গাইবান্ধায় শেখ মুজিব ও সোহরাওয়ার্দী
২০ জানুয়ারি ১৯৫৩ তারিখের পাকিস্তানী গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯ জানুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে ঢাকা থেকে শেখ মুজিব ও সোহরাওয়ার্দী গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ২০ তারিখ দুপুর ১২ টার দিকে তারা পৌঁছায় এবং জেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী আবুল হোসেন, সাব-ডিভিশনাল সেক্রেটারী মতিউর রহমান, ফজলুর রহমান (ছাত্র) সহ প্রায় ৮০০ সদস্য তাদের স্টেশনে রিসিভ করতে আসে। তারা যেসব শ্লোগান দিচ্ছিল সেগুলো হচ্ছে, নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর; পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ; কায়েদে পাকিস্তান সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ ইত্যাদি। এরপর তারা ডাকবাংলোতে পৌঁছায়।
প্রাদেশিক আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিব সরকারের পাটনীতি, শিক্ষানীতি এবং অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যার্থতা নিয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন গত পাঁচ বছর এসব উন্নয়ন প্রজেক্ট সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়েছে। পাটশিল্পে গত পাঁচ বছরে যে অনিয়ম হয়েছে তা অত্যন্ত করুণ। পাট ব্যবসায়ীরা যে দাম পাচ্ছেন তা ১৯৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০-৫১ সালের চেয়েও কম। এখন উৎপাদন ব্যয় ওঠানোই কষ্ট। যদিও নুরুল আমিন বলেছে সীমান্তের ৫ মাইলের মধ্যে যেসব যায়গা আছে সেখান থেকে সব পাট নির্ধারিত দামে কিনে নিতে, কিন্তু এজেন্ট এবং স্বীকৃত ডিলারদের বাজার দরেই পাট কিনতে গোপনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় আখ চাষীরাও ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা। গরীব জনগণ পর্যাপ্ত সাহায্য না পেলেও ঢাকা শহরে হোটেল নির্মানে ৬০,০০০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে! অন্যান্য বড় বড় অফিসারদের জন্য আরও দালান নির্মিত হচ্ছে। শিক্ষাখাতে যা হচ্ছে তা জনগণের সাথে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। আসলে নেতারা এবং সরকারী অফিসাররা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় মনযোগী হলেও সাধারণ জনগণের শিক্ষা নিয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। এভাবে তারা সাধারণ জনগণ আর উচ্চ পর্যায়ের সরকারী অফিসারদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করছে।
জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। অতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে সুপারি ও তামাক ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা। তাদের ভোগান্তি চরমে।
সরকার চট্টগ্রাম, ঢাকা, করাচী ও অন্যান্য যায়গায় নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করছে। তিনি সাম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলি এবং করাচীতেও ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষনের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, খাজা নাজিমুদ্দিন যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে। এর লিখিত ডকুমেন্ট তার কাছে আছে। পুলিশ সেটা খুঁজে পাবেনা।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে পাকিস্তান ইসলামিক দেশও নয়, গণতান্ত্রিক দেশও নয়। পাঞ্জাবে আন্দোলন যখন তীব্র হল তখন নাজিমুদ্দিন তার দলবল নিয়ে সেখানে সমাধান করতে গেলেও নিজের অঞ্চলের জনগণের প্রতি সেই দায় তিনি দেখাচ্ছেন না। উল্টো পূর্ব বাংলারই নুরুল আমিন তাকে সমর্থন দিচ্ছে।
‘পাবলিক সেফটি এক্ট’ (Public Safety Act) এর নামে প্রবীণ মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম যিনি চোখে দেখেন না, খয়রাত হোসেন ও অন্যান্য যারা দেশের জন্য নিজেদের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়েছেন তাদেরকে বিচারের নামে জেলে পুরে রাখা হয়েছে।
নাজিমুদ্দিনের অবস্থা চীনের চিয়াং-কাই-শেকের মতো হয়েছে। চীনে মন্ত্রীদের ৫০০ টাকা বেতন দেয়া হয়।
চীনের স্বাধীনতা পাকিস্তানের পরে হলেও প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপের জন্য তারা সব দিকে দিয়ে অনেক বেশী উন্নতি করেছে এবং সেখানে কোন ভিক্ষুক পাওয়া যায়না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে সেখানে জনগণের কোন ভোগান্তি নেই। কেউ না খেয়ে মরেনা। কৃষকদের মাঝে তারা জমি বণ্টন করে দিয়েছে। সেখানে বেকার সমস্যা দূর করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত শিক্ষা বিনা বেতনে করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যে নাজিমুদ্দিন পাকিস্তান আন্দোলনের সময় আমেরিকা ছিলো সে এখন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী! এরপর সে গভর্ণর জেনারেল এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হল। অথচ পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ না খেয়ে মারা যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আন্দোলনের মাধ্যমে খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমিন ও ক্ষমতাশীল অন্যান্য নেতাদের থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে। অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। [1, pp. 38–41]
References:
[1] S. Hasina, Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation, Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Declassified Documents Vol – III (1953). Hakkany Publisher’s, 2019.