You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৮ই জুলাই, বুধবার, ১৯৭৩, ২রা শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

এখনও যদি কিন্তু তবে

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো এখনও পর্যন্ত যদি কিন্তু তবে ইত্যাদি জাতীয় ব্যাধিতে ভুগছেন। কথার মারপ্যাচ ছেড়ে খোলা দিলে মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে এখনো তিনি নারাজ।
চলতি সপ্তাহে জনাব জুলফিকার আলী ভুটো তাঁর ভাষায় ‘এক সপ্তাহব্যাপী ব্যক্তিগত সফরে জেনেভো’ গেছেন। জেনেভায় পৌঁছে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো বলেছেন, ‘উপযুক্ত সময়ে স্বীকৃতি থাকবে না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের ভয় থাকা উচিত নয়। তাঁকে এখন আলোচনার জন্যে তৈরী থাকতে হবে।’
তিনি আরো বলেছেন,‘ভারতে আটক ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী ফেরত দেয়ার জন্যে পাকিস্তান যে দাবী করেছে তার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘যুক্ত ঘোষণাকে তিনি মেনে নিতে পারেন তবে আগে আলোচনা এবং পরে স্বীকৃতির প্রশ্ন ওঠে। আমাদের সকল যুদ্ধবন্দী ফেরত আসবে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা স্বীকৃতির পূর্বে হবে—আমরা এতে নিশ্চিত হতে চাই। এজন্যে আলোচনার প্রয়োজন।’
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সোজা পথে হাঁটেন না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জনাব ভুট্টো একই বায়না ধরেছিলেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আজো ভুট্টো সাহেব সেই একই সুরে কথা বলছেন। এ যেন সপ্তকান্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপের মতো অবস্থা।
ভুট্টো সাহেব জেনেভাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে টালবাহানা করলেও তারই সহকর্মী পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী মওলানা কাওসার নিয়াজী কিন্তু করাচীর জনসভায় অন্য সুরে কথা বলেছেন। ঠিক যে সুরে ভুট্টো সাহেব কথা বলেছিলেন গত বছর সিমলা বৈঠকের পর। মওলানা কাওসার নিয়াজী করাচীর জনসভায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কিছুসংখ্যক লোক পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিরোধিতা করছে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি সহজতর করবে।’
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী মওলানা কাওসার নিয়াজীর বক্তব্য আর ভুট্টো সাহেবের বক্তব্য কিন্তু এক নয়।
ভুট্টো সাহেব বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে জাতীয় পরিষদের মতামত চেয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের স্বপক্ষে রায় দিয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে রায় পাওয়া সত্ত্বেও ভুট্টো সাহেবের টালবাহানা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। তাছাড়া বাংলাদেশ এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই স্বীকৃতির প্রশ্নটি সকল সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত হিসাবে আরোপ করেনি। বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণায় স্বীকৃতির প্রশ্নটিকে না তুলে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানীদের পাকিস্তানে প্রেরণের বিষয়টিই উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা বিশ্বের সর্বত্র অভিনন্দিত হয়েছে। অথচ ভুট্টো সাহেব যুক্ত ঘোষণা প্রকাশিত হবার পরও যথাসময়ে সাড়া দেননি। শুধু তাই নয়, ভুট্টো সাহেব আন্তর্জাতিক আদালতে ধর্ণা দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক আদালত পাকিস্তানের আবেদনকে নাকচ করে দিয়েছেন। এতেও কিন্তু ভুট্টো সাহেবের চৈতন্যোদয় হয়নি। তিনি অন্য কোন উপায় না দেখে ওয়াশিংটনের দিকে যাত্রা করেছিলেন যদি একটা কিছু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সন করতে পারেন। বিধি বাম। তাও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেলো। আগামী ডিসেম্বর মাসের আগে ভুট্টো সাহেব মিঃ নিক্সনের সঙ্গে মিলিত হতে পারছেন না। ভুট্টো সাহেবের জেনেভা সফর ব্যক্তিগত বলে বলা হলেও আসলে তিনি আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে আগ্রহী। তারপর তিনি বৃটেন ও ফ্রান্স সফরে যাবেন। সেখানে যদি হাওয়া অনুকূল দেখেন তাহলে আবার অন্য সুরে কথা বলতে শুরু করবেন। অবস্থা বেগতিক দেখলে আবার ‘পুরোনো সেই সুরে কে যেন ডাকে মোরে’ বলে হয়তো সোজা পথে পা বাড়াবেন। ভুট্টো সাহেবের বিদেশ সফর, তথ্যমন্ত্রী মওলানা কাওসার নিয়াজীর বক্তব্য সেই ইঙ্গিতই বহন করছে। তবে আমাদের কথা হলো দীর্ঘ দেড় বছর পর আর যদি কিন্তু তবে ইত্যাদি জাতীয় বক্তব্য উপস্থাপিত করে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। পাকিস্তানের নিজ্স্ব স্বার্থেই সোজা পথে আসতে হবে। তবে যত শীঘ্র ভুট্টো সাহেবের মতিগতির পরিবর্তন হয় ততই মঙ্গল।

গঙ্গার পানি বন্টন

গঙ্গার পানি বন্টনের ব্যাপারে গত সোমবার সকাল থেকে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক আলোচনা বৈঠক শুরু হয়েছে। মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠক হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সরকারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমেদ বাংলাদেশের ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করছেন। তার সঙ্গে ছিলেন সেচ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী ডঃ কে.এল. রাও ও পরিকল্পনামন্ত্রী ডঃ ডি.পি. ধর। অধিবেশনের শুরুতে বন্যা নিয়ন্ত্রণমন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমেদ বলেছেন—বাংলাদেশের মানুষের জীবনের অগ্রগতি ও ভাগ্যের সঙ্গে গঙ্গার পানির প্রশ্নটি জড়িত। এ ব্যাপারে উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ পানির সুষম বন্টনের বিষয় নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করবেন এবং একটি সম্মানজনক সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। আমাদের মন্ত্রী আরো জানিয়েছেন গঙ্গার পানি বন্টনের বিষয়ে সকল তথ্যাদি উভয় দেশের কর্তৃপক্ষের বিশদভাবে জানা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করাতেই পানি বন্টনের প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা ভারতীয় সরকারের নিজ্স্ব প্রয়োজনেই অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো। কলকাতা বন্দরে নৌচলাচল ব্যবস্থা উন্নত ও উপযোগী করে তোলার জন্যেই এ ফারাক্কা বাঁধের দরকার ছিলো। ১৯৭১ সালের পূর্বে বহুবার পাকিস্তান-ভারত প্রশ্নটি নিয়ে বৈঠকে বসেছে কিন্তু কোন সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অগ্রগতি ও কৃষিজীবী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের প্রশ্নে ভাগীরথীর পানিও ভাগাভাগি করার প্রয়োজনীয়তা এসে পড়েছে। খোন্দকার মুশতাক আহমেদ আশাবাদী হয়ে জানিয়েছেন—ভাগীরথীর পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে সমাধান খুঁজে বের করতে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। এ ব্যাপারে ভারতীয় দলের নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংও আশার কথা জানিয়েছেন।
বস্তুতঃপক্ষে ভারত তার নিজস্ব প্রয়োজনেই ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ করেছিলো। কলকাতা বন্দরের উন্নতি সাধনের সঙ্গে তার যে লাভজনক স্বার্থ ছিলো তার কারণেই ফারাক্কা বাঁধের প্রয়োজন হয়েছিলো। কিন্তু ভারতের সেই আপন প্রয়োজন মেটানোর প্রশ্নটিই আজ বাংলাদেশের আর্থিক ও বৈষয়িক অগ্রগতিতে আঘাত হেনেছে। আমাদের দেশের পানির চাহিদা ও বন্যার করাল গ্রাস দুই সৃষ্টি অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে গঙ্গার পানি। ফারাক্কা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে বাংলাদেশে বন্যা হবার পানি ছাড়তে পারেন। আবার পানির অভাবও সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তান আমলেও আমরা জানি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ফারাক্কা বাঁধ তৈরী করে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখকষ্ট বাড়িয়ে দেননি। পাকিস্তান এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে নানা ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিলো। আজ স্বাধীনতার পর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি সমাধান খুঁজে বের করা দরকার। আমরা অত্যন্ত আশাবাদী, আলোচ্য বৈঠকেই গঙ্গার পানি বন্টনের বিষয়টির একটি বাস্তব সমাধান হবে।

১০০টির মধ্যে ৬৩টি বিকল

একশতটির মধ্যে ৬৩টিই বিকল। এবং ঘটনাটা দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ঈশ্বরদীর। ঈশ্বরদী দেশের উত্তরাঞ্চলের তথা দেশের অন্যতম বিশিষ্ট রেলওয়ে জংশন তো বটেই—ঐ এলাকা বিশিষ্ট ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্রও। এই শহরে চারটি বড় বড় ব্যাংকের শাখা, রেলওয়ে পুলিশ থানা, রেলওয়ে অনুসন্ধান ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ দফতর ছাড়াও প্রতিনিয়ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি বড় বড় নগর শহরগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। অথচ সেই ঈশ্বরদীতে টেলিফোনের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ১০০টি এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, সেই একশতটি টেলিফোনের মধ্যে ৬৩টি টেলিফোন গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে অচল।
খবরে বলা হয়েছে যে, প্রবল বর্ষণে ভূগর্ভস্থ টেলিফোন ক্যাবল লাইন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নাকি এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই লাইন মেরামতের জন্যে রাজশাহী বিভাগে মাত্র একজন টেকনিক্যাল ম্যান আছেন। তিনি নাকি এযাবত ঈশ্বরদীতে গিয়ে পৌঁছুতে পারেন নি।
খবরে যা প্রকাশ হয়েছে তাতে ঈশ্বরদীর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার এক ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। ঈশ্বরদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরের টেলিফোন যোগাযোগ যদি আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে গ্রাম বাংলার অন্যান্য এলাকার অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। দেশের সর্বত্র টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা আজ যেন এক বিরাট প্রহসনে পরিণত হতে যাচ্ছে।
ঈশ্বরদী বা গ্রাম-বাংলার অন্যান্য এলাকা তো বটেই—দেশের আজ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও টেলিফোনের হাল-হকিকত প্রায় একই ধরনের। টেলিফোন ডেড শব্দটি আজ প্রায় সকলের মুখেই শোনা যায়। এমতাবস্থায় যাঁদের টেলিফোন রয়েছে—অনেক ক্ষেত্রেই টেলিফোন তাঁদের জন্যে যেন বিড়ম্বনার জ্বালা বয়ে নিয়ে আসে। এ বিড়ম্বনার হাত থেকে যত শীঘ্রই মুক্তি পাওয়া যায়, ততই মঙ্গল।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!