বাংলাদেশকে সমর্থন প্রসঙ্গে
জনৈক পাঠক
গত এগারােই এপ্রিল তারিখের যুগান্তরে একটি লেখা পড়লাম। বিষয়বস্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতবর্ষ ও রাশিয়া-চীনের বিরূপতা ও মার্কিন সহানুভূতির তাৎপর্য’ শ্রীবিবেকানন্দ মুখােপাধ্যায়। পূর্বেই বলে নিই আমার বক্তব্য থেকে যেন কেউ না মনে করেন যে, আমি বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের লড়াইকে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবােধ করছি। বরং ঠিক তার উল্টোটাই আমার চিন্তায় আছে।
বিবেকানন্দবাবু লিখেছেন ‘ভারতবর্ষের উদ্দেশে প্রায় ধমকের সুরে বলিতেছেন- কেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাইতেছেন? চীনের এই ক্রুদ্ধ নােট পড়িয়া মনে হয় চীন যেন ভারতবর্ষের অভিভাবক। কিন্তু এই অভিভাবকগিরির অধিকার চীনকে কে দিয়েছে? আমাদের পররাষ্ট্র নীতি ও রণনৈতিক নীতি কী হইবে সেই বিষয়ে গায়ে পড়িয়ে এই মাতব্বরি কিংবা এই উদ্ধত ভঙ্গি কেন?’
সত্যিই তাে চীনকে কে বলেছে গায়ের জোরে গার্জিয়ান হতে? কিন্তু একটা খটকা লাগছে- বিশ্বের যে কোনাে রাষ্ট্র তার নিজস্ব রণনীতি ও রণকৌশল অবলম্বন করতে পারে এবং বক্তব্য রাখতে পারে। তা না হলে ভারত কী করে বিশ্বের বিবেক জাগরণের জায়গীরদারী পেয়েছে? বিবেকানন্দবাবু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের রক্তস্নানের প্রতি সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন এবং বিভিন্ন শক্তিবর্গের (রাষ্ট্রসংঘসহ) বিবেকের নিকট আবেদন জানাইয়াছেন।’ সাড়া দিয়েছে কোন কোন শক্তিবর্গ দেখা যাক। বিশ্বের মুক্তিকামী শান্তিকামীদের মধ্যে আছেন বিবেকানন্দবাবুর ভাষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (মৃদুভাবে) রাশিয়া আর ভারত তাে আছেই। এছাড়া বৃটিশ, ইউরােপীয়, কানাডীয়, অস্ট্রেলিয়ান ইত্যাদি পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বড় বড় সংবাদপত্রে এই নৃশংসতার খবর প্রকাশিত হইয়াছে।
এবার ঘরের কথায় আসি। নিজেদের স্বাধীকার রক্ষার জন্য মিজো ও নাগা জাতি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। হােক না ক্ষুদ্র অংশ। ভাষা ও সংস্কৃতির কোন চোখে দেখব? বিবেকানন্দবাবু কী বলেন, জানতে ইচ্ছে করে। আজ যদি পশ্চিমবঙ্গ পরিস্থিতির গুণে ভারতের অঙ্গীভূত থাকতে না চায় তখন গাই-বাছুর গােয়ালিনীর গণতন্ত্রী সরকার কি হাসিমুখে সেই দাবিটি মেনে নেবে, নাকি পাক-সরকারের নেতা খা সাহেবের মতােই হিংস্র দন্ত বের করে রক্তরঞ্জিত হাতে নৃত্য করবে জাতীয় সংহতি রক্ষার নামে?
বিবেকানন্দবাবু বলেন, “আমরা পূর্ব দিকে এখন একটি গণতান্ত্রিক মিত্র রাষ্ট্রকে পাইতেছি যার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে নতুন নির্বিঘ্নতা বা সিকিউরিটির প্রতিশ্রুতি আনিয়া দিতেছে।’
ভালাে কথা। আজ যদি দিল্লীর মহান ঐক্য থেকে কোনাে অংশ চলে যেতে চায় সংবিধানে কত বছর শাস্তির ব্যবস্থা আছে? উপরন্তু তখন যদি বিশ্বের কোনাে রাষ্ট্র সমর্থন জানায় বা বিবেক জাগরণের চেষ্টা করে, তখন বিবেকানন্দবাবু ও ভারত সরকার কী বলবেন জানতে ইচ্ছে করে।
বলা হচ্ছে পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলাকে শােষণ ও শাসন দ্বারা গত তেইশ বছরে পঙ্গু করে দিয়েছে, তাই বাংলার স্বাধীনতা সগ্রামকে সমর্থন করা উচিত। এই যদি ঠিক হয় তবে ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গ থেকে কী পরিমাণ শুল্ক আদায় করেন এবং তার কত অংশ এই হতভাগ্য দেশের কপালে জোটে সেই হিসাবটা বিবেকানন্দবাবুর কাছে চাইছি। এই প্রসঙ্গে ভাষার ব্যাপারটাও যেন নজর এড়িয়ে না যায়, কোন কোন ভাষার উৎকর্ষের জন্য কতটাকা দিল্লীর দরবার ব্যয় করেছে তারও একটা ছবি আঁকা প্রয়ােজন। কেননা পাকিস্তান তাে উর্দু বাংলাকে পেষণ করছে। তাই এখানে হিন্দি বাংলাকে কতটা তােষণ করছে তার হদিস পাওয়া যাবে।
ভারত তাে অনেক আবেদন-নিবেদন করলাে অনেক প্রস্তাব পাঠও হলাে। কই এখনও তাে স্বীকৃতি দেবার হিম্মত দেখাতে পারেনি। কাজেই অমুক দেশ হেন করেছে, তমুক দেশ তেমন করেছে না করে নিজের চরকায় ভালাে করে তেল দেয়া প্রয়ােজন। ভালাে কথা, ভারত ও আকাশবাণী যে হারে চেঁচামেচি শুরু করেছে তাতে না আবার বিদেশী ফৌজ মােতায়েনের রাস্তাকেই সুগম করে দেয়া হয়। এই মুহূর্তে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়ার কথা মনে রাখুন। তা হলেই এ দেশের সুবিধাবাদী সাংবাদিক, লেখক ও শিল্পীদের সতীত্ব রাখতে গিয়ে কী রকম দেশপ্রেমের চোয়া ঢেকুর উঠছে বােঝা যাবে।
পূর্ববাংলায় যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে তা কোনাে ব্যক্তি বিশেষ বা দলের নয়। হয়েছে বিরাট বিপ্লবী চেতনাসম্পন্ন জনগণের দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামের প্রকাশ। অবশ্য শেখ মুজিবরই বেড়ালের গলায় ঘন্টা বেঁধেছেন।। | লড়াই চলছে এবং চলবে। মাঝে যতই টালবাহনা চলুক না কেন, যতই ডাইনে বাঁয়ে সমঝােতায় এগুতে থােক না কেন এই সংগ্রাম সেদিনই থামবে যেদিন বাংলাদেশে সর্বহারার রাষ্ট্র কায়েম হবে।
সূত্র: দর্পণ
১৪.০৫.১৯৭১