You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৪ই জুলাই, শনিবার, ১৯৭৩, ২৯শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সূতা ও কাপড় বন্টন কলুষমুক্ত করতে হবে

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন গণভবনে। বৈঠকে সূতা ও কাপড় বিলিবন্টন নিশ্চিত করার জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম উক্ত কমিটির প্রধান মনোনীত হয়েছেন। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডঃ আবদুস সাত্তার। এছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রী ও সমবায় মন্ত্রীও কমিটির সদস্য থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী আরও একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তাঁত গণনার। গত ৫ই জুলাই থেকে গণনার কাজ শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গণনাকারীরা পরিদর্শকরা কাজ শুরু করেছেন। জানানো হয়েছে, আজ অর্থাৎ চৌদ্দই ‍জুলাই গণনার কাজ শেষ হবে। দেশের তাঁত শিল্পের উন্নতির জন্যে যথার্থ পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রকৃত তাঁতের সংখ্যা নিরূপণ করে প্রতিটি অঞ্চলে এই মহান কাজ বাস্তবায়িত করা হবে। এ ব্যাপারে প্রতিটি জেলা কর্তৃপক্ষকে সঠিক গণনা ও পরিদর্শনের কাজ সম্পন্ন করার জন্যেও নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে দেশের তাঁত শিল্পের যথার্থ উন্নতি সাধন করা আজ সরকারের নৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কাজ যেমন দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্যে শুভ তেমনি শুভ তাঁতীদের জীবনের মানোন্নয়নের জন্যে। ইতিপূর্বে তাঁত ও তাঁতীদের নিয়ে আমরা আমাদের মতামত বেশ কয়েকবার ব্যক্ত করেছি। সূতা বন্টনের ব্যাপারে যে সকল নষ্টামি হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে তার দ্রুত নিরসন হওয়া দরকার। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেননি। লক্ষ লক্ষ টাকা অসৎ পথে বিনষ্ট হয়ে গেছে সূতা বন্টনের কেলেঙ্কারীতে। যার দরুণ প্রকৃত গরীব তাঁতী যারা তারা ন্যায্যমূল্যে সূতা কিনতে পারেনি। সরকার বহু সূতা বন্টনের ব্যবস্থা করেও কাপড়ের বাজারে সামান্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি। অথচ ন্যায্যমূল্যে যদি প্রকৃত তাঁতীরা সূতা সংগ্রহ করতে পারতো তাহলে আংশিকভাবে হলেও কাপড়ের মূল্য কিছুটা হ্রাস হতো। ভুয়া তাঁতী সেজে সূতা ব্যবসায়ে যে নিদারুণ কেলেঙ্কারী হয়েছে অবিলম্বে তার স্থায়ী নিরসন হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃত তাঁতী যারা তাদেরকে ন্যায্যমূল্যে সূতা সরবরাহ করে তাদের জীবনের ও সমাজের উন্নতিসাধনে সরকারকে তৎপর হতে হবে। একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, দেশের বিশাল চাহিদা আর অভাবের মাঝে কোনক্রমেই কোন জিনিসের ব্যাপারে আমাদের সরবরাহ ও বন্টনসংক্রান্ত অসাধুতা চলতে দেওয়া উচিত হবে না। ন্যায্যমূল্যে কাপড় সরবরাহের ব্যাপারেও ইতিপূর্বে বহু কেলেঙ্কারী করা হয়েছে। এবং ক্রমান্বয়ে তা চলছে। প্রতিবার কাপড় বন্টনে একটা কারসাজি যে নিশ্চিতভাবে হবে এটা যেন পূর্বে থেকেই দেশের মানুষ জানে। ন্যায্যমূল্যের দোকানে যে কোন জিনিসই নিরাপদে পাওয়া যাবেনা এটা আজ সবারই জানা কথা। এ ধরনের বিশ্বাস স্থায়ী হওয়া মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। আমাদের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সূতা ও কাপড় বন্টন স্থায়ীভাবে কলুষমুক্ত করতে হবে। জনসাধারণের এই অত্যাবশ্যকীয় জিনিস নিয়ে কোন প্রকার কারসাজিই গ্রহণযোগ্য হবে না। এবং বাস্তব অর্থেই কর্তৃপক্ষকে সাধু মনে বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তির প্রশ্নে ওয়াল্ড হেইম

উপমহাদেশের মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলী যদি ইতিমধ্যে মীমাংসা হয়ে যায়, তাহলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে কোন সমস্যা দেখা দেবেনা। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম সম্প্রতি এ অভিমত উচ্চারণ করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশের জাতিসংঘ ভুক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে সেক্রেটারী জেনারেল বাংলাদেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই বলেছেন যে, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি কতিপয় মানবিক সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি আশান্বিত হয়ে মন্তব্য করেছেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যদি যথাযথভাবে পরিস্থিতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাহলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান সংক্রান্ত সমস্যাটির সমাধানও খুব একটা জটিল ব্যাপার হবে না এবং তখন অবশ্যই জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি তীব্র হয়ে উঠবে। সেক্রেটারী জেনারেল জানিয়েছেন যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ পেশ করতে হবে এবং তখন আমরা দেখবো নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ কি ভূমিকা গ্রহণ করে। ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম আরো আশা প্রকাশ করেছেন যে, উপমহাদেশে বিরাজিত মানবিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নাবলীর মীমাংসা হয়ে গেলে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে আর কোন সমস্যাই সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারবেনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি পাকিস্তানের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির উপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল কিনা এ প্রশ্নের জবাবে সেক্রেটারী জেনারেল সোচ্চার কন্ঠে ‍কিছু ব্যক্ত করেননি। তিনি শুধু বলেছেন, সমস্যাগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কযুক্ত। কাজেই তিনি এর চেয়ে বেশী কিছু প্রকাশ করতে পারেন না।
ডঃ ওয়াল্ড হেইমের বক্তব্য থেকে আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি যে, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তির পথটি প্রশস্ত হবে। তাছাড়া তিনি উপমহাদেশের যে মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলীর মীমাংসা কামনা করেছেন, তাও খুবই অর্থবোধক। উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত এই সব মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আগাগোড়াই নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণা উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম চাবিকাঠি হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তবুও পাকিস্তান উপমহাদেশে শান্তির পারাবত উড়ানোর জন্যে সক্রিয় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং দিনের পর দিন নানা অছিলায় স্বচ্ছ জল ঘোলা করতেও দ্বিধা করছে না। অতি সম্প্রতি ভুট্টো সাহেব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য দেন-দরবার করছেন। ভুট্টো সাহেবের চৈতন্যোদয় হোক, তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতির তিলক পরিয়ে দিন এবং উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার জন্যে ঐকান্তিক ব্যবস্থা নিন। মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর অবসান হলে উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির উদয় হবে এবং এই শান্তিপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পারে একমাত্র পাকিস্তান। ভারত ও বাংলাদেশ তো কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বৈরী মনোভাব প্রকাশ করেনি। বরং ভারত এবং বাংলাদেশেই উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে উদ্যমী ভূমিকা প্রতিপালন করে চলেছে। সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে একথা আর অবিদিত নেই। হয়তো সেজন্যই অবস্থা বেগতিক দেখে বাংলাদেশের প্রশ্নে পাকিস্তান ইদানীং বেশ নমনীয় হয়ে উঠেছে।
মানবিক সমস্যা সমাধান এবং স্বীকৃতির প্রশ্নে পাকিস্তানে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা দানা বেঁধে উঠেছে। শুধু পাকিস্তান় নয়, চীনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী বলে ঢাকার কূটনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের পূর্বের ভূমিকার পরিবর্তন হয়েছে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। এছাড়া, যেখানে খোদ পাকিস্তানই শেষাবধি বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে চীনের বাংলাদেশকে মেনে নেয়াই বিধেয়। এ ব্যাপারে চীনের নেতাদের মুখ থেকে এখনো চূড়ান্ত কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘদিন পর চীনের প্রচার যন্ত্র থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই নবতম রাষ্ট্রকে ‘বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে বলে ঢাকার চীনাপন্থীরা যে দাবী করেছেন, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে হবে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ, সরকারী ছাড়পত্র না পেলে চীনের প্রচার যন্ত্র থেকে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি কস্মিনকালেও উচ্চারিত হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। অতএব, ধৈর্যধারণ করে দেখাই যাক, পাকিস্তান বাংলাদেশকে কবে নাগাদ স্বীকৃতি দেয় এবং চীনই বা বাংলাদেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের ভিত্তিতে কবে থেকে বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন রচিত করে। অবস্থার চাপে পড়ে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেছিলো। চীন তার ভুলগুলো ধীরে ধীরে সংশোধনের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানও সেই পথই অনুসরণ করছে। এখন উপমহাদেশের মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যাটি বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। উপমহাদেশের এই সব উদ্ভূত কালোমেঘ কেটে গেলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার আপন আসনটি পেয়ে যাবে বলেই আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম আমাদের সেই শুভ ইঙ্গিতটি দিয়েছেন বলে মনে হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!