You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.19 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আন্তর্জাতিক অপরাধ ও ট্রাইব্যুনাল বিল | আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ | আরো তিনটি দেশের স্বীকৃতি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১৯ই জুলাই, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ৩রা শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ও ট্রাইব্যুনাল বিল

গত পরশুদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন মূলতবী হয়ে গেছে। মূলতবী অধিবেশনের পূর্বাহ্নে জাতীয় সংসদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হয়েছে। বিলটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কিত। গণহত্যাজনিত অপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধে অপরাধী ব্যক্তিদের শাস্তিদানের নিমিত্ত এই বিলটি পাশ করা হয়েছে। বিলটির উপর সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সরকার দলীয় সদস্য ও বিরোধী দলীয় সদস্য সহ বেশ কয়েকজন সদস্য আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বিলটির উত্থাপক আইনমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর বিলের ‍উপর আলোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেছেন—বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার দায়ে যুদ্ধাপরাধী বলে যারা অপরাধী তাদের অন্যায়ের তুলনায় গৃহীত আইনটি অত্যন্ত উদার এবং অপরাধীদের ন্যায় বিচারের জন্যে বিলটিতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁর মতে, হিংসার বা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ মন দিয়ে এ আইন প্রণীত হয়নি। এ ব্যাপারে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শান্তির শত্রুদের চিহ্নিত করা। ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর অপরাধ আরো অনেক বেশী। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিচারের জন্যে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা অনেক সংযত। বস্তুতঃপক্ষে যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্যে যে বিল সংসদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত বিলের অনুমোদনের সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর এর একটি সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব অনুধাবিত হয়েছে। এবং যারা বাংলাদেশে অমানবিক গণহত্যা চালিয়েছে তাদের বিচার অবিলম্বে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যারা যুদ্ধাপরাধী বলে গণ্য তাদেরকে অবশ্যই বিচার করা প্রয়োজন। যেহেতু বাংলাদেশে অমানবিক গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানীরা সেহেতু যারা অপরাধী তাদেরকে শাস্তির নিশ্চয়তার জন্যে বিচার করতে হবে। এদের অন্যায় আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণে বিচার্য। বিলটি পাশ হওয়ার পর অনিবার্যভাবে তাই দেখা দিয়েছে তাদের বিচারের প্রশ্নটি।

আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ

আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। রাজতন্ত্রের বদলে প্রজাতন্ত্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সর্দার মোহাম্মদ দাউদের নেতৃত্বে পরিচালিত এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশা জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যূত করে আফগানিস্তানকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে। সর্দার দাউদ খান বেতার ভাষণে দেশের সামগ্রিক অবস্থা পূর্বাপর বিচার বিশ্লেষণ করে বৈদেশিক নীতি প্রসঙ্গে বলেছেন, আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতি হবে জোট নিরপেক্ষ এবং কোন সামরিক জোটের সঙ্গে আফগানিস্তান চুক্তিবদ্ধ হবে না। আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতি হবে দেশের আভ্যন্তরীণ নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যা আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকবে।
তিনি আরো বলেছেন, এই নতুন প্রশাসন জাতিসংঘের সনদ বা বিশ্ব শান্তির পক্ষে যারা কাজ করে যাচ্ছে তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মানবতার প্রশ্নে আফগানিস্তান বিশ্বের অন্যান্য শান্তিকামী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করে যাবে।
সর্দার দাউদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বলেছেন এটিই একমাত্র দেশ যার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে এবং আমরা তার সমাধানে কৃতকার্য হইনি।
কোন্ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটেছে তার বিস্তারিত সংবাদ এখনো এসে পৌঁছেনি। তবে সর্দার দাউদ খানের ভাষায় বলা যেতে পারে আফগানিস্তান দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলো। জনমনের ধূমায়িত অসন্তোষেরই এ বহিঃপ্রকাশ।
বর্তমান বিশ্বের চলমান ঘটনাপ্রবাহ রাজতন্ত্রের পক্ষে নয়। রাজতন্ত্রের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় আফগানিস্তানে প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আফগানিস্তানের দিকে নিবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক এক অপরিশোধ্য মানবিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের কয়েক সহস্র নাগরিক পাকিস্তানের বন্দী শিবির থেকে পলায়ন করে আফগানিস্তানে আশ্রয় পেয়েছিলো। তাই সেখানকার সরকার পরিবর্তনের কথা, বিশেষ করে সামরিক বিদ্রোহের মাধ্যমে অস্বাভাবিক ও চাঞ্চল্যকর পরিবর্তনের সংবাদ আমাদের মনকে আলোড়িত করবেই।
আফগানিস্তানের নতুন শাসক সর্দার মোহাম্মদ দাউদ খান ব্যক্তি রাজনীতিতে নবাগত নন। কাবুলের রাজনীতির সাথে তিনি দীর্ঘদিন ধরে জড়িত এবং বিশ্বে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি। আফগানিস্তানের সামন্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি সাধারণ চেতনার মানদন্ডের তুলনামূলক বিচারে প্রগতিশীল ভাবধারার অনুসারী বলে অনেক মনে করেন। এমতাবস্থায় তথ্যের অভাবে কোন প্রকার চূড়ান্ত অভিমত প্রকাশ না করেও আমরা এটুকু প্রার্থনা করতে পারি যে, সর্দার দাউদ খান নয়া আফগান প্রজাতন্ত্রকে শান্তি ও প্রগতির পথে পরিচালনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটাই যেন সত্য-প্রতিষ্ঠা হয়।

আরো তিনটি দেশের স্বীকৃতি

আরো তিনটি দেশ বাংলাদেশের বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছে। এই তিনটি দেশই পশ্চিম আফ্রিকার মাগরেব এলাকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আকারে, আয়তনে এবং লোকসংখ্যার দিক থেকে এই তিনটি দেশই বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ছোট। তিনটি দেশের আয়তন একুনে বাংলাদেশের আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশের চাইতেও কম এবং লোকসংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশের মতো। এই তিনটি দেশ হচ্ছে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মৌরিতানিয়া।
ইতিহাস সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী এই তিনটি দেশ। পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে এই তিনটি দেশই স্বাধীনতা লাভ করেছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংগ্রামের দিক থেকে এই তিনটি দেশেরই বাংলাদেশের সাথে একটি সম্পর্ক রয়েছে। আলজেরিয়া দীর্ঘ দশ বছর কাল সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে ফরাসী বাহিনীর গণহত্যা আর নিদারুণ ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর বুকে নিয়ে ১৯৬২ সালের ৩রা জুলাই ফরাসী উপনিবেশের জিঞ্জির ছিন্ন করে স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। তিউনিসিয়াও ১৯৫৬ সালের ২০শে মার্চ ফ্রান্সের অধীনতা মুক্ত হয় এবং মৌরিতানিয়াও সেই একই ফরাসী উপনিবেশের শাসনের হাত থেকে মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ২৮শে নভেম্বর। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম, রক্তদান আর উপনিবেশ শক্তির যাঁতাকলে নিপিষ্ট হওয়ার ঐতিহ্যও বাংলাদেশের ঐতিহ্য। আর সেই মহান ঐতিহ্যের ধারক এই তিনটি দেশের সাথে বাংলাদেশের একটি আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। সংগ্রাম আর ঐতিহ্য তাদের একটিকে আরেকটির কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
আলজেরিয়ার সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামকালে আজকের বাংলাদেশ এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তাঁদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলো। সমর্থন জানিয়েছিলো আফ্রিকার সকল মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর প্রতি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে পাকিস্তানী অপপ্রচারে বিভ্রান্ত আফ্রিকান দেশগুলোর পক্ষ থেকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য সাহায্য ও সমর্থন পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাতে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেও বুঝতে পেরেছিলো যে ঐ এলাকার জনগণ যখন বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য অবগত হতে পারবেন, তখনই পাকিস্তানী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপপ্রচার তাঁরা বুঝতে পারবেন। সত্য স্বীকারে এগিয়ে আসবেন। বাংলাদেশের জনগণের সেই আশা এখন ফলপ্রসূ হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য এলাকাগুলোর মতো মাগরেবের দেশগুলোও এখন এই নতুন স্বাধীন জনগোষ্ঠী এবং তাদের সার্বভৌমত্বকে বুঝতে পেরেছেন—বুঝতে পেরে মেনে নিয়েছেন।
উল্লেখ্যযোগ্য যে, মাগরেবের অন্যতম বড় দেশ এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ মরক্কোও গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং মৌরিতানিয়া প্রায় এক সাথেই বিশেষ করে শেষোক্ত দেশ তিনটি একই দিনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের কর্মতৎপরতার নিদর্শন অন্য কথায় কূটনৈতিক সাফল্যের নিদর্শনই প্রতিভাত হয়েছে। এ নিয়ে এ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১০৩টি দেশই বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন। পাকিস্তান ও চীন সহ বাকী ৩৫টি দেশও শীঘ্রই তা মেনে নেবে বলে বাংলাদেশের মানুষ আশা করেন।
পাকিস্তান অবশ্য তার জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে একটি বিল পাশ করিয়েছে। চীনের অতি সাম্প্রতিক কথাবার্তাও অনুৎসাহব্যঞ্জক নয়। এমতাবস্থায় আশা করাটা সম্ভবতঃ অহেতুক হবেনা যে, আজো যারা বাংলাদেশের প্রতি অহেতুক শত্রুভাবাপন্ন শীঘ্রই এমন দিন আসছে যে, তারাও তাদের ভুল বুঝে এ দেশটিকে স্বীকার করে নেবেন—বিশ্ব সভায় পাশাপাশি বসে মানবতার কল্যাণে একযোগে কাজ করে যাবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন