বাংলার বাণী
৮ই জুলাই, রবিবার, ১৯৭৩, ২৩শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
আইন-শৃঙ্খলা ও নিহতের সংখ্যা
জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর প্রদানকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দেওয়া লিখিত তথ্য বিবরণী অনুসারে জানা যায়, ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকে ১৯৭৩ সালের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ২,০৩৫ জন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন এবং ১৯৭৩ সালের ১৫ই জুন পর্যন্ত দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন মোট ৪ হাজার ৯শত ২৫ জান। একই সময়ে ৩৭৭ জন মহিলা অপহৃত হন এবং ১৯০ জন মহিলাকে অসম্মান করা হয়েছে বলেও তথ্য বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে ২৫৪টি মোটর গাড়ী হাইজ্যাক করা হয়েছে এবং এর মধ্যে ১০টি পরিত্যক্ত গাড়ীসহ ১৯৬টি গাড়ী উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় প্রদত্ত লিখিত তথ্য বিবরণী অনুসারে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর সতেরো মাসে অর্থাৎ ৪৮৬ দিনে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ২,০৩৫ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে চার জনেরও কিছু বেশী সংখ্যক ব্যক্তি হত্যার শিকার হয়েছেন। এবং ৫৩২ দিনে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন ৪,৯২৫ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন ৯ জনেরও বেশী। অথবা বলা যায়, প্রতি আড়াই ঘন্টা পর পর একজন করে ব্যক্তি দুষ্কৃতিকারীর হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়, একই তথ্য বিবরণী অনুসারে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিদিনই একজন করে মহিলা অপহৃত হয়েছেন এবং প্রতি আড়াই দিন পর একজন করে মহিলা অসম্মানিতা হয়েছেন। অবশ্য উল্লেখিত সময়ে চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ ইত্যাদির সংখ্যা কত তা জানা যায়নি। তবে শুধু এইটুকুই জানা গেছে, উল্লেখিত ঘটনাগুলোর জন্যে মাত্র ১৯ জন অভিযুক্তের বিচার হয়েছে এবং ৪শত ৪৩ জন বিচারাধীন রয়েছেন।
যাই হোক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের দেয়া সংক্ষিপ্ত তথ্য বিবরণীটিতে স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে এ পর্যন্ত দেশের আইন শৃঙ্খলা কিরূপ ছিলো এবং আছে তারই একটা সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান ও বিচারের গতি দেখে এ ব্যাপারে সরকারী কর্মতৎপরতা কিরূপ তাও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, অল্প কিছুদিন আগেও মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রীগণ দেশের আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে বলে দাবী করেছেন। প্রতি আড়াই ঘন্টা পর পর যেখানে দুষ্কৃতির হাতে প্রাণহানি ঘটছে সেখানে আইন-শৃঙ্খলা কতটুকু উন্নত তা বলাই বাহুল্য। অথচ তারপরেও বরিশালের দু’টো থানায় দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণ, আওয়ামী লীগ কর্মী খুন ইত্যাকার খবর নিয়মিত প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে।
একটি সশস্ত্র সংগ্রামের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা বেশ কিছুদিন পর্যন্ত নাজুক থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন তা একই রকম থাকতে পারে না। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এবং এ বিষয়ে কঠোর হলে অবশ্যই তা উন্নতি ঘটতে বাধ্য। এবং এ ব্যাপারে আমরা বহুবার সরকারকে কঠোর হস্তে দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করার জন্যে আহ্বান জানিয়েছি এবং জনগণের সহযোগিতার কথাও বলেছি। আজও আমরা একই কথা পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, যে কোন মূল্যে সরকারকে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি সাধন করতেই হবে। তা না করে কুকুর-বেড়ালের মতো দেশের জনগণকে মরতে দেওয়া যায় না। তাহলে দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে নানা সমস্যারই সৃষ্টি হবে। সুতরাং আমাদের বক্তব্য আর এতটুকু কালবিলম্ব না করে দুষ্কৃতিকারীদের দমনের ব্যাপারে সরকার কঠোর হন। এবং এ কাজে জনগণ ও সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা দান করবেন বলে আমরা দৃঢ় আশা পোষণ করি।
