You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.15 | শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতী গান্ধী | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতী গান্ধী

পূর্বাঞ্চলের শরণার্থী শিবিরগুলাে ঘুরে ঘুরে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। রবিবার আসবেন তিনি বনগাঁয়। এই শিবিরগুলােতে ইতিমধ্যেই তিরিশ লক্ষ আতঙ্কিত মানুষ জড় হয়েছেন। আরও আসছেন। হাজারে হাজারে। জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। বাইরের সাহায্য বড় একটা পাওয়া যাচ্ছে না। এপারে এসেও দুর্ভাগাদের সােয়াস্তি নেই। মাঝে মাঝে তাদের উপর পড়ছে পাক-কামানের গােলা। এই পর্বতপ্রমাণ বােঝা বহনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল অনেক আগেই। প্রশাসকদের অদূরদর্শিতা জটিল করে তুলেছে গােটা পরিস্থিতি। শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়ছে পশ্চিম বাংলা। নয়াদিল্লী ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন বাস্তব অবস্থ। পাল্টাচ্ছে তাদের ত্রাস পরিকল্পনা। আত্মবঞ্চনা করে লাভ নেই। ইয়াহিয়ার চালের কাছে হেরে গেছে ভারত। বাংলাদেশে জনসংখ্যা কমছে। অদূর ভবিষ্যতে সে হয়ত আর সংখ্যাধিক্যের দাবী করতে পারবে না। গণহত্যা এবং মানুষ-খেদার অভিযান সম্পূর্ণ হলে বহাল তবিয়তে ঘর গুছাবেন ইয়াহিয়া খান। আর তাঁর দুঙ্কার্যের ভারবাহী হয়ে থাকবে ভারত। মুক্তিযােদ্ধারা লড়বেন। তাদের সর্বকত্মক বিজয় কবে সম্ভব হবে তা জানেন না কেউ। অন্ততঃ এইটুকু সত্য আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য শরণার্থীরা থাকবেন ভারতে। অনেকে হয়ত আর ফিরে যেতেই চাইবেন না। ইসলামাবাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন নয়াদিল্লী। এ ফাদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
শরণার্থী শিবিরগুলােতে দেশী-বিদেশী অনেক মহামান্যের পদধূলি পড়েছে। তাতে হতভাগাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশের পাক-অত্যাচারও বন্ধ হয়নি। শ্রীমতী গান্ধীর আগমনে লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাসের গরম হাওয়া ঠাণ্ডা হবার নয়। ওরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বদেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলেই অধিকাংশই হয়ত ফিরে যাবেন। এই পরিবেশ সৃষ্টিতে যত দেরী হবে অনেকের ফিরে যাবার পথও তত কন্টকিত হয়ে উঠবে। শেষ পর্যন্ত ক’লক্ষ নরনারীর হয়ত ফিরে যাওয়াই হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া আর কেউ শরণার্থী মুক্ত করতে পারবেন না ভারতকে। তার জন্য দরকার মুক্তি যােদ্ধাদের সামরিক অগ্রগতি এবং মুক্ত অঞ্চলের পরিধির বিস্তার। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পাননি কারও কূটনৈতিক স্বীকৃতি। তাদের ভাগ্যে জুটছে না প্রযােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র। ইয়াহিয়ার সুসজ্জিত বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করবেন কিসের জোরে? বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাবার অনুমতির জন্য ইসলামাবাদের কাছে আর্তি জানাচ্ছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘ। আমেরিকা পিছন থেকে ঠেকা দিচ্ছে ভারতকে। ইয়াহিয়া শুধু বলছেন—এখনও সময় আসেনি। বাংলাদেশকে একেবারে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত ইসলামাবাদের বাঞ্ছিত সময় আসবে না। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বেন বাঙ্গালী জনতা। এপারে শরণার্থীদের ঘিরে দানা বাঁধবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। কৃতজ্ঞতার বদলে দেখা দেবে ভারতের প্রতি বিতৃষ্ণা। ঠিক এই মুহূর্তেই আসবে ইয়াহিয়ার অনুকূল সময়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাহায্য তিনি নিতে চাইবেন নিজের হাতে। তাতে হয়ত আপত্তি করবেন না বিশ্বাসভার মানবদরদীরা। পাক-ঘাতকেরা নামবে আর্ত-ত্রাণে। লাভের ব্যবসা ফাঁদবেন ইসলামাবাদ। বৈদেশিক সাহায্যের ছিটেফোটা যাবে বাংলাদেশে। পরের ধনে দল ভারী করবে কুচক্রী দল। ক্ষুধার অন্ন যে তুলে দেবে আর্তের মুখে জনতা
তাদেরই জানাবেন সেলাম। ভুলে যাবেন অতীতের নারকীয় ঘটনা। দুনিয়ার এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে না বাংলাদেশে। মুক্তিযােদ্ধারা সহজে ছাড়বেন না। ভারত সীমান্ত থেকে ওরা চালাবেন গেরিলা তৎপরতা। অসহায় নয়াদিল্লী চেয়ে দেখবেন। পাক-বেতার শুরু করবে উল্টো প্রচার। পূর্ববাংলা শান্ত। তাকে অশান্ত করছে ভারতাশিত গেরিলারা। আর্তত্রাণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে পদে পদে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞের দল তখন বলবেন—কথাটি ফেলনা নয়।
শরণার্থী শিবিরগুলাে দেখতে এসে শ্রীমতী গান্ধী ভালই করবেন। তিনি বুঝতে পারবেন ‘দেখি কি হয় নীতির পরিণাম। সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটা বিরাট অঞ্চলকে ছারখার করছে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরের একটা হানাদার বাহিনী বিশ্ববিবেকের মাথায় দিনের পর দিন লাথি মারছেন ইয়াহিয়া খান। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে অত্যাচারিতের সেবার জন্য লােক দেখধন কলরব তুলছে। ঘাতকের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছেন তাদের জন্য কারাে মাথাব্যাথা নেই। ওদের সরকার পাচ্ছেন না কূটনৈতিক স্বীকৃতি। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে আসছে না অস্ত্রশস্ত্র। এই রাষ্ট্রগুলাের মুখ চেয়ে বসে আছেন নয়াদিল্লী। ঘরের পাশে একটা পশু শক্তির বিরুদ্ধে কক্রিয় ব্যবস্থা নিতে পারল না ভারত। তার এই দুর্বলতার জের চলবে দীর্ঘদিন। বাইরের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলাের কোন আস্থা থাকবে না নয়াদিল্লীর উপর। তাদের শক্তির আড়ম্বর দাগ কাটবে না কারও মনে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের মর্যাদাহানির পরিপূরণ করতে পারবে না নিষ্ক্রিয় নৈতিক বাক্যবিন্যাস। শ্রীমতী গান্ধীর জন্য অপেক্ষা করছে শরণার্থীদের বুক ফাটা কান্না। চোখের সামনে যারা নিহত হতে দেখেছেন প্রিয়জনদের, কি দিয়ে তিনি তাঁদের দেবেন সান্তনা। প্রতিশােধের জন্য বাংলাদেশের সাচ্চা তরুণ-তরুণীরা পাগল। তাদের সামনে কি দৃষ্টান্ত রেখেছেন নয়াদিল্লী? ভারতীয় অঞ্চলে পড়ছে পাক-কামানের গােলা। মরছেন ভারতীয় নাগরিক। সীমান্ত রক্ষীদের অপহরণ করছে পাক-হানাদাররা। শুধুমাত্র কড়া নােট পাঠিয়েই কর্তব্য বােধ করছেন কেন্দ্রীয় সরকার। শক্তিমানের শক্তির আস্ফালনের বাস্তব প্রয়ােগ নেই যেখানে সেখানে সে হতে পারে না অন্যের শক্তির প্রেরণা। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রয়ােজন ছিল শ্রীমতী গান্ধীর। হয়ত তিনি পাবেন তা শরণার্থী শিবিরগুলিকে।
নয়াদিল্লীর হাতে আছে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের সার্টিফিকেট। অমানবিক সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তারা। শত শত জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। দশ লক্ষ নরনারীর রক্তে ভেসে গেছে পথঘাট। এবং কুকুরের দল গলিত শব নিয়ে করছে টানাটানি। কোটি কোটি টাকা এবং রাশি রাশি সােনা রূপা পাচার হয়েছে পাকিস্ত নে। হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা। তিরিশ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা নিয়ে ধুকছে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলাে। ভারতের আকাশ সীমা এবং সীমান্তরেখা লজ্জিত হচ্ছে বারবার। ঢাকায় রয়েছেন ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীরা আটক। তা সত্ত্বেও ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গেনি নয়াদিল্লীর। ধরিত্রীর মত এই সর্বংসহা আচরণের অসংখ্য সাধুবাদ দিয়েছে বৃটেন, সােভিয়েট রাশিয়া এবং আমেরিকা। নিজেদের ঘাড়ে যখন এসে পড়ে নিরাপত্তার সমস্যা তখন তাদের মধ্যে দেখা যায় না বহু প্রশংসিত এই সংযম। তার প্রমাণ, কিউবার মার্কিন অবরােধ, হাঙ্গেরী এবং চেকোশ্লোভকিয়ায় সােভিয়েট প্রতিরােধ এবং ১৯৫৬ সালে বৃটেনের সুয়েজ অভিযান। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে এগুলাের তুলনা চলে না। এ অঞ্চলের সংগ্রাম গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং সংখ্যালঘু ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠদের লড়াই। ভারতের উপর চলছে তার প্রত্যক্ষ জের। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ভেবে দেখুন তিনি বৃহৎ শক্তিগুলাের দেওয়া সার্টিফিকেট সােনার ফ্রেমে বাধিয়ে রাখবেন, না ছুড়ে ফেলে। দিয়ে আত্মশক্তিতে বাস্তব অবস্থার মােকাবিলা করবেন?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ মে ১৯৭১