You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৪ঠা জুলাই, বুধবার, ১৯৭৩, ১৯শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আমদানী ত্বরান্বিত ও কলুষমুক্ত করতে হবে

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান আমদানী নীতি ঘোষণা করেছেন। গত পরশুদিন মন্ত্রী এক সাংবাদিক সম্মেলনে আগামী ‍জুলাই-ডিসেম্বর শিপিং মৌসুমের পণ্য আমদানী নীতি ও তথ্য ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা অনুযায়ী আগামী শিপিং মৌসুমে দুইশত পনেরো কোটি টাকার পণ্য বিদেশী থেকে আমদানী করা হবে। আমদানী নীতির মধ্যে খাদ্যদ্রব্য আমদানীর ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান বলেছেন—এই মৌসুমে যে সকল পণ্য আমদানী করা হবে তার মধ্যে প্রথম অগ্রাধিকার থাকবে খাদ্যদ্রব্য আমদানীর, দ্বিতীয় থাকবে বস্ত্র আমদানীর। সর্বোপরি সরকারের লক্ষ্য রয়েছে, যে সকল পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদনযোগ্য তা উৎপাদন করে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বিশেষতঃ বস্ত্র সমস্যা মোকাবেলার জন্যে দেশের সমস্ত বস্ত্র কারখানা পূর্ণ উৎপাদনক্ষম করে তোলাই সরকারের নীতি। এর জন্যে প্রয়োজনীয় তুলো ও সূতো আমদানী করা হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তাঁর নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—‘আমরা যতদূর সম্ভব কম পণ্য আমদানী করার পক্ষপাতী। এই নীতিকে সামনে রেখেই আমাদেরকে বাণিজ্য চালাতে হবে। কেননা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াই আমাদের জাতীয় লক্ষ্য।’ তিনি এ ব্যাপারে আরো বলেন—‘সরকারের চলতি আমদানী নীতি হলো অত্যাবশ্যকীয় জিনিস আমদানী নীতি—সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর নীতি। বাংলাদেশের বাণিজ্যকে রপ্তানীমুখী সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাই প্রধান লক্ষ্য।’ বাণিজ্যমন্ত্রী আরো উল্লেখ করেন, সীমিত সম্পদ ও অসীম চাহিদার সমন্বয় সাধনের দুর্জয় ইচ্ছা নিয়ে সরকারের আমদানী নীতি ঘোষিত হয়েছে।’ একে সার্বজনীন ও সাফল্যমন্ডিত করতে হলে জনগণের সহযোগিতা যে একান্ত প্রয়োজন সে কথাও মন্ত্রী জানান।
বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশের রপ্তানী বাণিজ্য বেশ খানিকটা সংকটাপন্ন। দেশের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার জন্যে রপ্তানী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। উৎপাদন নানা কারণে ব্যাহত। ফলে অত্যন্ত সঙ্গতকারণেই আমদানী বেশী করতে হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে গত স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে নানা বিপর্যয় চলছে। বন্যা ও খরার জন্যে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে খাদ্যদ্রব্য আমদানী স্বাভাবিকের চাইতে বেশী করতে হচ্ছে। এছাড়া যে সকল জিনিসপত্র উৎপাদনে কল-কারখানা ব্যর্থ হয়েছে বা চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না সে সকল জিনিস আমদানী করে অভাব পূরণ করতে হচ্ছে। দেশের এই সংকটাপন্ন অবস্থার মোকাবেলা করার জন্যে সরকারকে আমদানীর উপর যত বেশী নির্ভর করতে হবে ততবেশী পরিমাণে রপ্তানী করা সম্ভব হবে না। তবু যেহেতু লক্ষ্য রয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্যে রপ্তানী বৃদ্ধির এবং আমদানীর তুলনায় রপ্তানী বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের আর্থিক কাঠামো শক্ত করার সেহেতু দেশের বর্তমান অবস্থার মোকাবেলায় আমদানী তুলনামূলক ভাবে বৃদ্ধি পাবে। তবু আমাদের জাতীয় লক্ষ্য যদি মহৎ হয় এবং সরকারী প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয় তাহলে এই অসমতা বা আপাতঃ অসুবিধা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। দেশের মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ও দ্রব্যের বর্তমান সংকট পূরণের জন্যে আমদানী ত্বরান্বিত ও কলুষমুক্ত করা উচিত। সর্বোপরি যে করেই হোক বাণিজ্যক্ষেত্র থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ করে যথার্থ সৎ বাণিজ্যিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে সরকারকে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার এ কাজে পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হবেন।

তেল ও চিনির ডবল দাম

সাধারণ দোকানদারেরাও মিরাকল দেখাতে জানে। তাই কোন সরকারী ঘোষণা ছাড়াই অকস্মাৎ রেশনের দোকান সয়াবিন ও চিনির দাম বৃদ্ধি পেয়ে ডবল হয়ে গেছে। সয়াবিন ছয় টাকা এবং চিনি চার টাকা সের দরে দেওয়া হচ্ছে গত ২রা জুলাই থেকে।
এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারকে অধিক মাত্রায় সাবসিডি দিতে হচ্ছে এই যুক্তি দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট প্রস্তাবে ১লা জুলাই থেকে চাল ও গমের সঙ্গে তেল ও চিনির দামও বাড়ানোর কথা বলেছিলেন। সেই মোতাবেক রেশনের চাল প্রতিমণ ৪০.০০ এবং গম প্রতিমণ ৩০.০০ টাকা ধার্য করা হয়। কিন্তু তেল ও চিনির কি পরিমাণ দাম বাড়ানো হবে তা কিছু পরিষ্কার করে বলা হয়নি। খাদ্য দপ্তর থেকেও এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য পেশ করা হয়নি।
এমতাবস্থায় রেশনের দোকানে তেল ও চিনির মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তেল ও চিনির দাম বর্ধিত করার ক্ষমতা এরা কোথা থেকে পেলো এবং কেমন করেই বা এই আকস্মিক ঘটনাটি ঘটতে পারলো—এটাই জনসাধারণের বর্তমান জিজ্ঞাসা।
সাধারণ মধ্যবিত্তদের জীবনে রেশন সামগ্রীই বাঁচার সহায়ক। খোলা বাজারের চাল, গম, চিনি ও তেল কিনে সংসারধর্ম পালন করার কথা এঁরা কল্পনাও করতে পারেন না। মূলতঃ রেশনের চাল, গম ইত্যাদি প্রতি সপ্তাহে তোলেন এবং বাকী ঘাটতি পূরণ করেন বাহির থেকে দ্রব্য সামগ্রীগুলো কিনে এনে। এই দুই-এ মিলে জোড়াতালি দিয়েই বাঁচার সংগ্রামে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন জীবন কাটাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা—এ মূল্য বৃদ্ধির আঘাত এসেছে আকস্মিকভাবে। জনমানস এর জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। মাসের শুরুতে এবং নয়া অর্থবছরের শুভ উদ্বোধনের মুহূর্তেই প্রায় প্রতিটি সাধারণ মধ্যবিত্তের শহুরে জীবনে তাই বিপর্যয়ের ঝড় শুরু হয়ে গেলো। তাদের চোখের সামনে কষ্টকর দিনগুলো ছবি উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সংশ্লিষ্ট মহলের অনুক্ত ঘোষণাকে রেশন দোকানদারেরা তাদের মতো করেই ব্যবহার করতে পারলো বলেই হয়তো তেল ও চিনির ডবল দাম হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তাদের তৎপরতা থাকলে এই হারে দাম বাড়তো কিনা সন্দেহ! অন্যদিকে বেসরকারী ভাবে সয়াবিন ও চিনির মূল্য বৃদ্ধিতে বাজার থেকে রাতারাতি উক্ত দ্রব্য সামগ্রী উধাও হয়েছে। খোলা বাজারে এখন অত্যন্ত চড়াদামে তেল ও চিনি বিক্রির মহড়া চলছে। কথায় বলে—মানুষ প্রয়োজনের দাস। তাই ঠেকে গেলে তেল ও চিনি কিনতেই হবে। কিন্তু এমন করে আর কতদিন চলা যায়? জনজীবনের চারিদিকের এই ঘনায়মান সমস্যাগুলোর সমাধানতো একটা দিতে হবে?

অর্থের অভাব ও শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা

অর্থের অভাবে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবেনা বলে মাননীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা বিষয়কমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বাধিক মঞ্জুরীদান করা হয়েছে, কারণ শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়া কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন, আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী সরকার প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করে যাবেন।
গত তিরিশে জুন বি.পি.আই. পরিবেশিত শিক্ষা দফতরের প্রদত্ত তথ্য অনুসারেই জানা যায়, মুক্তি সংগ্রামের সময় ৬০ ভাগ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঐ সূত্রে আরো বলা হয়েছে, ১০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, এক হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। সে তথ্য বিবরণীতে আরো বলা হয়েছে, বিদ্যালয় গৃহ ছাড়াও বিদ্যালয়ের গবেষণাগার ও কার্যালয় সমূহ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে এবং ৬০ লাখ তালিকাভুক্ত প্রাথমিক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে বেশীর ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরই ব্যক্তিগত জিনিসসহ পাঠ্যপুস্তক হারিয়েছে। কেবলমাত্র প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষতির খতিয়ানে শিক্ষাঙ্গনে যে ব্যাপক ক্ষতির হিসাব পাওয়া গেছে তার উপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও ক্ষতির অংক যোগ হলে তার পরিমাণ কিরূপ দাঁড়াবে তা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য যে, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষার কথা ঘোষণার মাত্র ৬ মাস পরে আর্থিক সংকটের জন্যে সরকারকে সে ঘোষণা বাতিল করতে হয়েছে। এই ক’মাসে মেয়েরা বেতন না দেবার ফলে মেয়েদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার সকরুণ সংবাদও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক হারে প্রকাশ পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও যখন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের কন্ঠ থেকে ‘অর্থের অভাবে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে না’ বলে বলিষ্ঠ ঘোষণা শোনা যায় তখন আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয় বৈকি! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নটিও মনে জাগে, বিনা বেতনে মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করে পরে তা বাতিল করার মতো মন্ত্রী মহোদয়ের এ উক্তি আবার বাতিল করতে হবে না’ত?
প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য যে, এখনো বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাঁদের ৭-দফা দাবী পূরণের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন। অন্যদিকে বেসরকারী কলেজের শিক্ষকরাও তাঁদের দাবী আদায়ের প্রেক্ষিতে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং সব কিছু মিলিয়ে সরকারী ঘোষণা এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে বেশ খানিকটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাই হোক, এতদসত্ত্বেও আমরা বলবো, সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা লাভের গুরুত্ব হচ্ছে প্রথম শর্ত। সুতরাং আমাদের দেশেও এখন সর্বপ্রথম প্রয়োজন শিক্ষা বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে গণমুখী শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে গড়ে তোলা। কাজেই দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করবো, কোনক্রমেই যেন শিক্ষা ব্যাপারে কেনা প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি না হয়। আমরা আশা করবো, অতীতের ভুল ভ্রান্তির মতো ভবিষ্যতে যেন কোন ঘোষণা বা প্রকল্প বাস্তবায়ানের রদবদল করার প্রয়োজন দেখা না দিয়ে বরং নির্ধারিত ঘোষণা বা প্রকল্প অনুসারে কাজগুলো বাস্তবায়িত হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!