বাংলার বাণী
৯ই জুলাই, সোমবার, ১৯৭৩, ২৪শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
কামাল-হাকসার বৈঠক
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত শ্রী পি.এন. হাকসার বাংলাদেশে এসেছিলেন, আজ তার ভারত ফেরার কথা। ঢাকা অবস্থানকালে তিনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গে তিন দফা বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক সমূহে বিগত সতেরোই এপ্রিল বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার পর উপমহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার গতি-প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় উভয় দেশ একটা সাধারণ মতৈক্যে পৌঁছেন। এছাড়া প্রস্তাবিত ভারত-পাকিস্তান বৈঠকে আসতে পারে এমন অনেক বিষয় নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার পর প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এই যুক্ত ঘোষণাকে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এবং ভারতের আন্তরিক উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য আসেনি পাকিস্তানের তরফ থেকে। এই সময়ের মধ্যে পদ্মা, গঙ্গা, সিন্ধুতে অনেক জল গড়িয়েছে। পাকিস্তানের বেলুচিদের মুক্তিসংগ্রাম অধিকতর জোরদার হয়েছে। খোদ ইসলামাবাদে বাংলাদেশের স্বপক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো এ মাসের শেষের দিকে চলেছেন ওয়াশিংটনে। সেখানে শলা-পরামর্শ হবে। আজ শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার যে কথা পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহলে উঠেছে, ভুট্টোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর তারও অনেক রদবদল হতে পারে। আর এসব কিছু পরিবর্তন-বদলের মুখে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে অফিসার পর্যায়ে আলোচনার একটা সম্ভাবনা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
প্রস্তাবিত সেই আলোচনাকে সামনে রেখেই হাকসার এসেছিলেন ঢাকায়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা শেষে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের আসন্ন বৈঠকে এই ঢাকা আলোচনাই আমাদের আলোচনার ভিত্তি হবে। পাকিস্তান সে আলোচনার কতটুকু আন্তরিকতার পরিচয় দেবে অথবা উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদৌ কোন সদিচ্ছা তাদের রয়েছে কিনা এবং থাকলেও তাদের বিদেশী মুরুব্বীরা তাদের কতটুকু অগ্রসর হবার অনুমতি দেবেন তা পাকিস্তানের আগামী দিনের কার্যক্রম থেকেই পরিষ্কার হবে। তবে একদিন আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবার যে নীতি তারা অনুসরণ করে আসছিলেন সেটা কি আরো বহুদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে? পাকিস্তানের প্রগতিশীলকে শক্তি সেখানকার সরকারী মহলের এ অন্ধনীতি কতদিন বরদাস্ত করবে?
এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত মিঃ হাকসারের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। এই বিচারকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের কাগজসমূহ যে নানা জল্পনা-কল্পনার ফানুস ছড়াচ্ছিলো আমরা আশা করবো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর তার অবসান হবে। আমরা আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য থেকে অতীতেও যেমন এতটুকু পিছু হটিনি ভবিষ্যতেও আমরা সে নীতি বজায় রাখবো। শান্তি এবং মানবতার স্বার্থে যে মানবতাবিরোধী পাশবশক্তির বিচারের সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করেছি তা ‘স্বীকৃতি দেবোনা’ এমন সব হুমকির মুখে প্রত্যাহার করতে পারি না।
দুর্নীতিবাজদের মরণ কামড় ব্যর্থ করতেই হবে
দশই জুলাইয়ের মধ্যে ভুয়া রেশন কার্ড জমা না দিলে, পরিত্যক্ত বাড়ী ছেড়ে না দিলে এবং বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে কার্ফু দিয়ে তল্লাশী চালানো হবে বলে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন—বাসস বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে। ইতিপূর্বে এসব সমর্পণ করবার শেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৩০শে জুন। কিন্তু ৩০শে জুনের মধ্যে সমর্পণ করার ব্যাপারে জনগণের কতগুলো অসুবিধে থাকার ফলে তা ১০ই জুলাই পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং জনগণের দিক থেকে এই সব ব্যাপারে সরকারের প্রতি আর কিছু বলার সংযোগ নেই। এবং সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষেও এক্ষণে এই সমস্ত কারণে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে কোন কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে আর কোন বাঁধা বা অসুবিধে নেই। সুতরাং সাধারণ মানুষ এক্ষণে মনে করে যে, সরকার দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদেরকে কঠোর হস্তে নির্মূল করতে আর এতটুকু বিলম্ব বা দ্বিধা করবেন না।
সমস্ত প্রকার দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে শুধু কঠোর নয় প্রয়োজন বোধে নিষ্ঠুর হবার জন্যেও আমরা বহুবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। আমরা সাধারণ মানুষের বক্তব্যকেই সে আহ্বানের মধ্যে প্রকাশ করেছি। কিন্তু তবু কেন যে সরকার তেমন কঠোর ও তৎপর হননি তা আমরা জানিনা। যাই হোক বিলম্বে হলেও এখনো সমাজ থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে দূর করা সম্ভব কেবলমাত্র এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। একথা আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলি। জনগণও সেই মনোভাবই পোষণ করেন। অবশ্য একথাও সত্যি যে, সমাজবিরোধীরা অন্যায় করলেও এবং তাদের সংখ্যা স্বল্প হ’লেও তাদেরকে নির্মূল করার জন্য আঘাত হানতে গেলে এটা প্রতিঘাত আসতে পারে। এটা নিউটনের থার্ড ল’য়ের মতো। এবং একথার সত্যতার প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া যেতে শুরু করেছে।
দুর্নীতিবাজ ও সমাজবিরোধীদের দমনের প্রথম পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রমকে বানচাল করার জন্যে তারা ইতিমধ্যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা কুৎসা রটাতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয় তাদেরকে হুমকি দিতেও দ্বিধা করেনি। নীলফামারী থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, সেখানকার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক দুর্নীতি দমনমূলক কর্মতৎপরতার দরুণ অসাধু ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর প্রভৃতি ব্যক্তিদের নাভিশ্বাস উঠেছে। ফলে তারা ছাত্রদেরকে ঘায়েল করার জন্য এবং তাদের দুর্নীতি দমন কর্মতৎপরতা বন্ধ করার প্রচেষ্টায় ১৩ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। সমুদ্রের অথৈ পানিতে পড়ে বাঁচবার জন্যে এক খন্ড খড়কুটোকেও যেমন শেষ এবং বড় অবলম্বন বলে মনে হয় তেমনি দুর্নীতিবাজরাও তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টায় ছাত্র সমাজের বিরুদ্ধে মরণ কামড় দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। বরং সমাজের সকল প্রকার দুর্নীতির আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য প্রণীত বাস্তবমুখী কর্মসূচী প্রয়োগে সাফল্য আসছে বলে মনে করা যায়।
সুতরাং এমতাবস্থায় আমাদের বক্তব্য, সমাজবিরোধী ও দুর্নীতিবাজদের দিক থেকে যত বড় প্রতিঘাতই আসুক না কেন, সমাজের প্রতি কন্দর থেকে দুর্নীতির দুষ্ট কীটকে ধুয়ে মুছে সাফ করার জন্যে সরকারকে অবশ্যই কঠোরতম মনোভাব পোষণ করতে হবে এবং সেজন্য বাস্তবমুখী কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই কর্মসূচীর সাফল্যের জন্য আপামর জনগণকেও সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা দান করতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এ ব্যাপারে প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক অত্যন্ত সচেতন থাকবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক