You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৭ই জুলাই, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ১লা শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

প্রতিটি পুনর্গঠনের কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করা দরকার

ঢাকা নগর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন গত পরশুদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান অধিনায়ক ও বাংলাদেশ সরকারের এম.এ.জি. ওসমানী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। বিভিন্ন মহল দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাজনীতির ‍ঊর্ধ্বে থেকে সংঘবদ্ধভাবে সকল চক্রান্তের মোকাবেলা করার জন্যে তিনি আহ্বান জানান। জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আঘাত আসলে তা যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে বলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা যে বর্তমানে বিভিন্ন প্রকার অসুবিধায় রয়েছে জেনারেল ওসমানী সে কথাও উল্লেখ করেন। সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা না পেলে তাদের জন্যে কিছু করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার জন্যে জেনারেল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতি আহ্বান জানান। স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র সৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমরা বহুবার আমাদের বক্তব্য রেখেছি। বার বার আমরা আমাদের অভিমত পোষণ করেছি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের উপেক্ষার দৃষ্টি দেখে। দেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যারা স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ বাজী রেখে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলো তারা আজ বেকার হয়ে ঘুরে ফিরছে। একাংশ নানা প্রতিকূল কারণে হতাশ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কিছুসংখ্যক আজ বিপথে পা বাড়িয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পর পরই এই যোদ্ধাদেরকে একটি নিয়মের মাধ্যমে আমাদেরকে কাজে লাগানো উচিত ছিলো। এদের জাতির প্রতি যে ভালোবাসা—ত্যাগ ও তিতিক্ষার জন্যে যে মানসিকতা তাকে আমরা দেশের বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারতাম। বিপ্লবের পর এটা করাই ছিলো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী বিবেচনার কাজ। কিন্তু আমাদের সরকার তা পারেননি। কিছুসংখ্যককে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করলেও বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কিছুই করা হয়নি। যে ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে তাতে হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ভাতাদানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে কিন্তু যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বাস্তব কিছু করা হবে না। যদি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে স্বাধীনতার পর পরই আমরা কাজে লাগাতে সক্ষম হতাম—এবং তাদের উদ্যমকে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নিয়োজিত করতাম তাহলে সত্যিকার অর্থে এদেশের উন্নয়নের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতো। তাদের দাবী-দাওয়া পূরণের জন্যে সংসদ গঠন করে মাঠে নামতে হতো না। আজ দেশের স্বাধীনতার সৈনিকরা যদি সরকারের কার্যাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে তার চাইতে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারেনা। এরাই দেশ শত্রুমুক্ত করেছে। নেতাদের অনুমোদন নিয়ে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। অথবা দেশ শত্রুমুক্ত করেনি। সেদিন তাদের বুকে ছিলো বঙ্গবন্ধুর বাণী আর চোখে ছিলো অগ্নিস্ফূলিঙ্গ, হাতে ছিলো অস্ত্র। দেশমাতৃকার প্রতি তাদের যে ভালোবাসা সেটা কারো অনুমোদনে জাগ্রত হয়নি। সে ছিলো স্বতঃপ্রবৃত্ত বিষয়। আজ দেশের পুনর্গঠনে তাদের সার্বিক অংশ গ্রহণের সুযোগ নেই। তারা আজ বিভিন্ন শ্রেণীর ন্যায় একটি শ্রেণী। বিভিন্ন শ্রেণীর দাবী-দাওয়া পেশ করার রীতি অনুযায়ীই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অভাব অভিযোগ পেশ করবে। অথচ এরাই একটি বিপ্লবী সরকারের একমাত্র বাহন শক্তি হওয়ার কথা ছিলো। সরকারের কর্মসূচী বাস্তবায়নে যে কোন স্থানের অভাব পূরণ করার জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়োগ করা যেতো। কিন্তু তা হয়নি। আজো সময় আছে সরকার বাস্তব অর্থে স্বাধীনতার এই সৈনিকদেরকে কাজে লাগাতে পারেন। দেশের প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজেই এরা নিয়োজিত হতে সক্ষম। পাকিস্তানী কর্মকর্তা আর দালাল কর্মচারীদের চাইতে এরা অনেক বেশী দক্ষ ও দেশপ্রেমিক। এই সাধারণ সত্য কথাটি সামনে রেখে আমাদের কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কিছু করবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