স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের ধর্মঘট
বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুলের আশি হাজার শিক্ষক অতঃপর ধর্মঘটকেই তাদের দাবী আদায়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কলেজ শিক্ষকরা তো আগে থেকেই ধর্মঘট করে আসছিলেন। বেসরকারী কলেজের প্রায় দশ হাজার শিক্ষক বিগত এগারোই মে থেকে এই ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে আসছেন। মাধ্যমিক শিক্ষকদের দাবীর মধ্যে সরকারী এবং বেসরকারী শিক্ষায়তনের বৈষম্য দূরীকরণ ছাড়াও সকল শিক্ষায়তনের শিক্ষকদের জন্যে মেধা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি জাতীয় বেতনের স্কেল ঘোষণা, যতদিন সরকার সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে না পারছেন ততদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের জন্যে ঘাটতি ভিত্তিক গ্র্যান্ট বরাদ্দ, পেশাগত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা প্রশাসনে স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উল্লেখ রয়েছে। কলেজ শিক্ষকদের দাবীর মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী কলেজের বৈষম্য দূরীকরণ সহ কলেজ শিক্ষা জাতীয়করণের প্রস্তাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দাবীগুলোর যথার্থতা এবং তা পূরণের সামর্থ্য কতটুকু সরকারের রয়েছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জানার কথা। শিক্ষা জাতীয়করণের ব্যাপারে কলেজ শিক্ষকরা যখন কলেজ শিক্ষা জাতীয়করণের দাবী জানিয়েছেন তখন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকদের ‘যতদিন পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা সম্ভব না হয় ততদিন পর্যন্ত ঘাটতি ভিত্তিক গ্র্যান্ট বরাদ্দের’ দাবী বাহ্যত অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। সরকারী এবং বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসানের জন্যে স্বাধীনতার দেড় বৎসর পরও শিক্ষকদের যে আন্দোলনে নামতে হবে এটা ভাবতেও কেমন আশ্চর্য লাগে। নগণ্য সংখ্যক ছাত্রের জন্যে শিক্ষার বিশেষ সুযোগ সুবিধাদান অথবা সে সকল শিক্ষায়তনে কর্মরত শিক্ষকদের জন্যে সরকারের বিশেষ নেক নজর এটা অভিপ্রেত নয়। শিক্ষাপ্রশাসনে স্বায়ত্তশাসন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী শুধু শিক্ষকদের নয় আপামর জনসাধারণ তথা আজকের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেরও।
অথচ শিক্ষকদের এই দাবী দাওয়ার প্রশ্নে আজ পর্যন্ত সরকারের কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য আমরা জানতে পারিনি। শিক্ষকরা এ নিয়ে দেন-দরবার করেছেন। হঠাৎ করে ধর্মঘটের মতো চরম ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেননি। এমনিতেই এই শিক্ষাবিদেরা ঔপনিবেশিক আমল থেকেই নানা প্রকার নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে শিক্ষার মান উন্নয়ন তথা শিক্ষক সমাজের সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত ছিলো। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা নেহায়েত স্বল্প নয়। জানি হানাদারদের হামলায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট হয়েছে। এগুলো সংস্কার এবং নির্মাণের জন্য অর্থ আবশ্যক। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং উন্নয়নের নামে যে বাড়তি টাকা কন্ট্রাক্টর, টাউটদের পকেটে গিয়ে জমা হবে সেদিকটার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে সরকার যদি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা দানে বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার করেন তবে সমস্যার অন্ততঃ ন্যূনতম একটা সমাধান পাওয়া যেতে পারে। যাইহোক সরকার কতটুকু করতে পারেন তা সরকারেরই জানবার কথা। আমরা শুধু বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে দেশের ৮০ হাজার মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক এবং প্রায় দশ হাজার কলেজ শিক্ষক যখন ধর্মঘটের পথ বেছে নিয়েছেন এবং আঠারো লাখ স্কুল ছাত্রসহ বাইশ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে রয়েছে তখনও কেমন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কুম্ভকর্ণের নিদ্রা যাচ্ছেন?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক