যবহার করছে- তখন তাকে কী করে বিশ্বাস করতে পারি? তাকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। পরস্পর পরস্পরকে বুঝা ও সহযোগিতা করা বিভিন্ন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে নিক্সনের সফর।
প্রশ্নকর্তা : আমি কী বিষয়ের সামান্য পরিবর্তন করতে পারি? আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফর করেছেন ও মস্কো যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি কী ঐসব দেশ বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য সফর করছেন?
বঙ্গবন্ধু : মি, নিক্সন তার দেশের স্বার্থের জন্য ঐসব দেশ সফর করছেন। উপরন্তু তারা বৃহৎ রাষ্ট্র। তারা যা খুশি আলোচনা করতে পারেন-আমার বলার কিছুই নেই। আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ। মার্কিন স্বীকৃতি প্রসঙ্গে প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, মি, নিক্সন তো কখনও আপনাকে বৃহৎ শক্তির সাথে দেখেনি, কিন্তু চীন সফর ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তার সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী পরিবর্তিত হয়েছে?
বঙ্গবন্ধু : আমি অত্যন্ত সুখী যে, যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বীকৃতি দিতে বেশ দেরি করেছেন। কিন্তু আমি জানি যে, মার্কিন জনগণ, সংবাদপত্র ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। তাঁরা আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছেন। এমনকি কেহ কেহ এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে ভারতে দেখার জন্যও এসেছিলেন। আমি তাঁদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি-অবশ্য মি. নিক্সন পাকিস্তানকে। সেই সময় সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমি মি, নিক্সনকে সেজন্য ধন্যবাদ দিতে পারি নি। আমি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চাই
প্রশ্নকর্তা : কিন্তু জনাব প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশকে সাহায্যদানকারী দেশসমূহের মধ্যে আমেরিকাই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দিচ্ছে ও ভবিষ্যতেও দিতে থাকবে। আপনি এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণভাবে এই উপমহাদেশে ও বিশেষ করে বাংলাদেশ ও আমেরিকার সাথে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান।
বঙ্গবন্ধু : যুক্তরাষ্ট্র একটি বৃহৎ শক্তি-সে সাহায্য করতে সক্ষমও আমিও সাহায্য নিতে কোন বাধা-বিপত্তি দেখছি না—অবশ্য এই সাহায্য সর্বপ্রকার শর্তহীন হতে হবে। আমেরিকা এখন পর্যন্ত শর্তহীনভাবেই সাহায্য দিয়েছে। কিছু সাহায্য সরাসরি ও কিছু আনরডের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। এখন স্বীকৃতি এসেছে-আমরা আরও আলোচনা করব-আমি শুধু আমার দেশ সম্বন্ধেই বলতে পারি যেখানে সাড়ে সাত কোটি লোক বসবাস করছে। আমি পূর্ব বা পশ্চিমের কোন ব্লকের সাথে সংযুক্ত নই। আমার নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট-আমি নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। আমি সোভিয়েত ও ভারতের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি-কেননা, এই দুটি মহান দেশ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
প্রশ্নকর্তা : সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি সম্পর্কে আপনার কী মতামত? জনাব প্রধানমন্ত্রী, সোভিয়েত নৌ-বাহিনী এখন চট্টগ্রাম বন্দরে উদ্ধারের কাজ করছে ও এই ধরনের সংবাদ শুনা যাচ্ছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগর ব্যবহারের জন্য অনুমতি চেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু : আমি এই ধরনের কিছুই জানি না। আপনারা কোথা থেকে এ সংবাদ পেলেন? চট্টগ্রাম বন্দরটিকে পরিস্কার করার জন্য একটি চুক্তি অনুসারে এরা এসেছে ও বন্দরটিতে কাজ করছে। আমার মাটি বা জল ব্যবহার করার জন্য কাউকে কোন অনুমতি দেওয়া হয় নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ধরনের কোন অনুমতিও চায় নি। আমি শান্তি চাই
প্রশ্নকর্তা : আপনি উপমহাদেশের সমস্ত দেশের কল্যাণের জন্য আপনাদের মধ্যে একটি মৈত্রী চাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু : মৈত্রী সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এই উপহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে আমি শান্তি চাই ও কোন বৃহৎ শক্তি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ না করুক এই আমার কামনা। তাদের নিজের ব্যাপারে সুখী থাকুক, আমরা তাদের বিরক্ত করব না। বিরাট পরিমাণে কারো সাহায্য
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে আবার বিরক্ত করছি। আপনি কী মনে করেন যে, কোন দেশ থেকে ব্যাপক আকারে সাহায্য কোন শর্ত ছাড়াই আপনি পেতে পারেন?
বঙ্গবন্ধু : ব্যাপক আকারে সাহায্য? কতটুকু আমি গ্রহণ করব ও হজম করতে পারব তার উপরই সাহায্যের পরিমাণ নির্ভর করছে। ব্যাপক আকারে সাহায্যের অর্থ এই নয় যে, আমার দেশের উপর কেহ সাহায্য চাপিয়ে দেবে। আমার জনগণের জন্য যে পরিমাণ সাহায্য প্রয়োজন তা আমি নেব ইহা একান্ত আমাদের ব্যাপার।
প্রশ্নকর্তা : অসংখ্য ধন্যবাদ জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি বলেছেন যে, সংঘর্ষ লাগার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় লাগবে। আপনি কী মনে করেন যে, পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় লাগবে?
বঙ্গবন্ধু : এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
প্রশ্নকর্তা : আরও কম সময় তো লাগতে পারে।
বঙ্গবন্ধু : হ্যা, তাই।
প্রশ্নকর্তা : আপনি কীজন্য এত আশাবাদী?
বঙ্গবন্ধু : আমি যেহেতু জনগণের উপর নির্ভর করি। আমার জনগণ অত্যন্ত ভালো ও তারা আমার কথা মেনে চলে। তারা অত্যন্ত বিশ্বাসী ও কঠোর পরিশ্রম করছে।
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, বিগত চার মাসের কাজের জন্য আপনার সমালোচনা হচ্ছে। যারা স্বাধীনতার সময় সংগ্রাম করেছে ও সে কারণেই যারা সমস্ত দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে-তাদের কী করে আগামী তিন বছর আপনি শান্ত রাখবেন।
বঙ্গবন্ধু : আমি তাদের স্বাধীনতা দিয়েছি-আমি তাদের জীবনে সুখ এনে দেবতারা কখনও বিভ্রান্ত নয়। আমি ভুল সংশেধন করতে পারব
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবেন?
বঙ্গবন্ধু : সবসময় সমালোচকেরা কিছু না কিছু সমালোচনাও করেন। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আমাকে সমালোচনা করতে আমি তাদের অনুমতি দিয়েছি। সমালোচনার ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। কেননা, আমি জনগণকে ভালোবাসি-জনগণও আমাকে ভালোবাসে। সামান্যসংখ্যক লোকের সমালোচনায় আমার কিছুই আসে যায় না। আমি সৎ সমালোচনাকে স্বাগতম জানাই। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, আমি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী। আমাকে সমালোচনার অধিকার জনগণের রয়েছে। যদি দেশের কোথাও কোন অন্যায় কাজ হয় তার জন্য সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে, তাতে আমার ভুলও সংশোধন হবে।
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী বিরোধীদলের কাজকর্মে আস্থাবান?
বঙ্গবন্ধু: যদি আর কাউকে ভোট দিতে পারবে না-এই নীতিতে আমি বিশ্বাসী হতাম, তাহলে বিরোধীদল গঠন করতে নিশ্চয়ই অনুমতি দিতাম না। যেহেতু আমি নির্বাচনে বিশ্বাসী সেইহেতু জনগণ যদি বিরোধীদলের কাউকে চায় ভোট দেবে। ও সে বিরোধীদলের আসনেও বসবে-তাতে আমার মনে করার কিছুই নেই। খাদ্য সমস্যা।
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। আপনার দেশে তো কেউ অনাহারে নেই; কিন্তু আমরা জানতে চাই যে, আপনি কী করে বেকার সমস্যা সমাধান করছেন? আপনি কী করে চাকরি সৃষ্টি করছেন? বেকার লোকদের চাকরির সংস্থান করতে আপনার কতদিন সময় লাগবে?
বঙ্গবন্ধু : আপনাদের কাছে সব ঘটনার বিবরণ দেওয়া আবশ্যক। আমার আড়াই কোটি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। এক কোটি লোক গৃহহারা হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে। আমাকে তাদের বাসস্থান ও খাদ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। স্বভাবতঃই তাদের জন্য সবকিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অত্যন্ত খুশির কথা এই যে, গ্রাম পর্যায়ে সাহায্য সংস্থা গঠন করা হয়েছে যারা দরিদ্র জনগণের মধ্যে সাহায্য বিতরণ করছে। আমার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে, রেল যোগাযোগ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ও ট্রাক এবং বাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও আমার জনগণ কাজ করে চলেছে। অবশ্য সমস্যা রয়েছে ও থাকবে। আমার জনগণ অত্যন্ত বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ও অত্যন্ত ভালো।
প্রশ্নকর্তা : জনাব, আপনি এই সেই দিন দেশে ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এই ষড়যন্ত্র কী?
বঙ্গবন্ধু : আমি জানি, পৃথিবীর সর্বত্র ষড়যন্ত্র চলে।
প্রশ্নকর্তা : আপনি আরও বলেছেন যে, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কতিপয় বৈদেশিক শক্তি টাকা যোগাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু : আমি কী করে সব বলব? আপনারাই বা কী করে আশা করেন যে, আমি আপনাদের সবকিছু বলব? আমার গােয়েন্দা কর্মরত রয়েছে। আমি জানি কারা আমার কিছু কিছু লোককে টাকা ঘুষ দিয়ে দেশের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বাংলার প্রতিটি গৃহে আমার মানুষ রয়েছে। কোন দেশের পক্ষেই এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। তবুও কোন কোন দেশ তাদের অভিলাষ চরিতার্থ করার। জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশে যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন এ কাজ হতে পারবে না।
প্রশ্নকর্তা : ষড়যন্ত্র সম্পর্কে এ ধরনের খােলাখুলি আলোচনা করলে দেশের জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি কী হতে পারে না?
বঙ্গবন্ধু : আমার জনসাধারণ জানে যে, বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছে-ইহা এক বা দুদিনের বিষয় নয়। কোন কোন দেশ মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ষড়যন্ত্র করছে।
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী বৃহৎ শক্তিগুলোর কথা বলছেন?
বঙ্গবন্ধু : আমি এই সম্বন্ধে এখনও কিছু বলতে চাই না। অবশ্য যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের সাবধান থাকা প্রয়োজন। কেননা, আমি তাদের ধরতে চেষ্টা করছি। জনতার শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করব
প্রশ্নকর্তা : আপনি কী ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবিলা করতে চান? কিন্তু আপনার তো সংগঠিত পুলিশ বা সেনাবাহিনী নেই।
বঙ্গবন্ধু : আমি নিজেই সংগঠিত। আমার পুলিশের বা সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। কেননা, আপনারা নিশ্চয় জানেন, দেশের জনগণ যখন কোন নেতার পিছনে থাকেন ও তার প্রশাসনকে সমর্থন করেন তখন তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে সব শক্তির উৎস হলে জনগণ । যখন দেশের জনগণ কারও পেছনে থাকে, তাকে বিশ্বের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। এই হলো আমার ধারণা। খাদ্য দাঙ্গা।
প্রশ্নকর্তা : জনাব, আপনার দেশের কোন কোন এলাকায় খাদ্যের জন্য দাঙ্গা হয়েছে ওবিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে-এ সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?
বঙ্গবন্ধু : এ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না, আপনারা এ খবর পেলেন কোথায়?
প্রশ্নকর্তা : আপনার খবরের কাগজে আমরা এ বিষয় জানতে পেরেছি। দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু : খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে এমন কোন খবর আমি জানি না। বাংলাদেশের কোথায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটে নি।
প্রশ্নকর্তা : এই একই সংবাদপত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাহাজানি সম্বন্ধে খবর বের হয়েছে? আপনি পুলিশের প্রয়োজন মনে করেন না? আপনার তো মাত্র দুহাজার পুলিশ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু : আমার পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। আপনারা রাত ১২ টায় বা দুটায় যেখানে খুশি হাঁটুন দেখবেন কোন বিপদ আপদ নেই। নিউইয়র্কে তো রাত দশটায় চলা যায় না। কেননা, ওখানে যে কোন সময়, রাহাজানি সঘটিত হতে পারে বা যে কেহ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। নিউইয়র্কের চেয়ে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। এতবড় একটা সশস্ত্র বিপ্লবের পর এখানে-সেখানে কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে যা নিতান্তই গৌণ ব্যাপার মাত্র।
প্রশ্নকর্তা : ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আপনার মতামত কী? আমরা তো সিদ্দিকী সম্বন্ধে শুনেছি- তিনি নাকি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তুলছেন ও অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় নি।
বঙ্গবন্ধু : এ কথা সত্য নয়। ইহা নিছক বাজে কথা। জনাব সিদ্দিকী আমার কাছে ৫৮ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে।
প্রশ্নকর্তা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আমি কোন দুরভিসন্ধি নিয়ে বলছি না যে, দেশে আইন ও শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে বা দেশ অবনতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু : আপনারা কোথায় বিশৃঙখল অবস্থা দেখতে পেয়েছেন?
প্রশ্নকর্তা : আপনি তো গত জানুয়ারিতে দেশের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির জন্য সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন-সম্ভবত তা হয় নি।
বঙ্গবন্ধু : সবাই অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে। কে বলেছে তা হয় নি? এটা কী তামাশা যে, তারা এক লাখ পঞ্চাশ হাজার অসমর্পণ করেছে। তারা দুবার অস্ত্রশল সমর্পণ করেছে। অবশ্য অল্পসংখ্যক লোক রয়েছে যারা অস্ত্র জমা না দিয়ে কোথাও কোথাও চুরি ডাকাতি করছে, এর সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।
বিহারী।
প্রশ্নকতা : জনাব প্রধানমন্ত্রী, বিহারীদের ভাগ্য সম্বন্ধে কিছু জানাবেন কী? তাদের সমস্যার সঠিক কোন সমাধান আছে কী?
বঙ্গবন্ধু : তাদের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সবাই এমনকি জাতিসংঘের প্রতিনিধিগণ তাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছেন। তারা অবাঙালিদের দু অথবা তিনটি এলাকাও প্রত্যক্ষ করেছেন। আপনারা যদি সৈয়দপুর যান তবে দেখতে পাবেন অবাঙালিরা মিল ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে। আপনারা মিরপুর ও মোহাম্মদপুর দেখুন তারা ওখানে শান্তিতে বসবাস করছে। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিহারীদের বিষয়টিকে জোরালো করে তুলছেন, কিন্তু পাকিস্তানে আটকেপড়া সাড়ে চার লাখ বাঙালিদের ভাগ্য সম্বন্ধে তারা কিছুই বলছেন না। তারা কোন অন্যায় করে নি, তবুও তাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। তারা তাদের খাদ্য বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমি আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে যেখানে খুশি যেতে দিচ্ছি। তারা আমাদের রেডক্রসের সহায়তায় সাহায্যদ্রব্য বিতরণ করছে। অবশ্য আমার জনগণ দরিদ্র, আমি আমার জনগনকে পুরো খাদ্য দিতে পারছি না। মানুষের পক্ষে যা সম্ভব আমি তাই করছি। কিন্তু পাকিস্তানে আমার যে সাড়ে চার লাখ লোক আটকা পড়েছে সে সম্বন্ধে বিশ্বের কোন মহল থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কেউই তাদের জন্য কোন কথা বলছে না। অথচ বিহারীদের জন্য সকলেই অস্থির। বিহারীরা এখানে আরামে বসবাস করছে। একথা আমি সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, বাংলাদেশকে যারা মাতৃভূমি বলে স্বীকার করবে তাদের আমি স্বাগত জানাব। বিহারীদের এখানে কাজে থাকতে দিন। আমি নিশ্চিত যে, বিহারীরা আমেরিকার নিগ্রোদের তুলনায় সুখে আছে।
প্রশ্নকর্তা : জনব প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। বঙ্গবন্ধু : ধন্যবাদ।
সূত্র : সংবাদ, ১৫ মে ১৯৭২
::::::::::::::::::
ভিন্ন একটি বইয়ে এই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ পাওয়া যায়। সেটিও এখানে যুক্ত হল। সোর্স – দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, p 349-351