মোজাম্বিকে গণহত্যা

মোজাম্বিকে ঔপনিবেশিক পর্তুগীজ সৈন্যরা মুক্তিকামী জনতার উপর নিদারুণ নির্যাতন সংঘটিত করে চলেছে। ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় সম্প্রতি পর্তুগীজ সৈন্যদের নৃশংসতার যে মর্মভেদী বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তা অন্ধকার মহাদেশ আফ্রিকার ‘দাস যুগের’ কাহিনীকেও ম্লান করে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার পর কৃষ্ণ মহাদেশ আফ্রিকার যে অঞ্চলগুলোতে মানবতা আজ ভুলুণ্ঠিত, সেগুলোর মধ্যে এ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ও গিনি বিসাউ-এর রক্তাপ্লুত অঞ্চলই প্রধান। তবে এ তিনটি অঞ্চলের মধ্যে মোজাম্বিকের গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ, মোজাম্বিক অফুরন্ত খনিজ ও কৃষি সম্পদে সমৃদ্ধ। পর্তুগীজ শোষকরা তাই মোজাম্বিকের উপর লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে এর সমুদয় সম্পদ হরণের প্রচেষ্টা করে এবং প্রয়োজনবোধে মোজাম্বিকের সংগ্রামী মানুষের উপর বর্বরতা চালাতেও কসুর করে না।
গত ১৬ই ডিসেম্বর পর্তুগীজ সৈন্যরা উক্ত মোজাম্বিকের উইরিয়ামু গ্রামে মহিলা ও শিশুসহ চারশ’ লোকের হত্যার যে খবর লন্ডন টাইমসে পত্রস্থ হয়েছে, তাতে সমগ্র বিশ্বব্যাপী তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মোজাম্বিকের গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারও এই নৃশংস হত্যাকান্ডের নিন্দা করেছেন। মোজাম্বিকের স্বাধীনতাকামী জনগণের দাবীকে সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশও নির্যাতনের পথ বেয়েই আজ স্বাধীনতার সোনার আলোয় সিক্ত হতে পেরেছে। বাংলাদেশ তাই আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশের নির্যাতিত জনগণের মুক্তি সংগ্রামে আন্তরিকভাবে সমর্থন না করে পারে না। বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত জনতার মুক্তি সংগ্রাম যখন যেখানেই দানা বেঁধে উঠুক না কেন, বাংলাদেশ কখনো মুক্তিকামী মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে না। মোজাম্বিকে তাই যখন পর্তুগীজ সৈন্যদের নির্মম হোলি খেলার খবর প্রচারিত হলো, বাংলাদেশ তখনই ঔপনিবেশিক শোষক পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে এক রাশ ঘৃণার কামান দাগলো। জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ড হেইমও মোজাম্বিকের গণহত্যার খবর শুনে উদ্বেগাকুল হয়েছেন। পৃথিবীর অন্যান্য জাগ্রত দেশ থেকেও এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিন্দা ও ধিক্কার ধ্বনি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। লন্ডন টাইমস মোজাম্বিকের এই নরমেধযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে একে শার্পভিল হত্যাকান্ড ও মাইলাই হত্যাকান্ডের সঙ্গে তুল্যমূল্য বলে আখ্যায়িত করেছে। একাত্তরের পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলার বুকে যে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছিলো, বাংলার বুকে যে ধরনের পৈশাচিক অত্যাচার চালিয়েছিলো, গত ডিসেম্বরে মোজাম্বিকের গ্রামেও পর্তুগীজ সৈন্যরা সেই ধরনের অভিযান পরিচালনা করে মুক্তিপিয়াসী মোজাম্বিকের মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। পর্তুগীজ সৈন্যরা মোজাম্বিকে নির্বিচার গণহত্যা চালিয়ে সেখানকার মানুষের মন থেকে স্বাধীনতার স্পৃহাটিকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিতে প্রয়াসী। লন্ডন টাইমসে প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, পর্তুগীজ সৈন্যরা গর্ভবতী নারীর পেটে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে এবং সেই বেয়নেটের আগায় মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে একটি শিশু। শিশুর কন্ঠে চিৎকার ধ্বনি হলে পর্তুগীজ সেনারা ‘চোপরাও কুত্তার বাচ্চা’ বলে শিশুর কান্না স্তব্ধ করে দেয়। পর্তুগীজ সেনারা স্বামীর সামনে স্ত্রীকে অথবা মাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে, নয়তো বেয়নেটের আঘাতে ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়। এমনি করেই চরম নির্যাতনের মাধ্যমে উইরিয়ামু গ্রামের চারশত নর-নারীকে পাইকারী হারে হত্যা করা হয়েছে। এই গণহত্যার খবর যথাসময়ে পৃথিবীব্যাপী প্রচারিত না হলেও, সম্প্রতি মোজাম্বিকের গণহত্যা সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মোজাম্বিকে পর্তুগীজ শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখার বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামী ‘ফ্রিলিমো’র গেরিলারা রয়েছে। কিন্তু তারা পর্তুগীজ সেনাদের সঙ্গে বর্বরতায় টিকে থাকতে পারছে না। পর্তুগীজ প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মার্সেলো কেটানোর লন্ডন আগমন উপলক্ষে মোজাম্বিক মুক্তি কমিটি প্রবল বর্ষণের মধ্যেও একটি বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করে। এই বিক্ষোভের ফলে প্রধানমন্ত্রী কেটানোর কোন চৈতন্যোদয় হবে কিনা জানি না। তবে পর্তুগীজ শোষকের দিন যে মোজাম্বিকে ফুরিয়ে এসেছে সে সম্পর্কে আমরা আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস করি, মোজাম্বিকে নির্যাতনের দিন শেষ হয়ে এসেছে। বিশ্ব বিবেক নির্যাতনের মুখে আর চুপটি করে থাকবে না। মোজাম্বিকের গণহত্যা সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য জাগিয়েছে। উদ্রেক করেছে ঘৃণার। পর্তুগীজ সৈন্যদের মানবতাবিরোধী এই নিধন যজ্ঞের আমরা নিন্দা করি এবং এর অবসান কামনা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!