You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৭ই জুলাই, শনিবার, ১৯৭৩, ২২শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক চুক্তি

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত পরশু। সেপ্টেম্বরের আটাশ তারিখ থেকে এই চুক্তি কার্যকরী হবে। চুক্তির মেয়াদকাল তিন বৎসর। এই মেয়াদকাল উভয় সরকারের সম্মতিক্রমে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। পুরোন চুক্তিটি আসছে সেপ্টেম্বর মাসের সাতাশ তারিখ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। চলতি চুক্তির মেয়াদকাল ছিলো এক বৎসর। কিন্তু এই সময়কালের মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় বাণিজ্য সম্পন্ন না হওয়ায় একদিকে যেমন সেই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়েছে, অন্যদিকে আবার তেমনি সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চলতি চুক্তিতে দু’দেশের মধ্যে পঁচিশ কোটি টাকার বাণিজ্যিক লেনদেনের কথা ছিলো।
নতুন যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে তার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা হয়েছে ত্রিশ কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতে কাঁচা পাট, মাছ, নিউজপ্রিন্ট, চামড়া, আয়ুর্বেদী ও ইউনানী ঔষধ, বই, সংবাদপত্র ও সাময়িকী, চলচ্চিত্র, ঔষধ, মশলা, শিমুলতুলা ইত্যাদি রপ্তানী করবে। আর এর বিনিময়ে সে আমদানী করবে কয়লা, তামাক, সিমেন্ট, তুলা, সূতা, সূতিবস্ত্র, সাইকেল ও খুচরো যন্ত্রপাতি, চুনাপাথর, বোল্ডার, ভোলামাইট, শক্ত কাঠ, বই, সংবাদপত্র ও সাময়িকী, বাদ্যযন্ত্র, আয়ুর্বেদী ও ইউনানী ঔষধ, গাছ-গাছড়া, রাসায়নিক দ্রব্য ও ঔষধপত্র মশলা, যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি, টুথব্রাশ, পেস্ট, ক্রীড়া সরঞ্জামাদি, চলচ্চিত্র প্রভৃতি।
গত বৎসরের বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে উভয়দেশেই নানা কথা উঠেছে, বিতর্ক হয়েছে। আমরা ভারতকে যে সকল দ্রব্য রপ্তানী করতে পারবো বলে কথা দিয়েছিলাম তা রক্ষা করতে পারিনি। কোন প্রকার হিসেব ছাড়াই আমরা আমাদের দু’দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ নির্দিষ্ট করেছিলাম। মাছ রপ্তানীর পরিমাণ যা নির্ধারিত হয়েছিলো তা যেমন আমরা রপ্তানী করতে পারিনি তেমনি নির্দিষ্ট পরিমাণের চাইতে অনেক অনেক বেশী পাট রপ্তানী করবার মতো ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উন্মুক্ত মাঠে প্রচুর পাট আমাদের বিনষ্ট হয়েছে। এ নিয়ে দু’দেশে কথা উঠেছে, ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দু’দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বুদ্ধি করা গেলে যেমন উভয়ের কল্যাণ সাধিত হতে পারে, তেমনি পরিকল্পনাহীন বাণিজ্যে আমাদের উভয় দেশের ক্ষতি এবং ফলশ্রুতি স্বরূপ দু’টো দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। এজন্যেই প্রয়োজন প্রথমে নির্ধারত হওয়া কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতি আমাদের অর্থনীতির সহায়ক আবার তেমনি এটাও নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতি ভারতীয় অর্থনীতির সহায়ক। সুস্পষ্টরূপে এই ক্ষেত্র নির্ধারিত না হলে এবং সস্তা রাজনৈতিক শ্লোগানের মুখে বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করা হলে বাংলাদেশ-ভারত উভয়েরই অকল্যাণ হবে। চলতি চুক্তির চাইতে অবশ্য এবারকার চুক্তিতে এই বাস্তবতার অধিকতর প্রতিফলন ঘটেছে। এটাকে কার্যকরী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গৃহীত হবে বলে আশা করি। চলতি চুক্তির লেন-দেনের ঘাটতি যেমন শুভেচ্ছার নির্দশন স্বরূপ ভারত আগামী বাণিজ্য বৎসরে পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ দিয়েছে এমন সুযোগ যেন আগামী বৎসরেও গ্রহণ করতে না হয়।

বহু রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না

গত পরশু দিন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের ঢাকা শহর শাখার বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান। জনাব কামরুজ্জামান তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, ‘দেশের যুবশক্তিই হলো জাতির মূলশক্তি, যে জাতির যুবসমাজ নির্জীব সে জাতির জাতীয় কাঠামোও দুর্বল।’ তিনি দেশের যুবসমাজকে কর্মঠ, চরিত্রবান ও আদর্শবান হিসেবে দেশের সেবার জন্যে প্রস্তুত হবার আহ্বান জানান। যারা দেশের মানুষকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে নিজেদের কর্মে প্রতিফলিত করবে সে জাতির কখনও মৃত্যু হতে পারবেনা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন—‘আমরা সত্যি সৌভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা আমরা পেয়েছি। তার মহান আদর্শকে অনুসরণ করতে পারলে জাতির জীবনের সকল দুঃখ মোচন সম্ভব।’
সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি তাঁর ভাষণে পুরোনো আইনের পরিবর্তন করে নতুন সংবিধান অনুযায়ী নতুন আইন প্রবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যে পুঁজিবাদী প্রশাসনিক কাঠামো পেয়েছি এবং যে সকল পুরোনো আইন পেয়েছি যুবলীগ প্রধান তার আশু পরিবর্তন দাবী করেছেন। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্যে পুরোনো প্রশাসন ও আইন সম্পূর্ণ অচল। নতুন দেশের জন্যে নতুন আদর্শের কথা ঘোষণা করে পুরোনো প্রশাসন ব্যবস্থা ও আইন চালু রেখে কোনক্রমেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোন্ কোন্ জাতি আমাদের শত্রু এবং মিত্র তা চিহ্নিত করে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, মিল-কারখানার উৎপাদন বাড়ছে এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পেলে সকল মিল-কারখানাই যথোপযুক্ত উৎপাদন দিতে সক্ষম হবে। যুবলীগ প্রধান তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে যুবসমাজকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান। দেশের আভ্যন্তরীণ শত্রুমহল স্বাধীনতাকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন উপায়ে হেয় প্রতিপন্ন করার যে ষড়যন্ত্র করছে তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এবং তিনি মনে করেন জাতির মুক্তির জন্যে যারা সংগ্রাম করেছিলো তাদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস বিকৃত করার এই ষড়যন্ত্র কোনক্রমেই ছোট করে দেখার বিষয় নয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সন্ধ্যায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় সম্মেলনের পক্ষ থেকে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন। তিনি দেশে আত্মনির্ভরশীল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্যে উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা ‍উল্লেখ করেন। দেশের বিপুল জনশক্তিকে উৎপাদনের কাজে যথার্থ ব্যবহার করারও তিনি আহ্বান জানান। ‘বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কাজে যুবসমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনায় ভাষণদানকালে তিনি কাজ না করার প্রবণতার জন্যেই সকল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার জন্যে যুবসমাজকে সর্বাত্মক এগিয়ে আসারও তিনি আহ্বান জানান। তাঁর মতে, দেশের সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে যদি যুবশক্তিগুলো সত্যিকার অর্থে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে।
বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলায় নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ার কাজে যুবসমাজের নেতৃত্ব অপরিহার্য। বিশেষ করে যারা দেশের স্বাধীনতা সার্থক করে তোলা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংকল্পবদ্ধ সেই যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সকল স্বার্থ ও দ্বন্দ্বের উঠে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জন করাই হবে একমাত্র উদ্দেশ্য। আমরা মনে করি যুবসমাজকে অবশ্যই সততা ও আত্মোৎসর্গের মহৎ সংকল্প নিয়ে দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের স্বাধীনতার জন্যে যে ত্যাগ ও তিতিক্ষা একদিন প্রদর্শন করতে হয়েছিলো ঠিক তেমনি প্রত্যয় নিয়েই দেশের শত্রুর মোকাবেলায় আজ আবার নতুন সংগ্রামী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কেননা বহু রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা কোনক্রমেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।

কি বিচিত্র এই পৃথিবী! কি বিচিত্র মানুষের মন!

প্রিয়জনকে কাছে পাবার জন্য যুগে যুগে কত মর্মান্তিক ঘটনাই না ঘটেছে। সে সব ঘটনা শধু ঘটনা হয়েই থাকেনি, তা ইতিহাসের পাতায়ও স্থান পেয়েছে। এবং এটাই শাশ্বত। অথচ আবার আপনজনকে কাছে না পাবার দুঃসহ বেদনায় কত সম্ভাবনাময় জীবন যে অকালে বিনষ্ট হয়েছে, ঝরে পড়েছে তারইবা সংখ্যা কম কোথায়। প্রেয়সী তার প্রিয়তমাকে না পেয়ে অথবা প্রেমিক তার প্রেয়সীকে চিরদিনের জন্য কাছে ধরে না রাখতে পেরে হয়ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়েছে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করে চিরদিনের মত দূর করেছে প্রিয়জনকে না পাবার দুঃসহ বেদনা। প্রিয়জনকে না পাবার জ্বালা যে কি মর্মান্তিক তা নাকি বোঝানো যায় না, তা কেবল অনুভবেরই। তাই এই জালাকে ধিক ধিক করে জলা তুষে আগুনের সংগে তুলনা করে কবিরা কাব্য করেছেন, চারণ কবিরা গান লিখেছেন। তুষের আগুনের অস্তিত্ব বাইরে থেকে সুস্পষ্ট না বোঝা গেলেও সে আগুন যেমন সব কিছু জালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারে তেমনি প্রিয়জনকে না পাবার বেদনা মানুষকেও তিলে তিলে দগ্ধ করে খাক করে দেয়। তাইতো এ জালা বড় মর্মান্তিক। অথচ তবু এই না পাওয়ার বেদনার মধ্যেও আবার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ এক অনাবিল আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন না পাওয়ার বেদনা মধুর। কিন্তু কথা সেটা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখ-শান্তি ও তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে ভরা একটি সুখী পরিবার যে ইচ্ছে করে বিরহ চাইতে পারে এ কথা শুনে কার না বিস্ময় জাগে ? যে মধুর সম্পর্কের জন্য সাধনা আর শ্রমের অন্ত নেই সেই মধুরতর সম্পর্ক থেকে স্ত্রী স্বামী থেকে সাময়িক বিরহ চাইতে পারে এ যে কল্পনাই করা যায় না। অথচ তাই চেয়েছেন লাস্যময়ী অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর। তিনি তার অভিনেতা স্বামী রিচার্ড বাটনের কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকতে চান। না, উভয়ের মধ্যে কোন মান অভিমান কিংবা মতানৈক্যের জন্য নয়, একের প্রতি অন্যের অবিশ্বাসও নয়। বরং ঠিক তার উল্টো কারণে। এলিজাবেথ টেলর বলেছেন, তারা এখন যে জীবন কাটাচ্ছেন তা নিতান্ত এক ঘেয়ে অসহ্য। তাদের উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের এতই ঘনিষ্ঠতা অর্থাৎ উভয়ে উভয়কে এত বেশী ভালোবাসেন যে একে যেন অপরের পকেটের মধ্যে ঢুকে আছেন। তাই তিনি চান কিছু দিনের জন্য উভয়ে উভয়ের পকেট থেকে বেরিয়ে জীবনে নতুনত্ব আনতে, সাময়িক বিরহের স্বাদ গ্রহণ করতে।
সত্যি কি বিচিত্র এই পৃথিবী আর কি বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষের মন। এই জন্যই বোধ করি অনেক মনস্তত্ত্ববিদ, দার্শনিক, মুনিঋষিরা নারী মনের দুর্জেয় রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম না হয়ে শেষ পর্যন্ত বলেছেন, দেবতারাই নারী মনকে বুঝতে পারেন নি, আমরা তো কোন ছার। তবুও বলবো এলিজাবেথ টেলর এবং রিচার্ড বাটনের সুখী দম্পতির মত পৃথিবীর প্রতিটি পরিবার যদি মধুর সম্পর্ক যুক্ত থেকে কেবল জীবনে কিছুটা বৈচিত্রতার জন্য সাময়িক বিরহ চাইতো তাহলে সে পৃথিবীটা কেমন হতো ?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!