You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২০শে জুলাই, শুক্রবার, ১৯৭৩, ৪ঠা শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অধিকতর কঠোরতার সঙ্গে আগাতে হবে

রাজশাহী জেলার বিভিন্ন থানায় উগ্রপন্থীদের তৎপরতা সম্পর্কে খবরাখবর স্বাধীনতার পর থেকেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়ে আসছিলো। প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উগ্রপন্থীদের একটি শক্ত ঘাঁটি আক্রমণ করে। সেনাবাহিনীর এই আক্রমণাভিযানে অসংখ্য উগ্রপন্থী গ্রেফতার হয়, আত্মসমর্পণ করে তাদের প্রথম সারির বেশ কিছু নেতা। যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো তারা জেলার বিভিন্ন অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্রমে ক্রমেই এ অঞ্চলে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গে তৎপর হয়ে উঠে। গুপ্তহত্যা, রাহাজানি, ডাকাতির সংবাদ প্রায় প্রতিদিনই এই অঞ্চল থেকে আসতে থাকে।
আমরা বহুবার এই এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ কঠোরতার সঙ্গে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসবেন সেই আহ্বান আমরা বার বার জানিয়েছি। অবশেষে গত বুধবার সরকারী সূত্রে বলা হয়েছে যে, পুলিশ, বি.ডি.আর এবং রক্ষীবাহিনী জেলার বিভিন্ন থানা থেকে একশত ছিয়াত্তর জন উগ্রপন্থীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে এস.এম.জি. স্টেনগান এবং রাইফেল সহ বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
বস্তুতঃ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একশ্রেণীর দুষ্কৃতিকারীর তৎপরতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, শান্তিকামী কোন মানুষ এতে ‍উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারেনা। এরই সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের কর্তব্যের শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগও রয়েছে। ব্যাংক লুট, ডাকাতি এবং সর্বশেষে থানা ফাঁড়ি আক্রমণের সংবাদ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। বিলম্বে হলেও অবশেষে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত তারা নড়ে চড়ে বসেছেন। রাজশাহীতে দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। খবর পাওয়া গিয়েছে এমন আরো দু’একটি এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকার দুষ্কৃতিকারীদের দমনে সফল হলে জনগণের জীবনে যে নিরাপত্তাবোধ ফিরে আসবে দেশ পুনর্গঠন তথা প্রগতির পথে আমাদের অগ্রাভিযানে তা একান্ত আবশ্যক। সরকার সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করছেন অন্ততঃ সেই বিশ্বাসই আমরা আপাততঃ করবো। আর এটাই যদি লক্ষ্য হয় তবে সরকারকে অধিকতর কঠোরতার সঙ্গে অগ্রসর হবার জন্যও আমরা আহ্বান জানাবো।

উভয় দেশের স্বার্থেই সুষ্ঠু পানি বন্টন প্রয়োজন

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বন্টনের বিষয় নিয়ে উভয় দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক সম্প্রতি শেষ হয়েছে। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমেদ গত পরশুদিন দেশে ফিরে এসে গঙ্গার পানি বন্টনের বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট আলোচনার বিষয়বস্তু জানিয়েছেন। দু’টি দেশের পারস্পরিক স্বার্থে গঙ্গার পানি বন্টনের বিষয়টি আশু নিষ্পত্তি প্রয়োজন। তাছাড়া পানি বন্টনের প্রশ্নটি নিষ্পত্তি না হলে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না বলেও আলোচনায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমেদ সে কথাও উল্লেখ করেছেন। ভারতের পক্ষ থেকে বৈঠকে নেতৃত্ব করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং। বৈঠকে উভয় দেশ ঐক্যমত পোষণ করেছেন—দু’টি দেশ পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য একটা সমাধানে অবিলম্বে পৌঁছুবে। এবং সে কারণে একটি সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে কার্যকরী হবে বলেও তাঁরা মত ব্যক্ত করেছেন। গঙ্গার পানি বন্টনের প্রশ্নটি উভয় দেশের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বহু আলোচিত বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে পাকিস্তান আমলেও বহু তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। এবং তৎকালে ফারাক্কা প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার মনোভাবে গড়ে তোলার জন্যে এই প্রশ্নটিকে কাজে লাগানো হয়েছিলো। ফারাক্কা বাঁধ তৈরী করে ভারত গঙ্গার পানি দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারবে এটাই ছিলো তৎকালের পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর একটি শ্লোগান। বাংলার মানুষ সেই অভিসন্ধিতে ভোলেনি। আজ দেশ স্বাধীন হবার ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেক উন্নত হয়েছে। এখন উভয় দেশের যে সকল সমস্যা রয়েছে তার সম্মানজনক সমাধান আশু প্রয়োজন। ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম। ‍উল্লেখিত দিল্লী বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ আশাবাদ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে—অনতিবিলম্বে উভয় দেশের স্বার্থেই গঙ্গার পানি বন্টনের প্রশ্নটি একটি সম্মানজনক মীমাংসা হবে। এবং মীমাংসা হবার পূর্বে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না বলেও জানানো হয়েছে। আমরাও আশাবাদী যে, উভয়ে দেশের স্বার্থে এই মৌলিক প্রশ্নটির একটি ন্যায়ত সমাধান অবিলম্বে হবে। এবং বাংলাদেশের এই গঠন পর্বের নানা প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলায় নিয়োজিত মানুষের জীবনে ফারাক্কা বাঁধ কোন অভিশাপ হিসেবে নেমে আসবেনা। বরং ফারাক্কা উভয়ে দেশের গঠন ও প্রকৃতির স্বার্থেই ব্যবহৃত হবে বলে আমরা আশা করি।

একি কথা শুনি আজ—

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ উইলিয়াম রজার্স সম্প্রতি টোকিওতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন যে, এশিয়া থেকে সামরিক শক্তি হ্রাস করার কোন পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। জাপান যদি তাইওয়ান বা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের কোন পরিকল্পনা নেয়, তাতেও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটাবেনা মার্কিন বাহিনী তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকবে।
মিঃ রজার্স এখানেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো বলেছেন যে, দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে আধুনিক করার প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত রাখবে এবং তার পাশাপাশি মার্কিন বাহিনী অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকবে।
মিঃ রজার্সের এই বক্তব্য তাঁর খোদ প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিহীন বলে আমাদের কাছে অনুমিত হচ্ছে এবং বেশ খটকাও লাগছে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৬৮ সালে তাঁর নির্বাচনী প্রচার অভিযান পরিচালনাকালে স্পষ্টতঃ বলেছিলেন, এশীয় দেশগুলো এক্ষণে নিজেদের ব্যাপারে বিশেষ করে নিজেদের আত্মরক্ষার প্রশ্নে বেশ সুদৃঢ় হয়ে উঠছে। কালক্রমে এশিয়ার যে সব স্থানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে সেগুলোর প্রশ্নে মার্কিন সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। ১৯৭২ সালের নির্বাচনকালে নিক্সন এ কথার পুনরুল্লেখ করেছিলেন এবং এর ভিত্তিতেই মার্কিন সরকার ভিয়েতনামে আগ্রাসী যুদ্ধের অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মূলতঃ এশীয় ভূখন্ডে মার্কিন সামরিক তৎপরতা অন্য কথায় এশীয় এলাকায় মার্কিন সামরিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠার মৌলনীতিটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই মার্কিন সরকারগুলো গ্রহণ করেছিলো। ভিয়েতনামে দীর্ঘ ২০ বছর আগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনা কম্বোডিয়া, লাওসের মাটিতে নতুন রক্তবন্যা বইয়ে দিয়ে এবং তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়া সামরিক ঘাঁটি তৈরী করে এশিয়ার মানুষের কাছে মার্কিনীরা সাম্রাজ্যবাদী বলে আখ্যায়িত হয়েছে। এশিয়ার মানুষ এই সাম্রাজ্যবাদ দন্তনখরে বার বার হত্যা-মৃত্যু-ধর্ষণ আর নৃশংসতার খপ্পরে পড়ে প্রতিবাদপ্রত্যয়ে গর্জে উঠেছিলো। সেই গর্জনের কম্পন যদিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বেদীকে আঘাত করতে খুব বেশী সক্ষম হয়নি, তবুও সেই কম্পন অনুভূত হয়েছে মার্কিন সাধারণ মানুষের অন্তরে। মার্কিন সরকার এশীয় ভূখন্ডস্থ তার আগ্রাসী রণ তৎপরতা ও সামরিক ঘাঁটি সম্পর্কে নতুন ভাবে চিন্তা শুরু করেছিলো।
কিন্তু মিঃ রজার্সের সাম্প্রতিক এই উক্তি এশিয়ার সাধারণ মানুষ তো বটেই—বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকেও উদ্বিগ্ন না করে পারেনা। মিঃ রজার্সের এ উক্তির পেছনে যে মার্কিন সরকারের সমর্থন নেই তেমনটিও মনে করার কোন কারণ নেই। কেননা তিনি সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী—সরকারের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের সর্বোচ্চ পরামর্শদাতা। তাহলে কি বুঝে নিতে হবে মিঃ নিক্সন আসলে যা বলে মার্কিন দেশের সাধারণ মানুষের ভোট লাভে সক্ষম হয়েছিলো, তা একটা বিরাট ভাওতা? যদি তা না হয়, তবে মিঃ রজার্সের এই বক্তব্য তাঁকে অস্বীকার করতে হবে—আশ্বস্ত করতে হবে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!