বাংলার বাণী
৬ই জুলাই, শুক্রবার, ১৯৭৩, ২১শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
আমরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মিঃ বুমেদিনের বিশেষ দূত মোহাম্মদ ইয়াজিদ সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। সংবাদে প্রকাশ, গত পরশুদিন সন্ধ্যা জনাব ইয়াজিদ রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আলজেরিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের রাষ্ট্রপতি বলেছেন—‘ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণা উল্লেখিত উপমহাদেশের মানবিক সমস্যার সমাধানের জন্যে বাংলাদেশ যে উদ্যোগ নিয়েছে তা খুবই বলিষ্ঠ এবং তাতে উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক নয়া যুগের সূচনা হবে।’ রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ও আলজেরিয়ার জনগণ জোটনিরপেক্ষতার আদর্শ সহ বহু আন্তর্জাতিক বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করে আসছে। এছাড়া জোট নিরপেক্ষতার নীতিই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগণ সব সময়ই আরবদের বিশেষ করে আলজেরিয়ার জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর জনগণকে সমর্থন করে এসেছে।’ রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন জনাব মোহাম্মদ ইয়াজিদের এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বীকৃতি দানেরই সামিল।
একথা আজ সম্পূর্ণ সত্য যে, বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। উপমহাদেশীয় শান্তির জন্যেও বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। পরিশেষে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত যোষণার মাধ্যমে তা আরও সুস্পষ্ট আকারে ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের সঙ্গে বাংলার দুখীমানুষ সব সময়ই একাত্মতা ঘোষণা করে এসেছে। আরব জাতিসমূহের ন্যায্য দাবী দাওয়ার সঙ্গেও আমাদের দেশের জনগণ ঐক্যমত পোষণ করে। বিশেষ করে আলজেরিয়ার মানুষের সংগ্রামের প্রতি সম্পূর্ণ সহৃদয়তা রয়েছে। জোট নিরপেক্ষতার মাধ্যমে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ নিয়েছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রনীতির। সর্বোপরি আলজেরিয়ার সংগ্রামী মানুষ যেমন শান্তি ও সহঅবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী আমরাও তেমনি। কিন্তু উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনে বাঁধ সাধছে পাকিস্তান। সে বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে আজো দরকষাকষি করে চলেছে। নিরীহ নিরপরাধ বাঙালীদেরকে আটকে রেখে যুদ্ধাপরাধীদের বিনাবিচারে ছাড়িয়ে নেবার কৌশল খুঁজছে। ভারতের সঙ্গে বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন কার্যকলাপের সূত্রপাত করছে। এমতাবস্থায় উপমহাদেশে শান্তি স্থাপিত হতে পারেনা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে রণ পাঁয়তারার জল্পনা কল্পনা ছড়ানো হচ্ছে। আমেরিকা এবং চীন নতুন খেল জমানোর প্রচেষ্টা করছে। এবং এ সকল কারণে উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু শান্তি ও সহঅবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী সেহেতু সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে আমরা মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ মুছে ফেলতে চাই। এবং স্থায়ী পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে চাই।
উৎপাদন বৃদ্ধির ডাক
পুনরায় উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষেতে-খামারে-কলে-কারখানায়, পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন চালিয়ে যাবার ‘দাবী’ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু গত পরশু পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণদান করেন। তারা এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে, তাদের নানা অভাব অভিযোগ সম্বন্ধে প্রাণপ্রিয় নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে। বঙ্গবন্ধু তাদের অভাব অভিযোগ ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করেন এবং সর্বশেষ শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাঁর একটিমাত্র দাবী রাখেন। তিনি বলেন, তাঁর এই দাবী তথা দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেই শ্রমিকদের সমস্যা সমাধাণ তথা দেশের কল্যাণ সম্ভব। এতে করে জিনিসপত্রের দাম কমবে, মজুরী বাড়বে শ্রমিকদের।
স্বাধীনতাত্তোরকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা এবং অকর্ষিত ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন চালু করা এবং ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন বন্ধ কারখানার দুয়ার খুলতে; বিনষ্ট কারখানা উৎপাদনক্ষম করে তুলতে। একেবারে শূন্যের কোঠা থেকে আমাদের সেদিন যাত্রা হয়েছিলো শুরু। আজ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না হলেও উৎপাদন বেড়েছে। শ্রমিকদের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে।
এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয় যেখানে শ্রমিকদের উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন বাড়েনি ; দিনের পর দিন কারখানা বন্ধ থেকেছে। কাঁচামালের অভাবই এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হবার জন্য দায়ী। মিল মালিক অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের প্রশাসকদের অদূরদর্শিতা এবং অব্যবস্থা বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অসৎ প্রশাসক এবং জাতীয়করণ বিরোধী আমলাদের চক্রান্ত দেশের উৎপাদন ব্যাহত করবার ব্যাপারে কম রসদ যোগায়নি। এতসব সত্ত্বেও এমন বহু শিল্প কারখানা রয়েছে যেখানে উৎপাদন বাড়ছে, কোন কোন স্থানে স্বাধীনতা পূর্বকালীন উৎপাদন সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে, আবার কোথাও কোথাও উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
শ্রমজীবী মানুষ মূলতঃ দেশপ্রেমিক। তাদের দেশপ্রেম নিখাদ; কোন স্বার্থচিন্তা তাদের দেশপ্রেম থেকে বিচ্যূত করতে পারে না। কিন্তু একশ্রেণীর শ্রমিক রয়েছেন যারা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অসৎ রাজনীতিক অথবা স্বার্থান্বেষী ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা এই সরলপ্রাণ শ্রমিকদের নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করে, নিজেদের অজ্ঞাতেই তারা না ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়। দেশে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে না উঠায় এবং শ্রমজীবী মানুষকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে না তোলায় এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এবং শ্রমিকদের সে বিভ্রান্তিরই সুযোগ গ্রহণ করে টাউট রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
আমাদের দেশে সামাজিক পরিবর্তনের প্রগতিশীল ধারাকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্যে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তি উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবেই তারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করছে। এ চক্রান্ত বাস্তবায়নে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহায়তা লাভ করছে সমাজতন্ত্রবিরোধী অসৎ প্রশাসক এবং আমলাদের নিকট থেকে। শ্রমিকদের উৎপাদন হ্রাসে প্ররোচিত করার স্বার্থান্বেষী মহলের প্রচেষ্টাও কম পরিলক্ষিত হয়না।
বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস শ্রমজীবী মানুষ তার এই আহ্বানে সতিকারভাবেই সাড়া দেবেন। এ সাড়া তারা দিয়ে এসেছেন বঙ্গবন্ধুর সকল আহ্বানে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চক্রান্তের গাঁটছড়াগুলোও ছাড়াতে হবে। শ্রমিকদের আস্থায় আনতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক